ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব—কীর্তিমান বাঙালি, কিংবদন্তী বিশ্বমানব
১৮ মার্চ ২০২১ ১৫:২১
ঈশ্বরচন্দ্র দেব পুরকায়স্থ ও শরৎ সুন্দরী দেবীর সন্তান গোবিন্দচন্দ্র দেব পুরকায়স্থ জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। বহুমুখী প্রতিভা, অসামান্য পাণ্ডিত্য এবং দর্শনশাস্ত্রে বৈপ্লবিক যুগের সূচনা করা এই মহামনিষীকে আমরা চিনি অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব বা জি সি দেব নামে। সদাহাস্যজ্জ্বল পরোপকারী এই কীর্তিমান বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের দর্শনশাস্ত্রে সৃষ্টি করে গেছেন নতুন ধারা। বাংলাদেশের আধুনিক দর্শনের পথিকৃৎ বিশ্ববরেণ্য এই মানবতাবাদী দার্শনিককে তার অবদানের জন্য প্রাচ্যের সক্রেটিস হিসেবে অভিহিত করা হয়।
খুব অল্প বয়সেই বাবাকে হারানোর পর প্রতিকূল অবস্থায় ভাইদের সঙ্গে দেবকেও পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়। স্কুল জীবনে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখা দেব ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় সংস্কৃত ও গণিতে লেটারসহ প্রথম বিভাগে এবং ১৯২৭ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে যুক্তিবিদ্যায় লেটারসহ প্রথম বিভাগে আই এ পাস করেন। একই কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর শেষ করেন তিনি। এরপর ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘রিজন, ইন্টিউশন অ্যান্ড রিয়েলিটি’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। অনুপম প্রতিভা এবং জ্ঞানার্জনের তৃষ্ণা তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় ভারতের তৎকালীন খ্যাতনামা সব দার্শনিকদের সঙ্গে, সেই সাথে অসামান্য ফলাফল অর্জন করায় কৃতি ছাত্র হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ‘বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণ পদক’ এবং ‘হেমচন্দ্র মুখার্জী রোপ্য পদক’-এ ভূষিত হন।
তার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল রিপন কলেজেই, ১৯৩১ সালে যোগদান করেন তিনি। ১৯৩৪ সালে মহারাষ্ট্রের অমলনারের বিশ্বখ্যাত দর্শন গবেষণা কেন্দ্রে উচ্চতর শিক্ষার জন্য যান, সেখান থেকে ফিরে ১৯৩৭ সালে আবারও রিপন কলেজে যোগ দেন। ১৯৩৯ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কলেজটি কলকাতা থেকে দিনাজপুরে স্থানান্তরিত হলে তিনি চলে আসেন। বিশ্বযুদ্ধ শেষে আবার ১৯৪৫ সালে কলেজটি কলকাতার স্থানান্তরের প্রয়োজন হলে তিনি সবার সহযোগিতায় কলেজটিকে এখানেই নতুন নামে প্রতিষ্ঠা করে অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রিপন কলেজের নাম হয় সুরেন্দ্রনাথ কলেজ। যা বর্তমানে দিনাজপুর সরকারি কলেজ নামে সুপরিচিত।
দেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন ১৯৫৩ সালে। পরবর্তী ১৮ বছরে ৭টা ইংরেজি, দু’টি বাংলা গ্রন্থ এবং শতাধিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেন তিনি। দর্শনশাস্ত্রে প্রাচ্যের ধ্যান-ধারণা এবং চিন্তায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনে দেবের গবেষণা। প্রাচ্য দর্শনের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের তুলনামূলক আলোচনা, দর্শনের ব্যবহারিক মূল্য, বিভিন্ন ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের তথা সমগ্র পৃথিবীর মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় দর্শন কী ভূমিকা পালন করতে পারে—এ ধরনের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান করেছিলেন দেব।
দেবের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট নয়টি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: আইডিয়ালিজম অ্যান্ড প্রগ্রেস (১৯৫২), আইডিয়ালিজম: এ নিউ ডিফেন্স অ্যান্ড এ নিউ এ্যাপলিকেশন (১৯৫৮), আমার জীবনদর্শন (১৩৬৭), এ্যাসপিরেশন অব দি কমন ম্যান (১৯৬৩), দি ফিলোসফি অব বিবেকানন্দ অ্যান্ড দি ফিউচার অব ম্যান (১৯৬৩), তত্ত্ববিদ্যাসার (১৯৬৬), বুদ্ধ: দি হিউম্যানিস্ট (১৯৬৯)। গ্রন্থগুলো তার জীবিতকালেই প্রকাশিত হয়। দি প্যারাবুলস অব দি ইস্ট (১৯৮৪) এবং মাই আমেরিকান এক্সপিরিয়েন্স (১৯৯৩) নামক গ্রন্থ দু’টি তার মরণোত্তর প্রকাশনা। এছাড়া দেশিবিদেশি পত্রিকায় ইংরেজি ও বাংলায় দেবের প্রায় শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
তার গ্রন্থসমূহ পাঠ করার সময় আলোচ্য বিষয় ও নানাবিধ তত্ত্ব-তথ্য-পর্যবেক্ষণ পড়তে পড়তে অবাক বিস্ময়ে ভাবতে হয়, দেব শুধু তখনকার সময়ের তুলনায় অগ্রসর চিন্তাশক্তির অধিকারীই ছিলেন না, তিনি তত্ত্বসর্বস্ব দর্শন আলোচনা থেকে বেরিয়ে এসে তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগের ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ তিনি মনে করতেন, তাত্ত্বিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণ সঠিক হলেও তা যদি ব্যবহারিক দিক দিয়ে শুভ না হয়, তাহলে তা মানবজীবনের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তাই তিনি তার দার্শনিক চিন্তাধারায় তত্ত্ব ও প্রয়োগের সমন্বয় সাধন করেছেন। উপমহাদেশে সমন্বয়ী দার্শনিক ধারার সার্থক প্রবর্তক তিনি। তার দর্শনের স্বাতন্ত্র্য এখানেই যে, তিনি ভাববাদকে সমন্বয়ী ভাববাদ হিসেবে উল্লেখ করে একে চিরায়ত ভাববাদ থেকে পৃথক করেছেন এবং একে প্রগতির ধারক ও বাহক বলে মনে করেছেন। যেটা এমনকি বর্তমান সময়ের আধুনিক চিন্তাধারার সাপেক্ষেও অভিনব এক সংযোজনা।
অবশ্য দেবের এই দুর্দান্ত চিন্তাশক্তির উন্মেষ ঘটেছিল শৈশবকাল থেকেই। এক পণ্ডিতের কাছে ভারতীয় ঐতিহ্যের বেদ-বেদান্ত-উপনিষদের পাঠ নেওয়ার পর ভারতীয় আধ্যাত্মবাদের প্রতি এক গভীর আগ্রহ গড়ে ওঠে তার। রামকৃষ্ণ মিশন ও খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় তিনি মানবপ্রেম ও মানবসেবার প্রতি গভীর দীক্ষা লাভ করেন। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের জ্ঞানসমুদ্রে অবগাহন করে আহরণ করেন বহুমুখী জ্ঞান ও চিন্তাধারা। পৃথিবীবিখ্যাত সকল দার্শনিক ও ধর্মপ্রচারকদের প্রচারিত ধর্ম ও বিভিন্ন সভ্যতার মানবকল্যাণকর শুভ দিকগুলো তিনি প্রচার করতে উদ্বুদ্ধ হন তত্ত্বসর্বস্ব দর্শন আলোচনার বাইরে সমন্বিত ব্যবহারিক রূপে।
শৈশব থেকে কৈশোর যুবা বয়স পর্যন্ত দেব নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন বিশ্বব্যবস্থা, দেখেছেন মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা ব্যর্থতা। এই সব কিছুকে দেব একটি সমন্বিত রূপ দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন তার চিন্তাধারায়। তাত্ত্বিক দর্শন দিয়ে তার দার্শনিক চিন্তাধারা শুরু হলেও তিনি তাতে আবদ্ধ থাকেননি—তিনি ফিরে এসেছেন নির্মম বাস্তবতায়। প্রত্যাশা করলেন এক সুখী, সুন্দর, কল্যাণকর, শান্তিময় জীবনব্যবস্থার। তিনি উপলব্ধি করলেন একদেশদর্শী কোনো মতাদর্শ তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে না। একটি সমন্বিত চিন্তাধারাই এর একটি কার্যকরী রূপ দিতে পারে। তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হল ‘সার্থক দর্শন মাত্রই জীবন দর্শন,’ বাকসর্বস্ব দর্শনের হবে সমাধি, পূর্ণমুক্তির দর্শনের হবে উজ্জীবন’। তাই দেব তার দর্শনে নিজ ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা, ভাববাদ, বস্তুবাদ, ধর্ম, বিজ্ঞানসহ প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের কল্যাণকর সব কিছুকে সমন্বয় করে একটি সমন্বয়মূলক জীবনদর্শন গড়ে তোলেন। একে বলে সমন্বয়ী দর্শন। ড. দেব ছিলেন এর প্রবক্তা।
দেব ছিলেন সকল প্রকার সংকীর্ণতা, অন্ধতা, গোঁড়ামি ও কুসংস্কারবিরোধী। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক। বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনা, ধ্যান-ধারণা ও প্রগতিতে দৃঢ় বিশ্বাসী। দেব আধুনিক বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করে ‘আগামী দিনের শিক্ষা-দর্শন’ প্রবন্ধে বলেন, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে বহির্দৃষ্টিসম্পন্ন, আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে। এই শিক্ষাব্যবস্থা অপূর্ণ, ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের পরিপন্থী। তাই আজ বিশ্বময় সংঘাত-দ্বন্দ্বময়, ধ্বংসমুখী জটিল অবস্থা বিদ্যমান। ফলশ্রুতিতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হচ্ছে বিঘ্নিত, মানুষ পালন করে চলছে জীবনদর্শনহীন নিষ্ফল কর্মজীবন। অথচ শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলা। তাই আজ ব্যক্তিকে এমনতরো শিক্ষা দেওয়া চাই, যাতে সে তার বৃহত্তম জীবনের সমঝোতা নিয়ে আসার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
মানবকল্যাণ এবং জ্ঞানের নতুন দুয়ার উন্মেষে আমৃত্যু সাধনা করে যাওয়া এই মহান দার্শনিক ছিলেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত এবং বহুল প্রশংসনীয় এক ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন দুই পাকিস্তানের ‘পাকিস্তান ফিলোসফিক্যাল কংগ্রেস’-এর সাধারণ সম্পাদক মনীষী গোবিন্দ চন্দ্র দেবের আন্তরিক প্রচেষ্টায় জীবনঘনিষ্ঠ ও মানবতাবাদী দর্শন প্রচারার্থে ১৯৬৪ সালে ঢাকায় স্থাপিত হয়েছিল ‘দর্শন ভবন’। দর্শনের দুর্লভ সব গ্রন্থের সমারোহে নানাবিধ আয়োজনে এটি উপমহাদেশের দর্শনশাস্ত্র চর্চায় যোগ করে অন্যরকম এক মাত্রা। পরবর্তীতে মামলা-মোকদ্দমার ফলে এটির বিলুপ্তি ঘটলেও এর অর্থ-সম্পদের প্রায় পুরোটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে যান তিনি। যা দিয়ে পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি যুক্তরাজ্যের ‘দি ইউনিয়ন অব দ্যা স্টাডি অব জেনারেল রিলিজিয়নস’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফিলসফি অব সায়েন্স’-এর সদস্য নির্বাচিত হন।
ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়ে ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গমন করেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভ্যানিয়ায় উইল্কস-বারে কলেজে এবং নিয়মিত অধ্যাপনা ছাড়া ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন দর্শনসহ বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয় তথা মানবিক বিষয়ে। প্রাচ্য দর্শনের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের তুলনামূলক আলোচনা, দর্শনের ব্যবহারিক মূল্য, বিভিন্ন ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের তথা সমগ্র পৃথিবীর মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় দর্শন কী ভূমিকা পালন করতে পারে—এ ধরনের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পাঠ ও ভাষণ দেন অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব। উইল্কস বারে কলেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আয়োজিত এবং বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত এসব ভাষণ শোনার জন্য উপস্থিত হতেন কলেজের ছাত্র-শিক্ষক ছাড়াও দর্শন অনুরাগী অনেক দর্শক-শ্রোতা।
দর্শনশাস্ত্রে তার পাণ্ডিত্য এবং নতুন পথের আলোকবর্তিকা হিসেবে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গোবিন্দ দেবের প্রচারিত মানবতাবাদী দর্শনকে আরও ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ১৯৬৭ সালের ২৬ মে যুক্তরাষ্ট্রে স্থাপিত হয়—দ্য গোবিন্দ দেব ফাউন্ডেশন ফর ওয়ার্ল্ড ব্রাদারহুড। এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতির আমন্ত্রণেই ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে তিনি পুনরায় চলে যান উইল্কস বারে কলেজে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে। পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষিত সমাজের ‘দর্শন সাগর’ উপাধি (১৯৬১), একুশে পদক (১৯৮৫, মরণোত্তর) ও স্বাধীনতা পুরস্কার (২০০৮, মরণোত্তর) আফসোস, এমন অসামান্য মনীষীকে আমরা হারিয়ে ফেলি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চালানো জেনোসাইডে।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে অপারেশন সার্চলাইট কোডনেইমে পৈশাচিক গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোয়াটারে তারা বীভৎস গণহত্যা চালায়। ড. জি সি দেবের পালিত কন্যা রোকেয়া বেগম আর তার স্বামী তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসাতেই থাকতেন। ২৫ মার্চ দিবাগত সারারাত ধরেই তার বাড়ির উপর গুলিবর্ষণ চলতে থাকে পাকিস্তানিদের। সারা রাত প্রচণ্ড আতঙ্কে কম্পমান দেবের পরিবার ভোরের দিকে মুখোমুখি হয় দুঃস্বপ্নের মতো নির্মমতার। দেব তার মেয়েকে বলেছিলেন, ‘মা তুমি একটু চা কর। আমি ততক্ষণে ভগবানের একটু নাম করি’।
ঠিক সে সময় দরজা ভেঙে পাকিস্তানি সেনারা বাসায় ঢুকে। ‘কাঁহা মালাউন কাঁহা’ বলে তারা প্রফেসর দেবকে খোঁজ করে। পালিত কন্যা রোকেয়া বেগমের স্বামী গোবিন্দ চন্দ্র দেবকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন এবং সৈন্যদের মন গলানোর জন্য কালেমা পড়েন। কিন্তু এতে কাজ হয়নি। ড. দেব নিজেও দুই হাত ওপরে তুলে ‘গুড সেন্স গুড সেন্স’ বলে তাদের নিবৃত্ত করতে চেয়েছিলেন। সারাজীবন জ্ঞানসাধন করা একজন মনীষী এর চেয়ে বেশি আর কি-ই বা করতে পারতেন! কিন্তু যাদের উদ্দেশ্যে বিবেকবোধ জাগানোর তার এই আকুল আহ্বান, তারা ছিল একেকটি নরপিশাচ। হাত কয়েক ব্যবধানে থেকে সেনাসদস্যরা ব্রাশফায়ার করে গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও রোকেয়া বেগমের স্বামীকে হত্যা করে। রোকেয়া বেগম আকস্মিক আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডে অচেতন হয়ে পড়ায় বেঁচে যান। ২৬ মার্চ বিকেলে জগন্নাথ হলের পশ্চিম পাশ (যেখানে তার লাশ ফেলে রাখা হয় ) ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর গর্ত খুঁড়ে মাটি চাঁপা দেওয়া হয় হলের প্রভোস্ট ড. দেবসহ অন্যদের লাশ। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রথিতযশা মনীষী, সাধক, দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের কর্মময় জীবন প্রদীপ এক মুহূর্তে নিভে যায়, বড্ড অসময়ে!
শহিদ বুদ্ধিজীবী দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের কর্মযজ্ঞের প্রায় পুরোটাই স্রেফ একাডেমিক পাঠদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে আজও। অথচ বর্তমান বিশ্বের অস্থির সময়ে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ কলেবরে দেবের অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী ও সমন্বয়ধর্মী বিশ্বজনীন চিন্তা সমগ্রের বহুল প্রচার ও চর্চা একান্ত জরুরি। কিন্তু তার জন্য সবার আগে আমাদের নতুন প্রজন্মের সন্তানদের আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, জানতে হবে এই জমিনের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন গোবিন্দ চন্দ্র দেবের কর্মময় জীবন ও তার কীর্তি সম্পর্কে। শুধু প্রচারের জন্যই নয়, এমন অসামান্য একজন কিংবদন্তী আমাদেরই একজন ছিলেন, ভেবেছেন ও কল্যাণ করে গেছেন বিশ্ব মানবের কল্যাণ নিয়ে, শুধু এইটুকু অনুপম গর্বই নতুন দিনের পৃথিবী গড়ার প্রচেষ্টায় যথাসাধ্য অবদান রাখতে প্রবল অনুপ্রেরণাও যোগাতে পারে!