Sunday 20 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে আমি আদর্শ নারী নই


৮ মার্চ ২০২১ ১৭:২৬

হঠাৎ করেই বদলে গেলেন আজমেরী হক বাঁধন। যেন খোলসের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো রঙিন এক প্রজাপতি। ছিলেন নিভৃতচারিনী। এখন রীতিমতো প্রতিবাদী। ২০০৬ সালে লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় রানার আপ হয়ে শোবিজ জগতে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই অভিনেত্রীর। এরপর টিভিসি, নাটক-টেলিছবিতে অভিনয় করে দিনে দিনে তিনি জনপ্রিয় অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কাজ ছাড়া কখনোই কোন আলোচনায় ছিলেন না। কিন্তু এখন সমাজের অসঙ্গতি দেখলেই তিনি সরব। কীভাবে তার এই পরিবর্তন? সেই গল্পটিই উঠে এলো সারাবাংলার স্পেশাল করেস্পন্ডেন্ট আশীষ সেনগুপ্তের সঙ্গে কথোপকথনে।

বিজ্ঞাপন

ফিরে যাই কিছুটা পেছনে…

২০১০ সালে পূর্ব পরিচিত মাশরুর সিদ্দিকী সনেটকে বিয়ে করেন অভিনেত্রী বাঁধন। সেই বছরই জন্ম নেয় তাদের একমাত্র সন্তান মিশেল আমানী সায়রা। বিয়ের চারবছরের মাথায় দাম্পত্য প্রতিকূলতার মুখে আলাদা হয়ে যান এই দম্পতি। ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ডিভোর্স হয় তাদের। দীর্ঘদিন গোপন থাকার পর সেই খবর প্রকাশ্যে আসে ২০১৭ সালে। ডিভোর্সের পর একমাত্র মেয়ে সায়রাকে নিয়ে জটিল হয় পরিস্থিতি। সেসব পরিস্থিতি সামাল দিতে দিতেই যেন লড়াকু হয়ে ওঠেন বাঁধন। সংসার জীবনের একের পর এক ঘটনা প্রবাহেই আজকের এই অবস্থানে অভিনেত্রী বাঁধন। সারাবাংলাকে জানালেন তার সেই বিচিত্র ও বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা—

‘জীবনের ৩৪টা বছর নষ্ট করেছি একটা ভ্রান্তির মধ্যে। আর ভ্রান্তির মূলে আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থা। আমি সমাজের ছকে বাঁধা একজন আদর্শ নারীই হতে চেয়েছি। কারণ, ছোট থেকে আমাকে তাই শেখানো হয়েছিলো। আর এই শিক্ষাটা যেমন আমাকে আমার পরিবার দিয়েছে, তেমনি আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রও সেই চেষ্টাই চালিয়েছে। আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থা পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক। আর সেই পুরুষতান্ত্রিকতাই আমাকে শিখিয়েছে, আমি যেন সমাজের ছকে বাঁধা আদর্শ নারী হই। আর যদি সেটা হতে না পারি, তাহলে আমি ব্যর্থ এবং আমার মৃত্যুই অনিবার্য। এছাড়া মুক্তির আর কোন পথ নাই।’

‘এতোটা দিন এই শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলাম। আর এই শিক্ষাটা কিন্তু আমাদের জন্ম থেকেই শুরু হয়। এটা যে হঠাৎ করে হয়েছে তা না। প্রত্যেকটা মেয়েকেই এই বেড়াজালের মধ্য দিয়েই বড় হতে হয়। ভাবুন, আমি বুঝতেই পারলাম না আমার স্বাধীনতা কি! আমার অধিকার কি! আমি জানতেই পারলাম না যে, আমিও একজন মানুষ। জীবন থেকে ৩৪টা বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর আমি এই সত্যটা উপলব্ধি করতে পারলাম।’

বিজ্ঞাপন

সমাজের বাঁধা ছকে চলার চেয়েও নিজের ভালো চাওয়া যে অন্যায় নয়, এই উপলব্দির জন্ম কীভাবে জানতে চাইলে বাঁধন বলেন, ‘৩৪ বছর পেরিয়ে এসে আমি যখন আমার সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা, তখন আমার মেয়েটার বয়স ছয়। তার জন্মদাতা বাবা কখনোই কোন যোগাযোগ রাখেন নাই। মেয়েটার কথা ভেবে আমি নিজে উদ্যোগী হয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। এমন কি আমি আমার ডিভোর্সের কথাও কাউকে বলতে পারিনি। প্রতিনিয়তই অত্যাচারিত হওয়া সত্বেও তাকে আমার হুজুর হুজুর করে চলতে হয়েছে। সে আমাকে পারিবারিক, সামাজিক এবং মানসিকভাবে একের পর এক নির্যাতন করে গেছে- সব সহ্য করে গেছি। কারণ, আমার সেই শিক্ষা। আমি জেনে এসেছি যে, সহ্য করে যাওয়াটাই হচ্ছে একজন আদর্শ নারীর কাজ। সব মেনে না নিলে আমি একজন ভালো নারী হতে পারবোনা। আমি তিনটি বছর কাউকে বলতে পারিনি যে, আমার ডিভোর্স হয়েছে। কারন এ সমাজ আমাকে আর আমার মেয়েকে কোন দৃষ্টিতে দেখবে এই ভয়ে। স্কুলে তাকে কোন অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে সেই চিন্তায়। আমার বাপের বাড়ির মানুষগুলোকেও বিব্রত করতে চাইনি। এই সবকিছু মিলিয়ে আমাকে নিরব হয়ে থাকতে হয়েছিল। তার (আমার স্বামীর) প্রতিটা কাজ আমাকে মেনে নিতে হয়েছে।’

‘এভাবেই চলছিল। কিন্তু সে আমাকে শুধু হেনস্তা করেই ক্ষান্ত হয়নি, হাত বাড়ালো আমার মেয়ের দিকে, তাকে ছিনিয়ে নিতে চাইলো আমার কাছ থেকে- আমি আর মেনে নিতে পারলাম না। সে আবার বিয়ে করেছে। বিয়ের কয়েকদিন পরই সে এবং তার নতুন স্ত্রী মিলে আমাকে সিদ্ধান্ত জানায় যে, তারা আমার বাচ্চাটাকে নিয়ে তাদের কাছে রাখবে। তারা যে এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে, সেখানে আমার মতামতের কোন তোয়াক্কাই করেনি। তারা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে যে, এটা মেয়ের বাবার সিদ্ধান্ত। আর আমাকে সেটা মেনে নিতেই হবে। বিষয়টা আমাকে আঘাত করলো। এমন একটা সিদ্ধান্ত, কিন্তু তারা আমাকে একবার জিজ্ঞাসাও করলো না! আমার মেয়ে, আমিই তাকে গর্ভে ধারণ করেছি, যাবতীয় প্রতিকূলতার মধ্যেও তাকে বড় করছি, আর তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে অন্যরা। এবং এরপর আরও দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই বিষয়টা নিয়ে আমি আইনজীবী, থানা থেকে শুরু করে যেখানেই গেছি, সবারই এক কথা- সন্তানের ব্যাপারে বাবাই সিদ্ধান্ত নেবে।’

‘এই একটা ধাক্কাই আমার বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিল। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এতোটা বছর তাহলে কী করলাম? দিনের পর দিন সমাজের চোখে আদর্শ নারী হওয়ার বাসনা আমাকে এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন করলো। সমাজ আমাকে এমন একটা জায়গায় দাঁড় করালো যেখানে আমি জানিই না আমার অধিকার কি! আমাকে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর দিনের পর দিন আমি সেটা সাদরে গ্রহণ করেছি। আমি প্রতিনিয়তই তাকে সমীহ করে গিয়েছি বলেই সে এতোটা সাহস পেয়েছে। যার ফলে সে আমার সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজনই মনে করে নাই। আমি মনে করি, এটা আমার প্রতিবাদ করতে না পারার শাস্তি। আমি চেষ্টা করলাম ঘুরে দাঁড়ানোর। একপ্রকার ছিনিয়ে নেওয়ার মতো করেই আমি আমার মেয়ের অভিভাবকত্ব পেয়েছি। এবং এটা সম্ভব হয়েছে পারিবারিক আদালতের দেওয়া রায়ের কল্যাণে। যেটা খুবই নজিরবিহীন।’

সারাবাংলা: একজন মা হয়ে সন্তানের অভিভাবকত্ব পাওয়ার জন্য এই লড়াই আপনাকে বদলে দিয়েছে। আপনার মতো সফল নারীকেই যদি এতোটা ভুক্তোভোগী হতে হয়, সমাজের অন্যান্য নারীদের পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা অনুমেয় —

আজমেরী হক বাঁধন: আসলে আমরা নারীরা বুঝতেই পারছিনা যে, আমরা কত কিছু থেকে বঞ্চিত। এই বুঝতে না দেওয়াটাও কিন্তু একপ্রকার ষড়যন্ত্র। আর এই ষড়যন্ত্রটা এতোটাই পরিকল্পিত যে, আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় আজকে যে মেয়েটা নিজের অধিকার নিয়ে বা অন্যের অধিকার নিয়ে কথা বলছে, তাকে আবার টেনে ধরে রাখার জন্য অন্য আরও দশটা মেয়েকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এবং তারা মেয়েটারই আপনজন, যারা আপন সেজে মেয়েটাকে টেনে-হিঁচড়ে নিচে নামানোর চেষ্টা চালিয়ে যাবে। আমার বেলাতেও যেমন তা ঘটেছে, অন্যান্য অধিকাংশ মেয়েকেও এসব সহ্য করতে হয়। আপনজনদের প্রধান চাওয়া- আমি, আমরা যেন চুপ থাকি, বোবা হয়ে থাকি। আমার ক্ষেত্রে তাদের কথা, আমি তো মেয়ের অভিভাবকত্ব পেয়েছি, আর কি চাই!

সারাবাংলা: এসব মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি কীভাবে পান?

আজমেরী হক বাঁধন: আমার বোধই আমার শক্তি। আমি প্রতিবাদ করেছি এবং করবো। কারণ এটা আমার অধিকার। আমার স্বাধীনতা আমার অধিকার। একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও কেন আমি পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধা থাকবো। আমাকে আমার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত শৃঙ্খলিত করে রাখা হচ্ছে। আমি যখন বুঝতে পারলাম যে, আমার সঙ্গে কত কী ঘটছে! বিশেষ করে যখন বুঝতে পারলাম, এসবের কারণে আমার মেয়েকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। সে দেখবে, তার মা একজন পরাজিত নারী! তার মানে সে এটা জেনেই বড় হবে যে, মেয়ে মানেই একজন পরাজিত নারী, একজন শৃঙ্খলিত নারী!— এই ভাবনাটা আমাকে অনেক বেশি নাড়া দিয়েছে। আমি সিদ্ধান্ত নিই, আমি আমার মেয়ের কাছে হেরে যাবোনা। আমি তাকে শেখাব না যে, নারী মানেই হেরে যাওয়া, নারী মানেই সবকিছু মেনে নেওয়া। যার ফলে গত তিন বছর ধরে আমার যে পরিবর্তনটা, সেটা একের পর এক ধাক্কা খাওয়ার কারনেই। নিজের জন্য, মেয়ের জন্যই আমি লড়াই করার শক্তি পাই।

সারাবাংলা: বর্তমানে নারী নির্যাতন বেড়েছে অনেক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সবখানেই নারীদের হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়। এব্যাপারে আপনি কি মনে করেন?

আজমেরী হক বাঁধন: ইদানীং যা ঘটছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব ঘটনা দেখছি, সমাজের এই অসংগতিগুলো নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। মনে প্রশ্ন জাগে কেন এতো শ্রেণী বৈষম্য থাকবে? কেন একজন মানুষ আরেকজনের অধিকার হরন করবেন? কেন আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবেনা? আমাদের প্রাপ্যগুলো কেন আমরা বুঝে পাবো না? এটা আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ হওয়া সত্বেও কেন আমরা নিরাপদ নই? স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা নাই! কেন নৃশংসতার শিকার হচ্ছি আমরা? এগুলো আমাকে এখন প্রতিনিয়তই ভাবায়।

সারাবাংলা: এই যে এসব অসঙ্গতির ভাবনা আপনাকে পীড়া দেয়। এর থেকে উত্তরণের চিন্তাও নিশ্চয় আসে —

আজমেরী হক বাঁধন: আমার যুদ্ধটা যেমন সমাজের সঙ্গে, তেমনি নিজের সঙ্গেও। বিশেষ করে নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধটাই সবচেয়ে কঠিন। কারণ আমিও এতোদিন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার একজন ধারক ছিলাম। ৩৪টা বছর ধরে এটা বহন করেছি। আর হঠাৎ করে এখান থেকে বেরিয়ে আসাটা সবচেয়ে কঠিন। তাই আমার মতো পরিস্থিতিতে যারা আছেন, তাদের বলতে চাই- আগে নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধটাতে জয়ী হতে হবে। নিজের ভেতরে আটকে থাকা শেকলগুলো থেকে আগে মুক্ত হতে হবে। নিজের চিন্তা চেতনা থেকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাটাকে ধ্বংস করে দিতে হবে। তারপর অন্যকিছু করা সম্ভব। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধে জয়ী হতে পারলেই অন্য যুদ্ধ গুলোর মুখোমুখি হওয়াটা সহজ হবে।

সারাবাংলা: এই চিন্তা আসাটা কিন্তু সহজ নয়। আবার দিনের পর দিন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার মেয়েরাও সহজে মুখ খুলতে চান না। মেয়েরা কেন চুপ করে থাকে বলে আপনার মনে হয়?

আজমেরী হক বাঁধন: কেন মেয়েরা নিরবে এসব সহ্য করছে? তার কারণ, এই সমাজে মেয়েদের চুপ করে থাকাটাই যেন স্বাভাবিক। কথা বলা মানে মেয়েটা বেয়াদব, অসভ্য বা বদরাগী। আর এসব মেয়েদের সংসার হয় না বা টেকে না। প্রতি মুহুর্তেই আমাকে এই কথাগুলো শুনতে হয়েছে। এগুলো শুনে শুনেই আমাকে এগোতে হয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার শুধু মৃত্যুটাই বাকী ছিল। যদি আমি আত্মহত্যা করতাম বা আমার অপমৃত্যু হত, তাহলে হয়তো ব্যাপারটা আরও রসালো হতো। আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থায় পেত্নী, ডাইনী, শাঁকচুন্নি বা জুজুবুড়ী— সবই কিন্তু নারীদেরকেই বলা হয়। নারীরা এসবকেই ভয় পান। সমাজ নানা নামে ডাকবে, নানাভাবে হেয় করবে এই ভয়েই অনেকে কথা বলেন না। আমিও বলতাম না। কিন্তু এখন আমি বলি, যেহেতু আমি উপলব্ধি করেছি যে আমি সমাজের এসব পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের শিকার। তবে আজকের এই অবস্থানে আসতে আমাকে বিশাল এক প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। যার ফলে এখন আমার মধ্যে আর হারানোর ভয় নাই। তাই যা হয়েছে, যা ঘটেছে, তা আঙুল দিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিতে চাই। আমি চাইনা, আর কোন মেয়ে এসবের মুখোমুখি হয়ে পরাজিত হোক।

সারাবাংলা: নারীর জন্য লড়াইটা নিশ্চয়ই অনেক বেশি কঠিন?

আজমেরী হক বাঁধন: যখন কেউ বলে সবকিছু ঠিক আছে, তখন তাদের উপর আমার খুব ক্ষোভ হয়। কারন সে জানে না, একটা মেয়ে যখন থানায় যায়; কোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে, তাকে কত কি শুনতে হয়, কতো কিছুর মুখোমুখি হতে হয়। আমি একজন চিকিৎসক এবং অভিনেত্রী হয়েও, এতো পরিচিতি থাকা সত্বেও প্রতিনিয়ত বিব্রত হতে হয়েছে আমাকে। ভাবতেও পারিনি, এতোটা বীভৎসতা দেখতে হবে আমাকে। সেখানে সাধারন পরিবারে জন্ম নেওয়া যে মেয়েটা একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্যাতিত হচ্ছে, তার যে কি অবস্থা সেটা কল্পনাতেও আনা অসম্ভব। আর সেক্ষেত্রে প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাকে যে কি পরিমান হেনস্থা হতে হয়, অপমানিত হতে হয়, সেটা একমাত্র যে এগুলোর মুখোমুখি হয়েছে, সে-ই জানে। আমাকে তো এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই আসতে হয়েছে। তাই আমি চাই, আমার কথাগুলো জেনে যদি দুইটা মেয়েও সাহস করে প্রতিবাদি হয়ে ওঠে, তাহলে ক্ষতি কি। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হয়তো আমার উপর ক্ষেপবে, তাতে কি? যদি জীবন নিয়ে সংশয় হয়- হোক না। আমার তো এখন কোন চাওয়া-পাওয়া নেই। এমন কোন প্রত্যাশাও নেই যে, এসব কথা বলার দায়ে আমার অনেক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। নিজে যেমন মুক্তি চাই, তেমনি অন্যদেরও মুক্তির পথ দেখাতে।

সারাবাংলা: আবারও আসি আপনার জীবনের গল্পে। একজন সিঙ্গেল মাদার হিসেবে মেয়েকে মানুষ করতে কোনধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়েছে কি?

আজমেরী হক বাঁধন: আমার মেয়েটাকে আমি ভ্রান্তির মধ্যে বড় করতে চাই না, আমি চাই সে বাস্তবতার মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠুক। প্রতিটা ক্ষেত্রে নিজের চাহিদাগুলো কমিয়ে চেষ্টা করছি মেয়েটাকে একজন সত্যিকার ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার। করোনাকালিন দুঃসময়ে ওকে বলেছিলাম, আর্থিক অনটনের কারণে যদি ওর স্কুল বদলাতে হয়, সে যেন মনে কষ্ট না নেয়। পৃথিবীতে মানুষ সবসময় একই অবস্থার মধ্য দিয়ে চলতে পারেনা। যখন যে পরিস্থিতি আসে, সেটাকে হাসিমুখে মেনে নিয়েই আমাদের সামনের দিকে এগোতে হবে। বাস্তবতা যতই কঠিন হোক না কেন, আমি চাই আমার মেয়ে যেন এর মধ্য দিয়েই বড় হয়। আমার মেয়েও সেটা নিতে পারছে। কারণ ও তো দেখছে যে ওর মা একা, সাহায্য করার কেউ নেই। মেয়েটা তার বাবাকে কখনোই পাশে পায়নি। সে জানতেও পারেনি একটা সংসারে বাবার ভূমিকা কি।

সারাবাংলা: কিন্তু আপনার সঙ্গে আপনার সঙ্গির ছাড়াছাড়ি হয়েছে। সন্তানের সঙ্গে বাবার তো নয়। তবুও আপনার সন্তান বাবার কোনধরনের সম্পৃক্ততা ছাড়া বড় হচ্ছে। এটি কেন?

আজমেরী হক বাঁধন: আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ডিভোর্স ব্যাপারটা খুবই বেদনাদায়ক। সবচেয়ে কাছের মানুষটাই সবচেয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে কিন্তু তা নয়। ডিভোর্স হচ্ছে, কিন্তু বাবা-মা সন্তানকে সময় দিচ্ছে। সন্তানের ব্যাপারে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কিন্তু, আমাদের এখানে সেটা হচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাবারা তাদের ইগো নিয়ে ব্যস্ত। আমি মেয়ের কথা চিন্তা করে ওর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চেয়েছিলাম। যাতে ওর মানসিক বৃদ্ধিটা সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমার মেয়ে সেটা পায়নি। ওর বাবা কোনরকম সহযোগিতাই করেননি। এমন কি ভরণপোষণ দেয়া তো দূরে থাক, কোন খোঁজখবরও কখনো নেয় নি। আদালত থেকেও তাকে বলা হয়েছিল যে, চাইলে মাসে দুইদিন মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। কিন্তু উনি সেটা করেননি। কারণ উনি আমার বাসায় এসে আমার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে চান না। মেয়ের কথা ভেবে আমি এমনটাও বলেছিলাম যে, প্রয়োজনে মেয়েকে নিয়ে আমি বাইরে দেখা করাবো। কিন্তু এটাতেও উনি রাজি না। ভরণপোষণ না দেয়ার ব্যাপারটা না হয় ধরে নিলাম যে, উনি আর্থিক সংকটে আছেন। তাই দিতে পারছেন না। কিন্তু কথা তো বলতে পারেন! উনি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলারও প্রয়োজন বোধ করেন না। পুরো ব্যাপারটাই আসলে ওনার ইগো সমস্যা, একেবারে হীনমন্যতা ছাড়া আর কিছুই না।

সারাবাংলা: আপনার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আছেন যারা এমন নারীদের জন্য কোন পরামর্শ —

আজমেরী হক বাঁধন: আমাকে যদি অনেক আগে থেকেই কেউ সাহস দিত, তাহলে হয়ত এই দুর্বিসহ দিনগুলো আমাকে দেখতে হতোনা। আরো অনেক বছর আগেই দৃঢ়তার সাথে ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম। প্রতিনিয়ত ভয় পেতে পেতে আমি নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিলাম। আজকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এই শৃঙ্খল বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশের মেয়েরা এভারেস্ট জয় করছে, ক্রিকেট-ফুটবল খেলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পদক নিয়ে আসছে। কিন্তু প্রতি মুহুর্তে তাদেরকে বাঁধ ভেঙে এগোতে হচ্ছে। কিন্তু কেন? আমাকে কেন শৃঙ্খল ভেঙে সামনে আসতে হবে? আমার বাঁধা কেন থাকবে? আমার যা ভালো লাগে আমি তাই করবো। এটাই তো নিয়ম। কিন্তু এই নিয়ম কোথায়? একটা সমাজে একজন নারী ও একজন পুরুষের সমান অধিকার। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তা নেই।

সারাবাংলা: জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষা—

আজমেরী হক বাঁধন: ১৫ বছর অর্থাৎ ২০০৬ সাল থেকে কাজ করছি। ২০১৭ সাল পর্যন্ত যা কাজ করেছি, তা এমনি এমনিই বলা যায়। আমার মধ্যে একটা দ্বন্দ ছিল, আমি যে কাজটা করছি সেটার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু। এখানেও সেই সমাজ ব্যবস্থা। আমাদের পরিবার বা সমাজে এই কাজের গ্রহনযোগ্যতা নাই বললেই চলে। তাদের চোখে অভিনয়, নাচ, গান- এগুলো পাপ কাজ। যার ফলে ২০১০ সালে বিয়ে করে যখন সংসারী হলাম, তখন ঘোষণা দিয়ে সব কাজ ছেড়ে দিলাম। যেহেতু এই কাজটাকে মানুষ স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছেনা, তাই এ কাজ না করে পুরোপুরি সংসারে মনোযোগী হওয়াটাই উত্তম। আমি এই আশায় ঘর বাঁধলাম। কিন্তু প্রত্যাশার কিছুই হলোনা। আমাকে আবার কাজে ফিরে আসতে হলো। একটা দুধের বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে শুটিংয়ে যেতাম। এবং সেটা নিতান্তই পেটের দায়ে। কাজ করতে ভালো লাগতো না, তারপরও করে গেছি। একপর্যায়ে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আমাকে বললেন যে, কাজটাকে ভালোবাসতে পারছিনা বলেই কাজে মন বসাতে পারছিনা। তখন আমি বুঝতে পারলাম, ২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আমি শুধু ভুল করেই গেছি। আমি কাজে মনোযোগী হলাম। সবাইকে বললাম, আমি মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করতে চাই। ভালো কাজ করতে চাই।

এর পরপরই আমি একটা সিনেমার কাজ পেলাম। ‘লাইফ ফ্রম ঢাকা’ খ্যাত আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ-এর পরবর্তি ছবি। যদিও ছবিটার নাম আপাতত জানানো হচ্ছে না। ছবিটা মূলত নারী প্রধান গল্প। এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে দেখি নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নৃশংসতাগুলোই যেন আমাকে তুলে ধরতে হচ্ছে। দেখলাম গল্পের সবকিছুই তো আমার সঙ্গে হয়েছে। আমরা সবাই সবার সাথে এগুলো করছি। দেড় বছর এই সিনেমাটার জন্য সময় দিয়েছি। ২০১৯-এ কাজটা শেষ হয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে এখনো মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি।

সারাবাংলা: শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজ আপনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। কেমন আছেন আপনি?

আজমেরী হক বাঁধন: আসলে কী জানেন, অধিকাংশ মানুষই যে ভুলটা করে সেটা হচ্ছে, সে নিজের অধিকার সম্পর্কে জানে না বলেই অন্যের অধিকারটাও হনন করার চেষ্টা করে। আমরা মনে করি যে, আমি যেটা করছি সেটা সঠিক। প্রত্যেকেরই যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে, সেটা আমরা বুঝতেই চাই না। আমাদের সমাজ আমাদের শেখায় যে, আমি যেটা বলছি সেটাই ঠিক। অপরজন যদি সেটা মানতে না চায়, তাহলে তাকে আঘাত করো। এতদিন তো এই ভ্রান্ত ধারনার মধ্যেই ছিলাম। সবকিছুতেই শুধু আশা রেখে চলতাম। এখন আর আশা বা প্রত্যাশার কোনটাই করি না। কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা বুঝতে শিখেছি। তাই বলতে পারি এখন আগের চাইতে বেশ ভালো আছি।

ছবি: বাঁধনের ফেসবুক পেইজ থেকে

আজমেরী হক বাঁধন আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০১৯ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ টপ নিউজ লাইফ ফ্রম ঢাকা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর