ইতিহাসের সাক্ষী বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারির ঢাকা
১০ জানুয়ারি ২০২১ ১৪:২৬
ঢাকা: তখন সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশ-বাংলাদেশ। একদিকে বিজয়ের আনন্দ-উল্লাস, অন্যদিকে স্বাধীন দেশকে গড়ে তোলার প্রস্তুতি। কিন্তু সবকিছুতেই শূন্যতা ভর করেছিল বাংলার মানুষের মাঝে। বাঙালির মুক্তির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি।
তারপর এলো বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি। প্রথমবারের মতো স্বাধীন দেশে পদচিহ্ন রাখতে চলেছেন বাঙালির মহান নেতা। রেডিও, বেতার, টেলিভিশন, রাজপথ সবকিছুতে মুক্তির পূর্ণতার উচ্ছ্বাস। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে লাখো মানুষের স্রোত গিয়ে মিশেছিল রেসকোর্স ময়দানে। সব মিলিয়ে এক অন্যরকম ঢাকা দেখেছিল বাংলার মানুষ।
দিনটি ছিল সোমবার। বিজয় উৎসবের আলোবর্তিকা নিয়ে উঠেছিল ভোরের সূর্য। সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার খবর। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সবখানে শুধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান। সবেমাত্র স্বাধীন হওয়া এ জাতির জন্য বিশেষ দিনটি ছিল সরকারি ছুটি।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবরে পরিপূর্ণ বিজয় উদযাপনের জন্য দেশের আনাচে-কানাচে থেকে ঢাকায় ছুটে আসেন মানুষ। সকাল থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দরের রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষমাণ ছিলেন জনতা। লাখো মানুষের ভিড় ছিল রাজপথেও। স্বাধীন দেশে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকারকে দেখার অধীর অপেক্ষা ছিল সবার চোখেমুখে।
তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। জাতির পিতা আসলেন, প্রত্যাবর্তন করলেন স্বাধীন, সার্বভোম রাষ্ট্র, বাংলাদেশে। পরাধীন দেশ থেকে গ্রেফতার হয়ে প্রায় সাড়ে নয় মাস পর ১০ জানুয়ারি বেলা ১ টা ৪১ মিনিটে তেজগাঁও বিমানবন্দরে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলার মাটি স্পর্শ করেই আবেগে কেঁদে ফেলেন তিনি। ঐতিহাসিক এ নেতাকে বরণ করতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়েছিলেন অস্থায়ী সরকারের সদস্য, অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধারা।
এদিকে বাংলাদেশ বেতারে চলে বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার গান আর কর্মসূচির ধারা বিবরণী, ঐতিহাসিক সেই মুহুর্তের সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ টেলিভিশন। অন্যদিকে বিমানবন্দরে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা দেওয়ার পরও মানুষের ভিড় এড়ানো মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে গার্ড অব অনার শেষে বঙ্গবন্ধুকে খোলা ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় রেসকোর্স ময়দানে। লাখো মানুষের জনস্রোত আর ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখর ঢাকার রাজপথ। বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে যেতে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়।
প্রায় ১০ মাস পর আবারও রেসকোর্স ময়দানে বিপুল জনতার সামনে শেখ মুজিবুর রহমান। চোখে আনন্দ-বেদনার অশ্রু, মুখে হাসি। শহীদদের রক্তভেজা মাটির ওপর দাঁড়িয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাঙালি জাতিকে দিকনির্দেশনা দিলেন বঙ্গবন্ধু। নতুন রাষ্ট্রের আদর্শগত ভিত্তি, রাষ্ট্রকাঠামো, মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী কাজ, নতুন দেশে ছাত্র, সমাজ, কৃষক, শ্রমিকদের ভূমিকা কী হবে নতুন বাংলাদেশ গঠনের কোনো বিষয়ই বাদ পড়েনি তার সেই ভাষণে।
একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণ যেমন বাঙালিকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল, তেমনি বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারির বঙ্গবন্ধুর দেশ গড়ার আহ্বানে নতুন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার করেছিলেন রেসকোর্সের লাখো জনতা। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে। আপনারা জানেন, আমি সমস্ত জনগণকে চাই, যেখানে রাস্তা ভেঙে গেছে, নিজেরা রাস্তা শুরু করে দেও। আমি চাই জমিতে যাও, ধান বোনো, কর্মচারীদের বলে দেওয়া চাই, একজনও ঘুষ খাবেন না, ঘুষ খেলে আমি ক্ষমা করব না।’
রেসকোর্সে নতুন দেশ পুনর্গঠন আর ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখার সেই দিকনির্দেশনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ। ১৭ মিনিটের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালির চিরকালীন সম্পদ হয়ে থাকবে।
সারাবাংলার মানুষ সেদিন এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে দেখতে। কিন্তু রেসকোর্স ময়দান থেকে সেদিন তারা শুরু করেছিলেন দেশ পুনর্গঠনের অভিযান। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে গণতন্ত্রের পথে শুরু হয় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের যাত্রা। সে জন্যই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে ১০ জানুয়ারি, সোমবারের সেই ঢাকা।