‘আমাকে হাত-পা বাইন্ধা রাষ্ট্রপতির গেটে রাইখা আসো’
১৭ মার্চ ২০১৮ ২২:৪২
।। কাজী সানজিদা রহমান, ফিচার রাইটার ।।
ঢাকা: না, আমি বলব না। কাউরেই আমার পরিচয় বলব না। আমিতো শেষ হইতাম আইছি। আমিতো আর ফিরতাম না। আমি মইরা গেলেগা কার কী।’ কেন আপনার পরিবার আছে, ছেলে মেয়ে আছে, তারা আপনাকে মিস করবে। ‘করুক, মিস করুক। তাতে আমার কি। আমিতো আর দেখতাম না। আপনার পরিচয় কি? ঠিকানা বলেন, আমরা আপনাকে বাসায় পাঠাব। ‘দরকার নাই, আমাকে হাত-পা বাইন্ধা রাষ্ট্রপতির গেটে (বঙ্গভবন) রাইখা আসো। হে আমারে চিনব।’ কথাগুলো একজন মুক্তিযোদ্ধার। বঙ্গবন্ধুর ৭-ই মার্চের ভাষণে যিনি উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন নিজ জেলা কিশোরগঞ্জের রণাঙ্গনে।
তবে আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনেই সেই মুক্তিযোদ্ধা গিয়েছিলেন আত্মাহুতি দিতে। ট্রেন থেকে লাফিয়ে তিনি ছেড়ে যেতে চেয়েছিলেন পৃথিবীর মায়া, পরিবার কিংবা আপনজনদের। তবে তার আত্মাহুতি দেওয়া হয়নি। কিছু যুবকের প্রচেষ্টা তাকে এই কাজ থেকে বিরত রেখেছে।
ঘটনাটি ইঞ্জিন রুমের কাছাকাছি হওয়ায় ট্রেন চালকও দেখছিলেন বিষয়টি। তাইতো শনিবার (১৭ মার্চ) ঘড়ির কাঁটা যখন বেলা ৩টার কাছাকাছি তখন হুইসেল বাজিয়ে রাজধানীর তেজগাঁও রেল স্টেশনে দাঁড়ায় কালনী এক্সপ্রেস। এ সুযোগে ওই বৃদ্ধকে এক রকম জোর করে ট্রেনের ভেতরে তোলে ওই যুবকগুলো। ট্রেনের বগিতে নিয়ে আসার পর আর তেমন কোনো সাড়া শব্দ নেই। ভিড়-ভাট্টাও কমেছে। কিন্তু এরইমধ্যে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার বোঝা গেল। ট্রেনের ইঞ্জিনের বাইরে ঝুলেছিলেন যে বৃদ্ধ তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। তবে ব্যর্থ হয়েছেন। কিছুক্ষণ পরে ট্রেন এসে থামল কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। তারপরের ঘটনা অনেকটাই রহস্যময়। অনেক অস্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে একটি অতি-অস্বাভাবিক ঘটনা এটি।
সত্তরোর্ধ এক বৃদ্ধ। গায়ে হাফ-হাতা পাতলা সাদা গেঞ্জি। ফর্সা মুখে সাদা লম্বা দাড়ি। গায়ে জামা নেই তবে মাথার টুপিটা ডান হাতে ধরা। দেখে মনে হবে কোনো ভালো ঘরেরই অভিভাবক তিনি। যদিও তার পরিচয় এখনও স্পষ্ট হয়নি। ট্রেন থেকে নামার পর উৎসুক মানুষের জটলা জমেছে তাকে ঘিরে। যার মধ্যে সারাবাংলার এই প্রতিবেদকও একজন।
নানা কথার পর তার কাছে জানতে চাওয়া হয় পরিচয়। কিন্তু তিনি পরিচয় দিতে নারাজ। তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোয় বেজায় চটেছেন এসব উৎসুক মানুষের ওপর। জোর গলায় বলছিলেন, ‘আমাকে বাঁচালেন কেন? আমিতো এই ট্রেন থেকে নামার পর আরেকটা ট্রেন থেকে চেষ্টা করব’। এতোক্ষণে বোঝা গেল ট্রেন থেকে ঝাপ দিতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এই বয়স্ক ব্যক্তি কেনইবা মরতে চান? কেনইবা চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে ছাড়তে চান পৃথিবী? এসব প্রশ্নের উত্তর মিললো আরও খানিক পরে।
জানা গেল, সকালে মিরপুরের বাসা থেকে পায়ে হেঁটে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে আসেন সালাউদ্দিন ভুঁইয়া (ছদ্মনাম)। ট্রেনটি যখন ধীর গতিতে স্টেশন ছাড়ছিল তখনই ট্রেনের ইঞ্জিন রুমের পাশে ফাঁকা জায়গার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে যান। ওই অবস্থায় একজন বৃদ্ধকে দেখে কিছুটা কৌতুহল আর সজাগ দৃষ্টি রাখেন অদূরে থাকা কয়েকজন মাদরাসা পড়ুয়া যুবক। যারা ট্রেনের সামনে প্রায় ঝুলেই গন্তব্যে আসছিল। ট্রেনটি যখন চলতে শুরু করেছে তখন বৃদ্ধও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ার। তবে যুবকগুলোর ক্ষিপ্রতায় বৃদ্ধের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কোনো মতে আটকে রেখে তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে এনে একটি বগিতে তোলা হয়। সেখান থেকে ট্রেনটি কমলাপুর স্টেশনে এলে কথা হয় বিস্তারিত।
জানা যায়, একাত্তরে নিজ জেলা কিশোরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সালাউদ্দিন ভুঁইয়া। কর্মজীবনে তিনি মিরপুর সিরামিক্সে কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন। এখন অবসর জীবন। দুই মেয়ে আর এক ছেলের জনক তিনি। মিরপুরে রয়েছে নিজস্ব বাড়িসহ বেশ কিছু সম্পত্তি। তারপরও এই বয়সে হতাশা ভর করেছে এ মুক্তিযোদ্ধার। যে হতাশা তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে নিয়ে এসেছে এই পথে।
বহু কষ্টে তার কাছ থেকে একটি ফোন নম্বর নেওয়া হয়। সে নম্বরে যোগাযোগ করলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে কমলাপুরে হাজির হন তার স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে। তারা জানান, সকালে নাস্তা করে বাড়ি থেকে বের হন তিনি। তারা ভেবেছিলেন স্থানীয় পার্টি অফিসে যাবেন রাজনীতি সচেতন এ ব্যক্তি। কিন্তু তার পরিবর্তে যে এভাবে এখানে তিনি আসবেন সেটি পরিবারের কেউ ভাবতেই পারেননি।
এ বিষয়ে এ প্রতিবেদক কথা বলেন বৃদ্ধের ছেলে গিয়াস উদ্দিনের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। তিনি বলেন, পরিবারে এমন কিছুই ঘটেনি যাতে তার বাবা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে তিনি বলেন, তার বাবা বেশ কিছুদিনে ধরে কিছু অসংলগ্ন আচরণ করছিলেন। তবে কোনো কারণ তারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
তিনি বলেন, তারা বাবা একজন গেজেট ধারী মুক্তিযোদ্ধা। দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা বিষয় নিয়ে তিনি চিন্তা করতেন। তার চিন্তার সঙ্গে অনেকের চিন্তা মিলতো না। এ কারণে মাঝে মধ্যেই তিনি বিরক্ত ও হতাশা প্রকাশ করতেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ তার বাবার বন্ধু। এক সময় একই সঙ্গে রাজনীতিও করেছেন।
ছেলের কথার মধ্যেই নড়ে চড়ে বসেন বাবা সালাউদ্দিন। তিনি বলেন, যে স্বপ্ন, যে উদ্দীপনা নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলাম তার কিছুই পেলাম না। যা চেয়েছিলাম, যেভাবে দেশটিকে দেখতে চেয়েছলাম তার কিছুই হয়নি। একথা বলে আবার থেমে যান তিনি।
এবার আরও মনযোগী হলাম বৃদ্ধের প্রতি। জানতে চাইলাম, এ জন্যই কী আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন? এবার আরও কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠেন তিনি। ক্ষিপ্ত গলায় বলেন, কি করব? আজকে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। আজকে আত্মহত্যা করব না তো কি করব?
আপনি আত্মহত্যা করবেন কেন? আজকে তো আনন্দ করার দিন। কী করব, সে-ই তো ডাক দিছিল। এ কথা বলে নিরব-নিস্তব্ধ হয়ে যান এই মুক্তিযোদ্ধা। তারপর আর একটি কথাও বলেননি। এরপর পরিবারের লোকেরা তাকে একপ্রকার জোর করে বাড়িতে নিয়ে যান। তবে আত্মহত্যা চেষ্টার পেছনে মূল কারণ কি সে বিষয়ে খুব বেশি পরিষ্কার হওয়া গেল না।
সারাবাংলা/কেএসআর/এমএস