Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘কেন যেন মনে হয়, সব এমনই থাকবে…’


৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ১৮:৫২

মানুষ মাত্রই ব্যস্ত জীবনযাপনে অভ্যস্ত। শিশুরা সারাক্ষণ হাসছে-খেলছে, প্রাপ্তবয়স্করা দৌঁড়াচ্ছে জীবন-জীবিকার খোঁজে। ২০২০ সালে এসে বছরের প্রায় শুরুতেই অতিমারির কারণে সারাবিশ্বের মানুষের থমকে যাওয়াটা এক অবিস্মরণীয় এবং কারো কারো কাছে অলৌকিক ঘটনা মনে হয়েছিল।

কী হলো? কী হবে? কী করবো? কীভাবে জীবন কাটাবো? এমন অসংখ্য ভাবনার মধ্যে দিয়ে মানুষ ভারচুয়াল মাধ্যমের সহায়তায় জীবন-জীবিকা-পড়াশোনা-আত্মীয়তা-বন্ধুত্ব সকল বিষয়ে নির্ভরশীল এবং অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

বিজ্ঞাপন

আমরা যারা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কেন্দ্রিক থিয়েটারচর্চার মানুষ, তারাও ভার্চুয়ালি মহড়া শুরু করি। ফেব্রুয়ারি মাসে ‘জলবাসর’ দেশ নাটক-এর নতুন নাটক মঞ্চস্থ করার পর আর ঐ রাস্তায় যাওয়া হয়নি। জানুয়ারিতে নিশাত আপার আকস্মিক প্রস্থানের কারণে মনে হয়েছিল ‘এই শিল্পকলামুখী না হতে পারাটা সৌভাগ্য’। কেননা, শিল্পকলায় আপার ‘ইয়া বড়’ ছবিখানা দেখতে হবে না। কেমন যেন ছবিটা, কীভাবে যেন চেয়ে থাকে। মনে হয় বারবার প্রশ্ন করে ‘আমাকে মনে রেখেছিস তো বেটা’ যে সত্য মানতে কষ্ট হয়, সেখানে এমন প্রশ্ন থেকে একপ্রকার পলায়ন বলা যায় আর কী…’

মার্চমাসে গৃহবন্দী সময়ে যখন মাত্র প্রতিদিনের রুটিন গুছিয়ে নিয়েছি, তার কিছুদিন পরেই চলে গেলেন আমার ছোট কাকা। দূরে বসে পুরো পরিবারের শোক সহ্য করা যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠল। ট্রমার মধ্যে ছিলাম অনেকটা সময়।

এরপর একের পর এক মেনে না নেবার মতো প্রস্থানের সংবাদ। কয়েকজন সম্মানীত মুক্তচিন্তার, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্থান দেশ ও জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাসের সমুজ্জ্বল মশালগুলো যেন এক একটা দমকা বাতাসে নিভে গেল। আর ঘরে যখন হানা দিলো অতিমারি, তখন তো দিশেহারা অবস্থা হবার কথা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই সময়টাতেই আমি কেমন যেন স্থির মস্তিষ্কে সিদ্ধান্ত নিতে শিখেছি।

বিজ্ঞাপন

ঘরে-বাইরে-জীবনে সর্বক্ষেত্রে ২০২০ সালে প্রচুর সময়, কিন্তু শান্তি নেই, মানুষ শান্ত নেই। এই বছরটাই হারিয়েছি যেমন, মানুষের হারানোও দেখেছি তেমন। হেসেছি কম, কেঁদেছি বেশি। সুন্দরের চেয়ে অতি পরিচিত মানুষের কুৎসিত রূপ প্রকাশ পেয়েছে বেশি, যা সত্যিই কষ্টদায়ক। লোভ দেখেছি, হায়েনার মতো নির্লজ্জ লালসা দেখেছি। ধর্ষণে রক্তাক্ত হতে দেখেছি শিশু-কিশোরী-জননী-ভাইদেরকে। এমন সব দুর্ঘটনা, দুঃসময় প্রতি বছরই আমরা পার করি। কিন্তু এই ২০২০ অধিকতর যন্ত্রণাময়।

মাকে রাস্তায় ফেলে সন্তানকে বালিশে মাথা রেখে ঘুমাতে দেখেছি। সন্তানকে খাওয়াতে না পারার কারণে পিতার আত্মহত্যা করার কথা শুনেছি। হাজার হাজার পরিবারকে শহুরে অভ্যস্ত জীবন ছেড়ে, চোখ মুছতে মুছতে রিফিউজির মতো পুরোনো ঠিকানায় ফিরতে দেখেছি। লাখো চোখ, শূন্যদৃষ্টিতে নির্মল আকাশের দিকে তাকিয়েছে। ক্ষুধা পেটে দূষণমুক্ত বায়ুতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়েছে। মানুষবিহীন ঘরগুলোর জানালা-বারান্দায় পাখিরা কিচির-মিচির করতে করতে আনন্দে লাফিয়ে বেড়িয়েছে।

২০২০-এ আমার লেখাগুলো ‘বিনীতা’ নামে প্রথম মোড়ক পেল। নতুন মঞ্চনাটক মঞ্চস্থ হলো। শুধু এটুকুই, এছাড়া আর ভালো ছিলাম না, ভালো নেই। জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে সবই দেখেছি, প্রতিনিয়ত নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত, ভীত। বাবা-মাকে দেখিনা এক বছর পার হয়ে গেল।

আসছে ২০২১, নতুন বছর। আমি এখনও আতঙ্কিত, কেন যেন মনে হয় ‘সব এমনই থাকবে…’

লেখক- অভিনেত্রী, নির্দেশক ও নাট্যকার

নাজনীন হাসান চুমকী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর