অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আর একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর মুখোমুখি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সমান শক্তি বা ক্ষমতা প্রয়োজন। কিন্তু ইতিহাসের নানা বাঁকে মাঝে মাঝে আমাদের পরিচয় ঘটে এমন সব অবিশ্বাস্য মুহূর্তের সাথে, যখন লাঠিবল্লম, দা ইত্যাদি হাতের কাছে পাওয়া যৎসামান্য অস্ত্র হাতে হাজারো মুক্তিকামী জনগণ অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয় স্রেফ বুকভরা অকুতোভয় সাহস সম্বল করে। এবং প্রাণ বাজি রেখে লড়ে অসম এক যুদ্ধ। বলছি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত লড়াই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের গল্প। জয়দেবপুরের হাজারো সংগ্রামী মুক্তিপাগল শোষিত নিপীড়িত জনতা সেদিন স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যমে অসামান্য দুঃসাহসে রুখে দাঁড়িয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের আদেশ পালনে আক্ষরিক অর্থেই হাতের কাছে যা পেয়েছিল তা নিয়েই শত্রুর মোকাবেলায় বুক চিতিয়ে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল।
একাত্তরের উত্তাল মার্চের ১ তারিখ দুপুরে যখন পাকিস্তানের সামরিক সরকারের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিল, তখনই বাঙালি জাতি বুঝতে পেরেছিল নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও বাঙালির দল আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। সেজন্যই সংসদ অধিবেশন স্থগিত করেছে ইয়াহিয়া। মুহূর্তেই যেন অগ্নুৎপাত হয়েছিল সারাদেশে, বিক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় নেমে এসেছিল প্রচণ্ড বিক্ষোভে। দেশের সর্বত্রই স্লোগান ওঠে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি-বাঙালি’। বঙ্গবন্ধু ঢাকায় পূর্বাণী হোটেলে এক সভায় ইয়াহিয়ার ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং ঢাকায় ২ মার্চ ও সারা বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ৩ মার্চ হরতাল আহ্বান করেন এবং ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা আহ্বান করেন।
ঢাকায় যখন পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে দ্রুত, ঠিক তখন ঢাকার ঠিক পাশে জয়দেবপুর মহকুমায় (বর্তমানের গাজীপুর) সংগ্রামী জনতা ও নেতৃবৃন্দ সংগঠিত হচ্ছিলেন। মার্চের ২ তারিখে মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিব উল্লাহ’র ডাকে এক সভায় গাজীপুর মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আ ক ম মোজাম্মেল হককে (বর্তমান মুক্তিযোদ্ধামন্ত্রী) আহ্বায়ক ও মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির শ্রমিকনেতা নজরুল ইসলাম খানকে কোষাধ্যক্ষ করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট এক সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আমাদের এই ইতিহাসে এই সংগ্রাম পরিষদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মাত্র ক’দিনের মধ্যেই এই ১১ জনের নেতৃত্বে জয়দেবপুরের বীর বাঙালি ঘটাবে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস।
পরিষদ মার্চের ৩ তারিখে গাজীপুর স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশের বটতলায় এক বিশাল সমাবেশে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে লাল সবুজ পতাকা উত্তোলন করে। পতাকা ধরেছিলেন হারুন ভূঁইয়া এবং অগ্নিসংযোগ করেছিলেন শহীদউল্ল্যাহ বাচ্চু। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ জয়দেবপুর থেকে ট্রেনে করে এবং শতাধিক ট্রাক ও বাসে করে মাথায় লাল ফিতা বেঁধে ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) বঙ্গবন্ধুর ডাকা জনসভায় যোগ দিতে যায়। সে এক অভাবিত দৃশ্য। ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ জনতা ১১ মার্চ গাজীপুর সমরাস্ত্র কারখানায় বিক্ষোভ ও পাকিস্তানি দখলমুক্ত করার চেষ্টা চালায়। পাকিস্তানি সেনাদের সশস্ত্র বাঁধার মুখে ফ্যাক্টরির গেইটের সামনেই বিক্ষোভ সমাবেশে ছাত্রলীগ নেতা আ ক ম মোজাম্মেল হক হাজারো জনতার সামনে এক অসাধারণ বক্তব্য রাখেন। ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্যে সরাসরি বলেন, ‘I do hereby dismiss Brigadier Karimullah from the directorship of Pakistan Ordnance Factory and do hereby appoint Administrative officer Mr. Abdul Qader (বাঙালি) as the director of the ordnance Factory’.
তার এই ঘোষণা এবং সংগ্রামী জনতার বিক্ষুব্ধ আন্দোলনে জাদুমন্ত্রের মতো কাজ হয়। পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার করিমউল্লাহ এতোটাই ভয় পেয়েছিল যে, সে সমরাস্ত্র কারখানার পেছনের গেট দিয়ে সালনা হয়ে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে। এবং তার ভয় এতোটাই গভীর ছিল যে ১৫ এপ্রিলের আগ পর্যন্ত সে আর গাজীপুরে যাওয়ার সাহস পায়নি। সমরাস্ত্র কারখানা ২৭ মার্চ পর্যন্ত সংগ্রাম পরিষদ ও জনগণের দখলেই ছিল। এরপর মার্চের ১৩ তারিখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি সাহেবজাদা জেনারেল ইয়াকুব আলী জয়দেবপুর রাজবাড়ি মাঠে হেলিকপ্টারে অবতরণ করতে চেষ্টা করলে হঠাৎ শত শত বিক্ষুব্ধ জনতা হেলিকপ্টারের প্রতি ইটপাটকেল ও জুতা ছুঁড়তে শুরু করে। বাধ্য হয়ে হেলিকপ্টার না নামিয়ে ইয়াকুব ফিরে যায়।
কিন্তু ক’দিনের মধ্যেই মোজাম্মেল হকসহ নেতারা খবর পান কুর্মিটোলা (ঢাকা) ক্যান্টনমেন্টে অস্ত্রের মজুদ কমে গেছে এই অজুহাতে জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে রক্ষিত অস্ত্র নিয়ে যাবে পাকিস্তানিরা। অর্থাৎ সহজ করে বলতে গেলে জয়দেবপুরের বাঙালিদের ভরসার জায়গা সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করা হবে—যেন পাকিস্তানিদের কোনো ধরনের আক্রমণে তারা আত্মরক্ষা বা সাধারণ জনগণকে রক্ষা করতে না পারে। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ এই খবরটি বঙ্গবন্ধুকে জানালে তিনি যে কোনো মূল্যে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করা ঠেকানোর নির্দেশ দেন। অর্থাৎ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে থামাতে হবে, তারা যেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করতে না পারে।
মার্চের ১৯ তারিখ হঠাৎ করেই জানা গেল ব্রিগেডিয়ার জাহান জেবের নেতৃত্বে একটা পাকিস্তানি রেজিমেন্ট সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করতে জয়দেবপুরের দিকে এগিয়ে আসছে। সেদিন ছিল শুক্রবার। একজন জেসিও (নায়েব সুবেদার) জয়দেবপুর হাইস্কুলের মুসলিম হোস্টেলের পুকুরে (জকি স্মৃতি প্রাইমারি স্কুলের সামনে) গোসল করার সময় জানতে পারেন যে ঢাকা থেকে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব চলে এসেছে। মোজাম্মেল হক এই খবর পেয়ে দ্রুত তাদের আবাস মুসলিম হোস্টেলে ফিরে গিয়ে উপস্থিত দুই নেতা হাবিবউল্লা ও শহীদউল্লাহ বাচ্চুকে এ সংবাদ জানান। শহীদউল্লাহ বাচ্চু তখনই রিকশায় চড়ে শিমুলতলীতে, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, ডিজেল প্ল্যান্ট ও সমরাস্ত্র কারখানায় শ্রমিকদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে জয়দেবপুরে চলে আসার খবর দেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সেই উচ্চারণ এতোটাই অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করেছিল ছাত্র-শ্রমিক-জনতাকে যে শহীদউল্লাহ বাচ্চুর নির্দেশের এক ঘণ্টার মধ্যেই হাজার শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ চারদিক থেকে লাঠিসোঁটা, দা, কাতরা, ছেন, দোনলা বন্দুকসহ জয়দেবপুরে উপস্থিত হয়। সে এক বর্ননাতিত দৃশ্য! সেদিন জয়দেবপুর হাঁটের দিন ছিল। জয়দেবপুর রেলগেটে মালগাড়ির বগি, রেলের অকেজো রেললাইন, স্লিপারসহ বড় বড় গাছের গুঁড়ি, কাঠ, বাঁশ, ইট ইত্যাদি যে যেভাবে পারলো সংগ্রহ করে তা দিয়ে এক বিশাল ব্যারিকেড দেওয়া হলো। জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত আরও পাঁচটি ব্যারিকেড দেওয়া হয়, যাতে পাকিস্তানি বাহিনী ইস্টবেঙ্গলের কাছ থেকে অস্ত্র লুট করলেও তা নিয়ে ফেরত যেতে না পারে।
দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন মেজর কে এম শফিউল্লাহ । তার উপর অর্ডার এসেছিল সাধারণ জনগণের উপর গুলি ছুঁড়ার। কিন্তু শফিউল্লাহ সেদিন কৌশলে রক্ষা করেছিলেন অসংখ্য মানুষের জীবন। রেলগেইট এলাকায় ব্যারিকেড সরানোর জন্য এবং উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব সরাসরি গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেয় দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গলের রেজিমেন্টকে । কৌশল হিসেবে বাঙালি সৈন্যদের সামনে দিয়ে পেছনে পাঞ্জাবি সৈন্যদের অবস্থান নিয়ে মেজর শফিউল্লাহকে জনগণের ওপর গুলিবর্ষণের আদেশ দেয়। কিন্তু শফিউল্লাহর নির্দেশে কৌশলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা জনতার উপর গুলি না ছুঁড়ে আকাশের দিকে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিরা যখন বুঝতে পারল যে বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাদের স্বজাতির উপর গুলি চালাবে না, তখন তারা সামনে এগিয়ে নিজেরাই সরাসরি গুলিবর্ষণ শুরু করল।
জবাবে মোজাম্মেল হক, হাবিবউল্লাহ, শহীদউল্লাহ বাচ্চু, নেয়ামত, মনু খলিফাসহ নেতাকর্মীরা গাজীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ওপর অবস্থান নিয়ে বন্দুক ও চায়নিজ রাইফেল দিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করেন পাকিস্তানিদের উপর। আর সাধারণ জনগণ যার হাতে যা ছিল তা নিয়েই শত্রুর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। অসম এই যুদ্ধে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের সামনে খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি এই প্রতিরোধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে জয়দেবপুরে তাৎক্ষনিক শহিদ হন নেয়ামত ও মনু খলিফাসহ আরও অনেকে। আহত হন ডা. ইউসুফসহ শত শত মানুষ। মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে যায় শেষ পর্যন্ত।
শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা কারফিউ জারি করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করলে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। জনতা পিছু হটলে দীর্ঘ সময় চেষ্টা করে ব্যারিকেড পরিষ্কার করে অবশেষে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেবের নেতৃত্বে চান্দনা চৌরাস্তায় এসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আবারও প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়। নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় হুরমত এক পাঞ্জাবি সৈন্যকে পেছন দিয়ে আক্রমণ করেন। তার রাইফেল কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু পেছন থেকে আরেক পাঞ্জাবি সৈন্য হুরমতের মাথায় গুলি করলে হুরমত সেখানেই শহিদ হন। বর্তমানে হুরমতের শহিদ হওয়ার সেই স্মৃতিবিজড়িত স্থানে চৌরাস্তার মোড়ে ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নামে ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে।
১৯ মার্চে প্রায় খালি হাতে জয়দেবপুরের মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি হওয়ার অকুতোভয় বীরত্বগাঁথার বারুদের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশব্যপী। আলোড়ন তোলে সর্বত্র। পাকিস্তানি সেনাদের আত্মবিশ্বাসে বড়সড় এক ধাক্কা দিয়েছিল এ ঘটনা। যার প্রমাণ পাওয়া যায় পরদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা চলাকালে যখন ইয়াহিয়া জয়দেবপুরের প্রসঙ্গ টেনে বাঙালিদের উপর দোষ চাপানোর জন্য বলে যে, জয়দেবপুরে জনতা পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আধুনিক অস্ত্র ও চায়নিজ রাইফেল দিয়ে আক্রমণ করেছে এবং এতে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক সৈন্য আহত হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে সারাদেশে উঠেছে নতুন স্লোগান। জয়দেবপুরের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধে বীরদের অনুপ্রেরণায় যে স্লোগান ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। ‘জয়দেবপুরের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’!
আরও পড়ুন: