Sunday 20 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোকেয়ার সময়ে কঠিন পর্দাপ্রথার প্রকোপ


২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৪:০৯

উনিশ শতকের শুরুর দিকে বঙ্গীয় রেনেসাঁর প্রভাবে হিন্দু সমাজের মেয়েদের অধঃপতিত অবস্থার উন্নতি হলেও মুসলমান মেয়েরা পর্দাপ্রথার অবরোধ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারেনি। বিংশ শতকের শুরুতে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন পর্দাপ্রথার বিরোধিতা করেন। যদিও তিনি সে সময় কিছুটা পর্দার মধ্যেই ছিলেন। ঐটুকু পর্দার মধ্যে না থাকলে হয়তো তিনি তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারতেন না। যার জন্য তাঁকে অনেক প্রবঞ্চনা, গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনি পর্দাপ্রথার বাড়াবাড়ি নিয়ে চরম প্রতিবাদ করেছেন। কারণ, অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে নারীদের পর্দাপ্রথা ছিল একটি প্রবল ব্যারিকেড। যা নারীদের স্বাভাবিক গতিবিধিতে বাধা হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন কেন পর্দা মেনে চলতেন, উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনার অবতারণা করছি। যা শুনেছি বাংলাদেশের প্রথম নারী রিপোর্টার মাহমুদা চৌধুরীর কাছ থেকে। তিনি যখন বেগম পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছেন তখন সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সবসময় এই গল্পটি বলতেন। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন যখনই রোকেয়ার কাছ থেকে লেখা চেয়ে আনার জন্য যেতেন তখন তিনি লক্ষ্য করেছেন, রোকেয়া পর্দার আড়ালে থেকে কথা বলছেন। এমনটা দেখে একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, ‘আপনি এতো প্রগতির কথা বলেন, নারী স্বাধীনতার কথা বলেন, সেই আপনি যদি পর্দার আড়ালে থাকেন তাহলে কিভাবে কি হবে!’ তখন রোকেয়া বলেছিলেন, ‘আজকে আমি আপনার সামনে এসে কথা বললে কোনোভাবে যদি বাইরের মানুষের কাছে চলে যায় তাহলে কেউই তাদের মেয়েদের আমার স্কুলে পাঠাবে না।’ মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন অবাক হয়ে গভীরভাবে বিষয়টি নিয়ে ভেবেছিলেন এবং সেইসাথে দেখেছিলেন রোকেয়ার দূরদর্শিতা। নারীমুক্তির জন্য কাজ করতে গিয়ে রোকেয়া কতটা ধৈর্য এবং বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা কল্পনাতীত। সমাজের বৈরি পরিবেশের সঙ্গে সহনশীল ভূমিকা রাখতে না পারলে আজ আমাদের কাছে এতদূর পর্যন্ত তিনি আসতে পারতেন না এবং আমরাও মুক্তির পথ খুঁজে পেতাম না।

বিজ্ঞাপন

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন পর্দাপ্রথার বাড়াবাড়ির বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তার শৈশবকাল থেকে। অবরোধ-বাসিনী- বইয়ের উৎসর্গ পর্বে তিনি সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করেন। পাল্কী করে দুই বছরের ছোট বোন, তার আম্মাজান এবং সে কলিকাতায় যাচ্ছিলো। সেই পাল্কী স্টিমারের ডেকে রেখে তাদের নদী পার করানো হলো। সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পাল্কীর ভেতরে ছোট বোনটি সজোরে কান্না জুড়ে দিলো। আম্মাজান প্রাণপণ চেষ্টা করে তার কান্না থামাতে পারেন নাই। কিন্তু পাল্কীর নিকট উপবিষ্ট কোনো আল্লাহর বান্দাই ক্রন্দনরত শিশুকে পাল্কী হইতে বাহির করার প্রয়োজন বোধ করে নাই। এমন দৃশ্যে রোকেয়ার ভেতর পর্দার ব্যাপারে প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়। বিষয়টিকে আর সহজ করে নেননি। বয়োবৃদ্ধির সাথেসাথে তার ভেতর নারী জাগরণের জন্য চেতনাগত পরিবর্তন আসে এবং সেইসাথে পর্দাপ্রথার প্রচণ্ড বিরোধিতা করতে থাকেন। অবরোধ- বাসিনী বইটিতে বর্ণনামূলক ঘটনাগুলো তার উৎকৃষ্টতম উদাহরণ ।

রোকেয়ার পোশাক-আশাক দেখে বর্তমান সময়ের অনেকেই মনে করেন পুরাতনী বা সনাতনী, এমনকি রোকেয়ার পর্দা নিয়েও বিদ্রূপ করেন। আমার বিশ্বাস, রোকেয়াকে জানার তাদের ঘাটতি আছে। তারা আরও মনে করেন, রোকেয়া এইসময়ের উপযোগী নন। বিষয়টা যদিও খুবই আপেক্ষিক। তবে, রোকেয়াকে ধারণ করার জন্য তার পোশাক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। রোকেয়াকে বুঝতে হবে মনুষ্যত্ব, মনস্তত্ত্ব এবং আদর্শের দিক থেকে। তাছাড়া, ঐসময়ে পর্দাপ্রথার বাড়াবাড়িটা ছিল অবিশ্বাস্য নির্মম। সেই তুলনায় রোকেয়ার পোশাক খুবই সাধারণ ছিল। ঐটুকু না করলেই নয়। এখন যেমন পোশাকটা যার যার ব্যক্তিগত বিষয়, আমরা কারোর পোশাক বা পর্দা নিয়ে বলি না এবং বলা উচিত নয়। তখন নারীদের মত প্রকাশের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ প্রবর্তিত এবং অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসের ছায়াতলে নারীদের অবরোধ করে রাখা হতো। যেই অবরোধের কারণে নারীরা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছিল। সেই অবরোধ থেকে নারীদের বের করে আনার জন্য রোকেয়া পর্দাপ্রথাতে আঘাত করতে লাগলেন।

সেইসময় রোকেয়া কুসংস্কার ও ধর্মীয় অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। কী ধরনের বাড়াবাড়ি হতো তা অবরোধ-বাসিনী বইটিতে তৎকালীন এদেশের নারীদের ওপর আরোপিত কুপ্রথার বর্ণনায় ভরপুর। যেসব ঘটনার বিবরণ তিনি দিয়েছেন, সেসবের কিছু তিনি নিজে দেখেছেন, কিছু বিভিন্নজনের কাছে শুনেছেন, আর কিছু পত্র-পত্রিকায় পড়েছেন। সেসব মারাত্মক ধরনের প্রথার ধর্মীয় ভিত্তি যেমন নেই, নেই যৌক্তিক ভিত্তিও। যেমন: ঘরে আগুন লাগার পরও গৃহাভ্যন্তরে অবস্থানকারী নারীদের গৃহত্যাগ না করা। এমন কঠিন সময়ে পাল্কির অপেক্ষা করা। এমনকি রেলপথে ভ্রমণের সময় নারীদের পাল্কীতে পুরে মালগাড়িতে তুলে দেওয়া হতো। তাছাড়া, দেড় বছরের শিশুকন্যাকেও পুরুষ ডাক্তার না দেখানো। শিশুর অবস্থা যদি এমন হয় পূর্ণবয়ষ্ক নারীদের অবস্থা কত করুণ ছিল, তা সহজেই অনুমেয়।

তখনকার পর্দার নামে বাড়াবাড়ি কর্মের জন্য যুৎসই একটি উদাহরণ, ‘একবার কোন স্থলে চলন্ত ট্রেনে; মেয়েমানুষের কক্ষে একটা চোর উঠিল। চোর বহাল তবিয়তে একে একে প্রত্যেকের অলঙ্কার খুলিয়া লইল; কিন্তু লজ্জায় জড়সড় লজ্জাবতী অবলা সরলা কুলবালাগণ কোন বাধা দিলেন না।

তাঁহারা সকলে ক্রমাগত ঘোমটা টানিয়া থাকিলেন। তওবা! তওবা! কাঁহা সে মর্দ্দুয়া আ গয়া- বলিয়া কেহ কেহ বোরকার নেকাব টানিলেন। পরে চোর মহাশয় ট্রেনের এলার্মের শিকল টানিয়া গাড়ি থামাইয়া নামিয়া গেল’ (অবরোধ-বাসিনী)। আরও একটি ঘটনা, সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে বিবাহ উৎসবে পাল্কী করে নারী অতিথিরা আসছিলেন। দ্রুত পাল্কী সরিয়ে নিতে হচ্ছিলো বলে এক পাল্কীর বেহারা ভেবেছিলো নারী অতিথি বোধ হয় বের হয়ে অন্দরমহলে চলে গেছেন। তিনদিন পর বিবাহ অনুষ্ঠান শেষে বেহারা আবিষ্কার করে পাল্কীর ভেতর এক নারী তার শিশুপুত্র নিয়ে বসে আছেন। এধরণের অনেক ঘটনা রোকেয়াকে বিমর্ষ করে তুলে।

অদ্ভুত ঘটনা আরও আছে। সে যুগে পর্দা পালনে অত্যধিক বাড়াবাড়ি কেবল মুসলিম নারীদের মধ্যে ছিল, তা কিন্তু নয়। অমুসলিম নারীদের মধ্যেও কিছুমাত্র কম ছিল না। তেমনই একটি ঘটনা: ‘পশ্চিম দেশের এক হিন্দু বধূ তাহার শাশুড়ি ও স্বামীর সহিত গঙ্গাস্নানে গিয়াছিল। স্নান শেষ করিয়া ফিরিবার সময় তাহার শাশুড়ি ও স্বামীকে ভীড়ের মধ্যে দেখিতে পাইল না। অবশেষে সে এক ভদ্রলোকের পিছু চলিল। কতক্ষণ পরে পুলিশের হল্লা। সেই ভদ্রলোককে ধরিয়া কনস্টেবল বলে, তুমি অমুকের বউ ভাগাইয়া লইয়া যাইতেছ। তিনি আচম্বিতে পিছনে ফিরিয়া দেখেন, আরে! এ কাহার বউ পিছন হইতে তাঁহার কাছার খুঁটি ধরিয়া আসিতেছে! প্রশ্ন করায় বধূ বলিল, সে সর্বক্ষণ মাথায় ঘোমটা দিয়া থাকে—নিজের স্বামীকে সে কখনও ভালো করিয়া দেখে নাই। স্বামীর পরিধানে হলদে পাড়ের ধূতি ছিল, তাহাই সে দেখিয়াছে। এই ভদ্রলোকের ধূতির পাড় হলদে দেখিয়া সে তাহার সঙ্গ লইয়াছে!’ অবরোধ-বাসিনী।

এসব সমস্যা শুধু সে যুগের মুসলিম সমাজে ছিল না। এই সমস্যা সেই যুগের সামগ্রিক সমস্যা ছিল। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে নারীদের মধ্যে বাড়াবাড়ি ধরনের পর্দাপ্রথা বিদ্যমান ছিল। এমন পর্দা, যা চর্মচক্ষে আপন স্বামীকে দেখতে সঙ্কোচ তৈরি করে। একটা বিষয় খুবই চমকপ্রদ। সাধারণত এ যুগে যারা যত বেশি ধনী, তাদের নারীদের তত বেশি স্বাধীনতা। সে যুগে ছিল ঠিক এর উল্টা। যারা যত বেশি ধনী, তাদের নারীরা হত ততোধিক অবরোধবাসিনী। সাধারণ নারীদের বহিরাঙ্গনে যাওয়ার জন্য ভারী কাপড়ের বোরকা যথেষ্ট হতো। ধনাঢ্যদের বউ-ঝিদের জন্য দরকার পড়ত আরও বেশি কিছুর। মোটা কাপড়ের বোরকায় আবৃত মহিলাদের মশারীর মধ্যে ঢোকানো হতো। অতঃপর মশারীর চার কোণে চার জন ধরে সামনে অগ্রসর হতো। সর্বক্ষণ অন্তঃপুরে অবস্থানকারী, হাঁটাহাঁটিতে অনভ্যস্ত মহিলারা টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেত। ফলে তাদের টানাহেঁচড়া করে নিতে হত। কী বিচ্ছিরি কাণ্ড! এসব দেখার জন্য লোকের ভিড় লেগে যেত। এসবের উদ্দেশ্য বড়লোকি দেখানো ছিল কি না কে জানে! অবশ্য রোকেয়া তেমন কিছু লেখেননি; হয়ত ছিল। এসব হাস্যকর অবরোধ পুরুষ-কর্তৃক আরোপিত কি-না বেগম রোকেয়া তাও বলেননি।

তবে কিছু ঘটনায় প্রতীয়মান হয় সবক্ষেত্রে পুরুষ-কর্তৃক আরোপিত নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় নারীরা নিজেরাই নিজেদের ওপর অবরোধ আরোপ করেছেন। বরং ক্ষেত্রবিশেষে অত্যধিক বাড়াবাড়িতে পুরুষের বিরক্তি প্রকাশ পেতে দেখা যায়। উদাহরণ: ‘জনৈকা এক মহিলা নিন্মলিখিত ঘটনা বলিলেন: “বহুবর্ষ পূর্ব্বে তাঁহার সম্পর্কের এক নানিজান পশ্চিম দেশে বেড়াইতে গিয়া ফিরিয়া আসিলেন। তিনি যথাসময়ে টেলিগ্রাফ যোগে তাঁহার কলিকাতায় পৌঁছিবার সময় জানাইয়াছিলেন। কিন্তু সেদিন তুফানে সমস্ত টেলিগ্রাফের তার ছিঁড়িয়া গিয়াছিল এবং কলিকাতার রাস্তায় সাঁতার-জল ছিল। সুতরাং এখানে কেহ নানিজানের টেলিগ্রাফ পায় নাই এবং হাবড়া স্টেশনে পাল্কী লইয়া কেহ তাহাকে আনিতেও যায় নাই। এদিকে যথা সময়ে নানিজানে রিজার্ভ-করা গাড়ী হাবড়ায় পৌঁছিল; সকলে নামিলেন জিনিষপত্রও নামান হইল কিন্তু পাল্কী না থাকায় নানিজান বোরকা পরিয়া থাকা সত্ত্বেও কিছুতেই নামিতে সম্মত হইলেন না। অনেকক্ষণ সাধ্য-সাধনের পর নানা সাহেব বিরক্ত হইয়া বলিলেন, ‘তবে তুমি এই ট্রেনেই থাক, আমরা চলিলাম।’ বেগতিক দেখিয়া নানিজান মিনতি করিয়া বলিলেন, ‘আমি এক উপায় বলিয়া দিই, আপনারা আমাকে সেইরূপে নামান।’ উপায়টি এই যে, তাহার সর্বাঙ্গে অনেক কাপড় জড়াইয়া তাহাকে একটা বড় গাঁটরীর মত করিয়া বাঁধিয়া তিন চারি জনে ধরাধরি করিয়া নামাইল”— অবরোধ-বাসিনী। এমন সাংঘাতিক ধরনের বাড়াবাড়ির কথা রোকেয়ার ‘অবোধ-বাসিনীতে’ আরও অনেক উল্লেখ আছে।

একটা ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ঘটনার সারমর্ম হলো— এক বোরকা পরিহিতাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখে তার স্বামী প্রয়োজনবশত কোথাও যান। স্বামী ফিরতে দেরী হওয়ায় ভদ্রমহিলা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং অস্ফুট স্বরে কাঁদতে থাকেন। লোকেরা মহিলার দুরবস্থা দেখে দয়াপরবশ হয়ে তার সঙ্গীর নাম জানতে চান, যাতে খুঁজে বের করা যায়। প্রত্যুত্তরে মহিলা একবার সূর্যের দিকে ইশারা করেন, আরেকবার হাতের ব্যাগ দেখান। পরে জানা গেল মহিলার স্বামীর নাম আফতাব বেগ। উল্লেখ্য, সূর্যকে ফার্সিতে আফতাব বলা হয়। আর ব্যাগ দ্বারা বেগ বুঝিয়েছেন! পর্দা নিয়ে বাড়াবাড়ি সে যুগে এতদূর ছিল যে, মেয়েদের নামের পর্দা করতে হতো। রোকেয়া লিখেছেন, ‘আমাদের ন্যায় আমাদের নামগুলি পর্যন্ত পর্দানশীন। মেয়েদের নাম জানা যায়, কেবল তাহাদের বিবাহের কাবিন লিখিবার সময়’ (অবরোধ- বাসিনী)। এতে প্রতীয়মান হয় যে, তৎকালীন পর্দার নামে এতসব বাড়াবাড়ি স্রেফ সামাজিক বিষয় ছিল, ধর্মীয় নয়।

সমাজে নারীর পর্দা নিয়ে এতকিছু বিশৃঙ্খলা দেখেও রোকেয়া কখনো কখনো পর্দা করার পক্ষে বলেছেন। যদিও তিনি মনে করেন, নারীর পর্দা নিয়ে বাড়াবাড়িটা সামাজিক কুসংস্কার এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি। তবে নারীকে শালীনতার মধ্যে পর্দা করতে বলেছেন। তিনি অবরোধের পক্ষে একটি যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘আমরা যে এমন নিস্তেজ, সংকীর্ণমনা ও ভীরু হইয়া পড়িয়াছি, ইহা অবরোধে থাকার জন্য হয় নাই—শিক্ষার অভাবে হইয়াছে।’ তারপরও রোকেয়া জানতেন অবরোধ ক্ষতিকর; তিনি বলেছেন, ‘আমাদের অবরোধ প্রথাটা বেশী কঠোর হইয়া পড়িয়াছে। ঐ সকল কৃত্রিম পর্দা কম করিতে হইবে।’ কঠিন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বসবাস করে রোকেয়াকে কখনো কখনো আপস করতে হয়েছিল। যার কারণে তাকে ধর্ম নিয়ে, পর্দা নিয়ে অনেক সময় সন্ধিও করতে হয়েছিল। এমন অনেক উদাহরণ আছে। তবে তিনি সবসময় বাড়াবাড়ি পর্যায়ের পর্দাপ্রথার বিরোধিতা করে গেছেন।

পর্দা নামে এতসব কাণ্ড-কারখানা ভারতবর্ষেই ছিল। তৎকালীন আরববিশ্বেও ছিল না। সে যুগের নারীরা জড়বস্তু তো ছিলেন না। তারাও জীবনধারণ করতেন।
আলো-বাতাস তাদেরও দরকার হতো। মানবিক সাধ-আহ্লাদ থাকাও অস্বাভাবিক মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু নারীরা মানবিক বোধ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তারা একেকজন হয়ে পড়েছিলেন যন্ত্রমানব। পুরুষরা কেন বুঝবে, নারীরা নিজেরাই নিজেদেরটা বুঝতেন না। তাদের মধ্যে মানবিক বোধ জাগ্রত করার জন্য, হৃদয়ের বদ্ধ দুয়ার খুলে দেওয়ার জন্য প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে কারো না কারো আগমন অনিবার্য ছিল। কেউ নয়, বেগম রোকেয়া আসলেন। অন্ধ সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন সব অন্যায়-অসঙ্গতি। পরবর্তীতে রোকেয়ার উত্তরসূরি তসলিমা নাসরিন পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে কুঠারাঘাত করলেন, উপড়ে ফেলতে চাইলে সবরকম গোঁড়ামি। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হলো। কারণ, রেডিক্যাল ফেমিনিজম অর্থাৎ চরমপন্থি নারীবাদীরা কোনোরকম পর্দাপ্রথার পক্ষে নয়। কিন্তু সমাজ বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারেনি।

সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছু বদলে গেছে। কিন্তু পর্দাপ্রথার বিষয়টি বর্তমানে কেমন করে যেন সেই একশ বছর আগে ফিরে যাচ্ছে। রোকেয়ার অবরোধ-বাসিনী রচনায় বর্ণীত ঘটনাগুলো বর্তমান সময়ে পরিলক্ষিত না হলেও পর্দাপ্রথা একেবারে উঠে যায়নি, বরঞ্চ অনেকক্ষেত্রে সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। রোকেয়ার সময়ের পর্দাপ্রথার বাড়াবাড়ি বিষয়টা এই একবিংশ শতকে এসেও, অর্থাৎ পৃথিবীর সভ্যতা চরম শিখরে পৌঁছেও দেখতে পাচ্ছি। তাহলে ধরে নিতে হয়, সার্বিক অর্থে এই একশো বছর ধরে নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতার বিষয়টি ঠিক সেভাবে চর্চা হয়ে আসেনি। এখনো অধিকাংশ নারী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দাসী হয়ে আছে। রোকেয়ার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন মারা যাওয়ার পর পরেই তিনি নারী অধিকার আদায়ের সংগ্রামে মাঠে নামেন, অর্থাৎ ১৯০৯ সাল থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত, বলতে গেলে তেইশটি বছর একাধারে নিবেদিত প্রাণ নিয়ে কাজ করে গেছেন।

রোকেয়ার তেইশ বছরের কর্মযজ্ঞের আলোকবর্তিকা এখনো আমাদের আলো দিয়ে যাচ্ছে। যদিও এই আলো ছড়িয়ে যাওয়ার কথা ছিল চতুর্দিকে। কিন্তু বর্তমান সময়ে নারীর পর্দাপ্রথা দেখে খুবই অবাক হতে হয়। যেই বাড়াবাড়ি পর্যায়ের পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গেছেন রোকেয়া, প্রায় একই পর্দা এখন দেখতে পাচ্ছি। তাই রোকেয়ার প্রাসঙ্গিকতা এখনো আমাদের কাছে বহুলাংশে অপরিহার্য। কারণ, রোকেয়ার কর্মযজ্ঞ ছিল নারীর চেতনাকে জাগিয়ে তোলা, নারীকে স্বাবলম্বী করে তোলা। সেই কাজটি ঠিকমতো হয়নি বলে আজ আমাদের নারীসমাজ পশ্চাৎমুখী হচ্ছে, হচ্ছে রোকেয়া সময়ের পর্দানশীন নারী।

টপ নিউজ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর