বেরিয়ে আসা পাকস্থলী এবং প্রিয়তোষের বেঁচে ফেরা
২২ জানুয়ারি ২০২১ ১৪:২২
হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানার কৃষ্ণপুর গ্রাম। গ্রামটির একদিকে কিশোরগঞ্জ, অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। একাত্তরে চারপাশের অনেকগুলো হাওর এলাকা থেকে অসংখ্য মানুষ শতভাগ হিন্দু জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এই গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। সেপ্টেম্বর মাসের একদিন অষ্টগ্রাম ক্যাম্প থেকে আসা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের নিয়ে হামলা চালায় এই গ্রামে। সারাদিন পুরো গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তারা। হত্যা করে ১২৭ জনকে। নির্বিচারে নারীদের ধর্ষণ করে এবং অনেককে ধরে নিয়ে যায়, যাদের পরবর্তীতে মেরে ফেলা হয়। সেই গণহত্যা থেকে বেঁচে ফেরা গুলিবিদ্ধ প্রত্যক্ষদর্শী ওষুধ ব্যবসায়ী প্রিয়তোষ রায় জানাচ্ছিলেন চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সেদিনের বিভীষিকাময় ঘটনাবলির বিবরণ।
একাত্তরে ঢাকায় ওষুধের ব্যবসা ছিল প্রিয়তোষ রায়ের। ২০-২২ বছর বয়সের তরুণ ছিলেন তিনি। কিছুটা প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় কাছাকাছি বাজিতপুর, রামপুরসহ দূরদূরান্তের বিভিন্ন গ্রাম ও এলাকা থেকে অনেকেই কৃষ্ণপুর গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছিল জীবন বাঁচানোর তাগিদে। গ্রামবাসী যথাসাধ্য চেষ্টায় তাদের আশ্রয় ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলেন। পাকিস্তানি সেনাদের হামলার আগ পর্যন্ত মোটামুটি শান্তই ছিল দুর্গম এই গ্রামটি। আশ্বিন মাসের দ্বিতীয় দিন ছিল মহালয়া। আক্রমণের আগের দিন বিকেলে গ্রামবাসীও অনেকটাই নিশ্চিন্ত ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা সেদিনটাকেই বেছে নিয়েছিল আক্রমণের জন্য।
প্রিয়তোষ জানান, খুব ভোরবেলা হঠাৎ করেই তারা চারপাশে শোরগোল শোনেন, কয়েকজন চিৎকার জানাচ্ছিলেন যে গ্রামে মিলিটারি এসেছে, মিলিটারি গ্রাম ঘেরাও করে ফেলেছে, সাথে রাজাকারেরাও আছে। আগেরদিন বিকেলে স্থানীয় চকবাজারে এসে প্রিয়তোষ অনেকগুলো বড় বড় নৌকা দেখলেও ভাবতেও পারেননি যে পরদিন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা গ্রামে হামলা চালাতে পারে। এই নিরুপদ্রব গ্রামে এমন কিছু কখনো হয়নি। তাই কেউ অতটা গুরুত্বও দেয়নি। পরদিন ভোরে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের গ্রাম ঘিরে ফেলার খবরে গুলির আওয়াজ শুনে তাৎক্ষণিক সবাই ছুটে পালাতে শুরু করে।
প্রিয়তোষ তার বাড়ির বাইরে উঠোনে এসে দেখেন তাদের বাড়িতে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন। বেশিরভাগই নারী। তাদের বাড়িটা একটু জঙ্গল ধরনের হওয়ায় লুকাবার জন্য অনেকেই ছুটে আসছিলেন এখানে। প্রিয়তোষ সেখান থেকে ১০-১২ জন অবিবাহিতা নারীকে বের করে নিয়ে বাড়ির পাশে এক ঘন বেতের ঝোপের ভেতর লুকানোর ব্যবস্থা করলেন। প্রতিবেশী নিতাই ডাক্তারের স্ত্রী, মেয়ে এবং ছেলের বৌকে লুকোবার ব্যবস্থা করে দিতে না দিতেই হঠাৎ প্রিয়তোষ দেখলেন, একজন রাজাকার দুজন পাকিস্তানি সেনাকে পথ দেখিয়ে তাদের বাড়ির পাশে নিয়ে এসেছে এবং চিৎকার করছে এই বলে যে, “বাইর হ, বাইর হ তগোরে দেইখ্যা ফালাইছি”।
দ্রুত ভাবলেন প্রিয়তোষ, যদি তাদের দেখে ফেলে তবে নারীদের বাঁচানো যাবে না, পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে মারবে। এই নারীদের ভেতর প্রিয়তোষের নিজের আপন বোনও ছিল, যে ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে কচুরিপানার নীচে লুকিয়ে ছিল। প্রিয়তোষ ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলেন, তাকে মারতে মারতে ধরে নিয়ে গিয়ে পাশের খালি জায়গাটায় আরও ১০০-১৫০ মহিলা-পুরুষসহ বসাল পাকিস্তানি সেনারা। রাজাকারটি সেনাদের কাছে প্রিয়তোষের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, বিচিত্র ব্যাপারটি হচ্ছে এই রাজাকারটি একসময় প্রিয়তোষদের বাড়ির রাখাল ছিল, তাদের গরু দেখাশোনা করতো।
প্রিয়তোষ সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন, শুধু সেই রাখালটি নয়, সেদিন উপস্থিত সকল রাজাকারই স্থানীয় এবং আশেপাশের এলাকার পরিচিত চেহারা ছিল, যারা পাকিস্তানিদের পথঘাট দেখিয়ে নিয়ে এসে চিনিয়ে দিচ্ছিল সবাইকে। বসানোর কিছুক্ষণ পর এক মেয়েকে দূরের একটা জায়গা দেখিয়ে প্রশ্ন করা হলো, এটা কী? মেয়েটা জবাব দিল, শশ্মান। উত্তর এলো, ‘দশ মিনিটের মধ্যে তোদের সবাইকে শশ্মানে পাঠায় দিতেছি’। কিছুক্ষণ পর একজন হঠাৎ উঠে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করতেই পাকিস্তানি সেনারা তাকে লক্ষ্য করে পেছন থেকে গুলি ছোঁড়ে। প্রিয়তোষ দেখতে পেলেন গুলির ধাক্কায় লোকটার দেহ মাটি থেকে বেশ কয়েকফুট উপরে উঠে তারপর দড়াম করে নীচে পড়লো। পেটে একঝাঁক গুলি লাগায় সাথে সাথে তার নাড়ীভুঁড়ি বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে গিয়েছিল।
এরপর পাকিস্তানিরা সেখান থেকে ২০-৩০ জনকে বাছাই করে বিভিন্ন জিনিসপত্র নৌকায় তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিয়ে গেল। এরপর প্রিয়তোষকেও আরও বেশ কয়েকজনের সাথে কিছুদূর এগিয়ে একটা উঁচু দেয়ালের এপাশে আনতেই প্রিয়তোষ দেখতে পেলেন আরও ১৫/২০ জনকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এই জায়গাটায় কিছুক্ষণ আগে অনেককে অত্যাচার করা হয়েছে। সামনে একটা এলএমজি ফিট করা, কিছুটা দূরে নদীর ধারেও আরেকটা এলএমজি ফিট করা। এটা দেখেই প্রিয়তোষ ধরে নিলেন এখান থেকে বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ এখানে যাদেরই ধরে এনেছিল পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা, তাদেরই চোখ বেঁধে বেশ কয়েকটা লাইনে দাঁড় করানো হচ্ছিল গুলি করার সুবিধার্থে।
প্রিয়তোষেরও চোখ বাঁধা হলো, প্রচণ্ড মারধোর করা হলো এবং একটি টয়লেটের সামনে ফেলে রাখা হলো। চোখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকতেই প্রিয়তোষ টানা গুলির শব্দ শুনলেন। অর্থাৎ সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড় করানো সবাইকেই নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর প্রিয়তোষকে একজন সেনা এসে উর্দুতে উঠে দাঁড়াতে বলল। পাশ থেকে রাজাকারেরা অনুবাদ করে দিচ্ছিল। নির্যাতনের শিকার প্রিয়তোষ উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না, বারবার পড়ে যাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ এমন চলার পর হঠাৎ তিনি তার পিঠে রাইফেলের নলের স্পর্শ পেলেন এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড শব্দে ফায়ার হলো।
প্রিয়তোষ আবিষ্কার করলেন, গুলির তীব্র ধাক্কায় তার পেটে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে এবং সে গর্ত দিয়ে তার পাকস্থলী বাইরে বেরিয়ে এসেছে। হতবুদ্ধিকর অবস্থায় আর কিছু না ভেবে প্রিয়তোষ বেরিয়ে যাওয়া পাকস্থলী আবার চেপে ধরে তার পেটে ঢুকিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকলেন। কিছুক্ষণ পর তার মনে হলো এভাবে পড়ে থাকলে বাঁচার সম্ভাবনা নেই, যেভাবেই হোক পালাতে হবে। যন্ত্রণা সহ্য করে কোনরকমে চোখের বাঁধনটা খুলে প্রথমেই তিনি যা দেখতে পেলেন সেটা হচ্ছে তার সাথেই ধরে আনা প্রতিবেশী নিরঞ্জনের মেম্বারের বড় ভাই এবং তার ছেলেকে একসাথে গুলি করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। একজন সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেও আরেকজন বেঁচে ছিল, তাকে প্রিয়তোষ বললেন যে পালাতে হবে। পেটে গুলি খেয়ে এমন আহত অবস্থায় উঁচু দেয়াল বেয়ে কিভাবে পালাবেন প্রশ্ন শুনে প্রিয়তোষের জবাব ছিল, যেভাবেই হোক দেয়াল বেয়ে উঠে পালিয়ে যেতে হবে। নইলে বাঁচা যাবে না।
সেই অবস্থায় উঠে দাঁড়িয়ে পেটের ক্ষতস্থান শক্ত করে বাঁধলেন তিনি এবং দেয়াল বেয়ে অনেকটা উপরে উঠে গেলেন। কিন্তু এক পাকিস্তানি সেনা টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে প্রিয়তোষের দু’পা ধরে টেনে মাটিতে ফেলে দিল। এরপর তাদের একজন গুলি খরচ না করার পরামর্শ দিয়ে বেতের একটা লাঠি এনে এমনভাবে প্রিয়তোষের বুকের উপর দিয়ে পেটাতে লাগলো যে পেটানোর দাগ দুই বছর পর্যন্ত দগদগে ক্ষত হিসেবে রয়ে গিয়েছিল তার বুকে। প্রচণ্ড নির্যাতনের পরেও প্রিয়তোষ মাটিতে পড়ে রইলেন এবং কিছুক্ষণ পর সুযোগ বুঝে সেই অবস্থায় আবারও উঠে দৌড়ে সেই উঁচু দেয়াল বাইতে শুরু করলেন। ইতিমধ্যে পেটের বিশাল ক্ষতটা খুলে রক্তপাত হচ্ছিল, দেয়ালে ওঠার আগে গামছা দিয়ে আবার বেঁধে নিয়েছিলেন প্রিয়তোষ।
পর পর দ্বিতীয়বারের মতো পেটে-বুকে ক্ষত নিয়ে প্রিয়তোষকে দেয়াল বাইতে দেখে দৌড়ে এলো পাকিস্তানি সেনারা। কিন্তু ততক্ষণে দেয়ালের উপর চড়ে ওপাশে লাফ দিয়েছেন তিনি। এদিকে একের পর এক সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে হতভাগ্য মানুষগুলোর উপর টানা গুলি চলছে, তাজা রক্তে ভেসে যাচ্ছে সবুজ জমিন। ওপাশে লাফ দিয়ে পানিতে পড়লেন প্রিয়তোষ, পানির ভেতরেই লুকিয়ে আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগলেন। তার লক্ষ্য নিজের বাড়ি, যদি মরতেই হয় তিনি নিজের ভিটায় মরতে চান। এদিকে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে, গুলি এবং নির্যাতনে দুর্বল, বেশিদূর পালাতে পারবে না বলে নিজেদের উৎসাহ দিচ্ছে। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর প্রিয়তোষ তীরের কাছাকাছি পাকিস্তানী স্পিডবোটগুলোতে সেনাদের বসে থাকতে দেখলেন। যেহেতু তার পুরো শরীর রক্তে ভেজা, সুতরাং সেনাদের এড়াতে তাৎক্ষণিক পাশের এক বাড়িতে আশ্রয় নিলেন প্রিয়তোষ।
এক নারী ছিলেন সেখানে, তাকে দ্রুত দরজা বন্ধ করতে বললেন। ততক্ষণে ঘরের মেঝে রক্তে ভেসে গেছে। প্রচণ্ড মানসিক জোরে নিজেকে সজাগ রাখলেন প্রিয়তোষ, সেই নারীকে দ্রুত ক্ষতস্থানে আরী শক্ত করে বাঁধ দিতে বললেন তিনি। রক্তপাত বন্ধ করতে সেই নারী বাধ্য হয়ে দু’টো বালিশ নিয়ে আসলেন। কিন্তু বালিশেও কাজ হচ্ছিল না। অবশেষে একসময় আপ্রাণ চেষ্টায় প্রিয়তোষের পেটের ক্ষতের রক্তপাত বন্ধ হলেও কৃষ্ণপুর গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের ভয়াবহ গণহত্যা চলছিলই। সেই ভোর থেকে শুরু করে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত একটানা হামলা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং গণহত্যা চালিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকারের দল।
পাকিস্তানি সেনারা চলে যাওয়ার পর প্রিয়তোষকে সেই বাড়ি থেকে অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। টানা দেড় বছর প্রিয়তোষের চিকিৎসা চলে। এই সময়টা বিছানায় পড়ে ছিলেন তিনি। এক কাত অর্থাৎ একপাশে কাত হয়ে শুয়ে থাকতে হয়েছিল তাকে। অন্যপাশে ফিরতে পারেননি, উঠতেও পারেননি। দেড় বছর পর প্রথম ভাত খেতে পেরেছিলেন তিনি। এই সময়ে বিস্কুট আর ফল-মূল খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল তাকে।
গুলিবিদ্ধ প্রত্যক্ষদর্শী: প্রিয়তোষ রায়
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গবেষক ও লেখক হাসান মুরশেদ (1971 Archive)