‘সব প্রতিষ্ঠানে নারী-পুরুষ নেতৃত্বের ভারসাম্য থাকা জরুরি’
৮ মার্চ ২০২১ ০৯:০০
আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আমার অনেকটা ‘সিঙ্গল প্যারেন্ট ফ্যামিলির’ মতো মনে হয়। যেগুলো মেয়েরা লিড করেন সেগুলো একরকম আর যেগুলো ছেলেরা চালান সেগুলো আরেকরকম। কিন্তু কোনোটাই ঠিক সম্পূর্ণ মনে হয় না। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত। কেন জানি মনে হয় যদি ছেলে আর মেয়ে একসাথে হয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো চালানো যেত তাহলে কাজের ক্ষেত্রগুলো আরও অনেক ফলপ্রসূ হতো। সুখী পরিবার হতে যদি বাবা-মা দুজনেরই ভূমিকা থাকতে হয়, সুখী প্রতিষ্ঠান হতেও দুই জনই লাগবে না কেন?
আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সবাই ব্যস্ত কিভাবে দিনটি উদযাপন করা যায় তাই নিয়ে। সবাই ভাবছেন কীভাবে নারী নেতৃত্ব আরও বাড়ানো যায় তা নিয়ে। ভাবছেন কীভাবে নিজেদের পণ্য নারীদের কাছে আরও সুন্দর করে উপস্থাপন করা যায়, একদিনের জন্য হলেও কীভাবে নিজেদের আরও নারীবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রচার করা যায় তাই নিয়ে। নারী নেতৃত্ব আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাড়তে হবে নিঃসন্দেহে। আমাদের কাজের জন্যই নারীদের আরও নেতৃত্বে আসা দরকার। কিন্তু নারী নেতৃত্ব কেমন?
‘বিয়ে করছো কিন্তু নিজের সবকিছু ছেড়ে দিও না’। বিয়ের কিছুদিন পর আমার মা আমাকে এই কথাটা বলেছিলেন। মাত্র বিয়ে করেছি একটা চাকরিও করছি একটি আমেরিকান সফটওয়্যার কোম্পানিতে। কথাটা তখন তেমন গায়ে না মাখলেও পরবর্তী জীবনে অনেকবার মনে হয়েছে আর আমাকে সামনে এগোনোর প্রেরণা জুগিয়েছে।
বিয়ের বছর খানেক পর আমার প্রথম মেয়ের জন্ম। প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসাবে তখন কাজ করি আমি। কাজ ছেড়ে দিলাম কিছুদিনের জন্য। মেয়ের বয়স একটু বাড়লে আবার কাজে ফিরে এলাম। এবার প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসাবে। এরপর আমার ছোট মেয়ের জন্ম হলো। আবারও কাজে বিরতি।
ছোট মেয়ে একটু বড় হলে আবার কাজ শুরু করলাম। এখন লুজলি কাপলড টেকনোলজিস এর চিফ অপারেটিং অফিসার হিসাবে কাজ করছি। কাজের সূত্রে কিছুটা শেয়ার হোল্ডিংও আছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অনেক বিখ্যাত নামি দামি কোম্পানিকে (যেমন বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ, মাইন্ড শেয়ার, ইউনিলিভার, স্ট্রাটাম রিজারভারসহ আরও অনেককে আমরা সার্ভিস দেই। আমার নিজের টিমে দেশি-বিদেশি অনেকেই কাজ করে- দেশে এবং বিদেশে।
লুজলি কাপলড টেকনোলজিসের আমি প্রথম সদস্য। যখন বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট সেন্টার শুরু হয় তখন থেকে আমার কাজ শুরু। আজকে আমি এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বের একজন।
এই পুরো সময়টা অনেকটা বিদ্যুতের ঝলকানির মত কেটে গেছে। দিন রাত কিভাবে গেছে অনেক সময় মনেও থাকেনি। কিন্তু সময়টা সুন্দর কেটেছে এবং কাটছে। আমার সি ই ও জুয়েল ভাই। কাজের অনেক স্বাধীনতা দেন। কিন্তু আমার চাওয়া ছিল ‘যাই করবো এক সাথে করবো। আমার কাজে উনার মতামত যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমার মতামতও আমি দিতে চাই’। চাওয়াটা একটু কঠিন মনে হলেও শেষ পর্যন্ত তা প্রতিষ্ঠান আর প্রতিষ্ঠানের সবার জন্যই ভালো হয়েছে বলে আমি করি।
আমাদের সফটঅয়্যার সার্ভিস প্লাটফর্ম ইজিএসিস্ট- ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল ট্রান্সফর্মেশনে সাহায্য করে। সহজ ভাষায় অনলাইনে বিক্রি করতে সাহায্য করি আমরা। এই সূত্রে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। প্রতি মাসে প্রায় শতাধিক নতুন নতুন ছোট প্রতিষ্ঠান আমাদের প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়। অনেক বড় বড় ব্র্যান্ড যেমন কে ক্রাফট, বিবিয়ানা, রঙ বাংলাদেশ, অরণ্যসহ আরও অনেকে আমাদের সঙ্গে কাজ করেন। এছাড়াও ‘দেশি ভালোবাসি’-এর সূত্রে এসএমই ফাউন্ডেশনের অনেক উদ্যোক্তারাও আছেন আমাদের সঙ্গে। অনেক নারী আর পুরুষ উদ্যোক্ততাদের সাথে কাজ করতে গিয়ে অনেক ধরণের অভিজ্ঞতা হয়েছে। মনে হয়েছে সব প্রতিষ্ঠানে নারী আর পুরুষ নেতৃত্বের একটা ভারসাম্য থাকা খুব জরুরি।
আমরা কোনো মার্কেটপ্লেস না। কাজেই আমাদের সাথে আসলেই প্রচুর বিক্রি হবে না। আমাজন বা আলিবাবার মত আমরা চাই না ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলতে। আমেরিকার মত আমাদের দেশেও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাক প্রযুক্তিনির্ভর মার্কেটপ্লেসগুলোর কাছে তা আমরা একদমই চাই না। তাই আমরা ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলতে চাই। কাজটা করতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে অনেক পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়েছে, অনেক কিছু ছেলেদের বোঝানো বেশ কঠিন আবার অনেক কিছু ছেলেদের জন্য করাটা খুবই সহজ। অনেক কিছু আছে যা মেয়েরা খুব ভালো করতে পারে আবার অনেক কিছু আছে মেয়েদের জন্য কঠিন। কিন্তু ছেলে-মেয়ে মিলে একটা সুন্দর দল হলে সবই খুব সাবলীলভাবে সম্পন্ন হতে পারে।
আমাদের লুজলি কাপলডের কথা যদি বলি, আমাদের সিইও জুয়েল ভাই সবসময় আমাদের আরও ভালো করতে বলেন। উনি সবসময় নিজের লিমিট ক্রস করার কথা বলেন। চাইলেই পারবেন- পারাটা আপনার ইচ্ছা। উনার জন্য অনেকটা তাই। উনি সবসময় মোহাম্মদ আলী (বক্সিং প্লেয়ার) এর একটা গল্প বলেন। কেউ একজন মোহাম্মদ আলীকে জিজ্ঞেস করেছিল দিনে কয়টা সিট্ আপ দেন উনি। উত্তর ছিল ‘ব্যাথা শুরু হওয়ার পর ২০০ কারণ ব্যথা শুরুর আগেরগুলো গুণে লাভ নেই’। কিন্তু সবাই তো ব্যথা শুরুর পর ২০০ সিট্ আপ দিতে পারবে না, আবার প্রতিষ্ঠানে সবাইকে মোহাম্মদ আলী হবারও দরকার নেই। এখানে আমার ভূমিকা। যার যা সামর্থ্য তাকে সেই অনুযায়ী উৎসাহ, বকা বা ট্রেনিং দিয়ে একসাথে নিয়ে আগানো। অনেক কিছু আছে যেগুলো অনেক কঠিন নয়। সেই ধরণের কাজই বেশি আর সেগুলোই সব কিছুকে সুন্দর করে। হোমমেকার হিসাবে আমার চোখে সেগুলো অনেক বেশি পড়ে। তাই আমি সেগুলো অনেক ভালোভাবে গুছিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।
সবাই আমরা হাই পারফর্মিং প্রতিষ্ঠান চাই। তারমানে যার পারফরমেন্স ভালো না, তাকে বাদ দিয়ে দিতে হবে। করোনার সময় এই বিষয়ে অনেক চাপ ছিলো। নিজের বাচ্চা খারাপ ফলাফল করলে তো বাসা থেকে বের করে দেই না আমরা অথবা টাকার টানাটানি হলে তো কম নাম্বার পাওয়া বাচ্চাকে কম খেতে দেই না। কাজেই অফিসের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম কেন হবে। সবাই মিলে কষ্ট করে কয়দিন চলে একটু বেশি কাজ করে অবস্থার পরিবর্তন করার চেষ্টা করাটাই ভালো। শক্ত পুরুষ মানুষের এমনভাবে অন্য সবার কাছে সাহায্য চাওয়া অনেক সময়ই সহজ নয়। অনেক সময় ছোটখাটো এই ব্যাপারগুলো উপর থেকে দেখাটাও কঠিন। কয়েকজন না সবাই এইসব কঠিন প্রশ্নের কোন সহজ বা সঠিক উত্তর নেই। কিন্তু সিদ্ধান্তের সময় এই বিষয়গুলো সামনে আনাটা এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়াটা তো সম্ভব।
নেতৃত্বের জায়গাটাকে আমার কখনই প্রতিযোগিতার মনে হয় না। মেয়ে হিসাবে নেতৃত্বে আমার ভূমিকা অনেক। আমার সবসময় মনে হয় সেই ভূমিকা যদি আমি রাখতে পারি তাহলে আমার প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি সুন্দর হবে। নারী এবং পুরুষ উভয়ে মিলে যদি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দেওয়া যায়, তাহলে আমাদের কাজের জায়গা আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হবে। সবাই অনেক খুশি মনে আগ্রহ নিয়ে কাজ করবে। প্রতিদিন সকালে উঠে অফিসে আসতে ভালো লাগবে। আর সবাই খুশি মনে কাজ করলে ফলাফল ভালো হতে বাধ্য।
সারাবাংলা/আরএফ/
আন্তর্জাতিক নারী দিবস আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০১৯ লুজলি কাপলড টেকনোলজিস সৈয়দা নওশাদ জাহান প্রমী