জেন্ডার সমতা ও নারী নেতৃত্বে সবচেয়ে বড় বাধা যৌন নির্যাতন
২১ মার্চ ২০২১ ১১:০০
বিশ্বজুড়ে বিগত কয়েক দশকে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য হ্রাস, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষায় জেন্ডার সমতা অর্জন বাংলাদেশে নারীদের অগ্রগতির উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রসমূহ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে জেন্ডার সমতায় ইতিবাচক অর্জন সম্ভব হয়েছে এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন এবং যথাযথ রিসোর্স নির্ধারণের ফলে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক জেন্ডার বৈষম্য প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী নারী-পুরুষের সমতার দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার ওপরে বাংলাদেশ।
তবে, এসকল অর্জন সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে, ফরমাল সেক্টরে নারীর অংশগ্রহণ, সম্পত্তিতে মালিকানা, ব্যবস্থাপনা বা নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে নারী এখনও অনেক পিছিয়ে। জেন্ডার বৈষম্যের সবচেয়ে নির্মম বহিঃপ্রকাশ নারী ও কন্যাশিশুর উপর ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনা এবং যা সার্বিক উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ। নারীর প্রতি সহিংসতার প্রকাশ ঘরে, বাইরে এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানী এবং নির্যাতনে ভয়াবহ মাত্রা ধারণ করেছে। যা নারীর অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
১৯৬০ সালে কর্মক্ষেত্রে জেন্ডার সমতা এবং ১৯৭০ সালে সারা বিশ্বে নারীর প্রতি যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারীবাদীদের সোচ্চার আন্দোলন গড়ে ওঠে। দুই দশকের এই আন্দোলন প্রচলিত অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনসহ রাষ্টীয় আইনী ব্যবস্থা ও কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে অনেক দেশ এবং রাষ্ট্র যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ, নীতিমালা ও আইন প্রনয়ণ শুরু করে। ১৯৮১ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ২১ টি দেশ যৌন নির্যাতনের ঘটনাকে অপরাধের স্বীকৃতিসহ এর বিরুদ্ধে সক্রিয় কার্যক্রমের ঘোষণা দেয় এবং নীতিমালা প্রনয়ণ করে।
সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত নারী আন্দোলন যৌন হয়রানী প্রতিরোধ ও প্রতিকারে আইন প্রণয়ন/সংস্কার এবং এর কার্যকর বাস্তবায়নকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছে। পরবর্তীতে, যা সকল কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে সুরক্ষা নীতিমালার আওতায় আনা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল যৌন নির্যাতনের ঘটনার যে পরিসংখ্যান তা গত ২০ বছরে প্রায় অপরিবর্তিত। এই ধরনের অপরাধকে এখনও প্রাইভেট বা ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবেই দেখা হয়, জেন্ডার বৈষম্য এবং আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের কারণ হিসেবে নয়। কারণ, যৌন হয়রানিকে এখনও ব্যক্তি, সমাজ এমনকি বিচার ব্যবস্থাতেও ভিন্নভাবে উপস্থাপন ও ব্যাখা দেয়া হয়। ফলে এত বছরেও বাংলাদেশে নারীর প্রতি যৌন নির্যাতনের যে ভয়াবহ চিত্র তা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে আইনগত কোনো কার্যকর কাঠামো তৈরি হয়নি।
এমনকি নারীর প্রতি সমাজের প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চার ক্ষেত্রেও কোন পরিবর্তন আসেনি। যদিও আমরা গর্ব করে বলছি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধির সর্বক্ষেত্রে নারীর দৃশ্যমান উপস্থিতির কথা। সর্বক্ষেত্রে নারীরা নেতৃত্ব দেওয়ার মতো শিক্ষা, দক্ষতা এবং যোগ্যতা অর্জন করেছে। কিন্তু নারীর এই অগ্রযাত্রা এবং ক্ষমতায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা নারীর প্রতি ক্রমবর্ধমান যৌন হয়রানি, নির্যাতন এবং যৌন শোষণ। নারীর অগ্রগতি তথা ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে যে চিত্র আমরা দেখছি তা অনেক ক্ষেত্রেই নারীর একান্ত অর্জন, কোনও কোনও ক্ষেত্রে পুরুষকে সহযোদ্ধা হিসেবে পেলেও তার সংখ্যা খুবই কম।
ইউএনউইমেন, ইউনিসেফ ও অ্যাকশন এইডের তথ্য অনুযায়ী, সারাবিশ্বে প্রায় ৩৫ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালের গবেষণা বলছে বাংলাদেশে ৯৪% নারী জনসমাগম এবং গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার। ঘরে এবং ঘরের বাইরে যৌন নিপীড়নের ধরণ ও মাত্রা বিগত বছরগুলোতে বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীর প্রতি নির্যাতন বিশেষত যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে যে নিরবতার সংস্কৃতি বিদ্যমান যেখানে দুই-একজন নারী মুখ খুললেও পরিবার ও সমাজের চাপে, চাকুরি হারানোর ভয় কিংবা প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ভয় নারীকে প্রতিবাদী হওয়ার সাহস তো দেয়ইনা বরং তাকে কয়েক ধাপ পিছিয়ে আসতে বাধ্য করে। তা পরিবার কিংবা কর্মস্থল, এমন কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
গণমাধ্যম ও অন্যান্য সূত্র থেকে আমরা যে পরিসংখ্যান পাই বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ এবং বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে উঠে এসেছে যে যৌন নিপীড়নের ৭৫ শতাংশ ঘটনা নথিভুক্ত হয় না। অন্যদিকে গবেষণা বলছে, সকল পরিসরে ৩৪ থেকে ৬৪ বছর বয়স্ক পুরুষরাই সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানি করে। তার একটা বড় কারণ অবাধ পর্নগ্রাফী। পুরুষরা একদিকে পর্ন আসক্ত হচ্ছে অপরদিকে নারীদের আবদ্ধ করতে চাচ্ছে ঘরে, পর্দা নামক ধর্মীয় অনুশাসনে, নিয়ন্ত্রণ করছে নারীর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা।
বিগত দশকে বিচ্ছিন্নভাবে কোনও কোনও দেশে যৌন হয়রানীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে উঠলেও তা সারা বিশ্বে তেমন কোনও আলোড়ন তোলেনি কিংবা সামাজিক আন্দোলনের রূপ নেয়নি। সম্প্রতি হার্ভি ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার পরে সারাবিশ্বে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে- ‘#মিটু’ দিয়ে প্রকাশ করেছেন এবং তা সকলের সামনে চলে আসছে। কোথাও কোথাও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এমনকি প্রতিষ্ঠানও অভিযোগকারী ব্যক্তিদের সমর্থন ও সাহস যুগিয়েছে।
বাংলাদেশে এর ভিন্ন চিত্র পরিলক্ষিত হয়। আর তা হলো নির্যাতনে অভিযুক্তদের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতা। এই পর্যন্ত বাংলাদেশে যে গুটি কয়েকজনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এসেছে তারা সবাই নিজ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী এমনকি অনেকে এই সমাজের কর্তাব্যক্তি। তাদের যৌন নিপীড়নের কাহিনী কিন্তু মানুষের কাছে অজানা নয়। কিন্তু সমাজ এইসব ক্ষমতাশালী পুরুষদের যুগ যুগ ধরে ধারাবাহিক যৌন নিপীড়ক হিসেবে চিহ্নিত করলেও তাকে বৈধতা দিয়ে গেছে। নারীরা যখন মুখ খুলছে তাদের পাশে দুই একজন নারী সমর্থন দিয়ে থাকলেও পুরুষদের মৌনতা চোখে পড়ার মত। আরেকটি বিষয় সমাজে অতি পরিচিত এবং মহিরুহসম মানুষগুলোর চেহারা যদি এই হয় তবে প্রতিদিন নারীর সাথে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানি ঘটনার সাধারণ চিত্র কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়।
এখনও দেখা যায়, যৌন নির্যাতন নিয়ে কথা হলে সকল স্তরে যে বক্তব্য আসে তার সারমর্ম হল- নারীকে সাহসী হতে হবে, আত্মপ্রত্যয়ী হতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে, সর্বোপরি তার ক্ষমতায়ন ঘটাতে হবে। ঘুরে ফিরে যেন সব কিছুর দায় ও বোঝা নারীর উপর চাপানোর চেষ্টা। একজন নারী যৌন হয়রানীর প্রতিবাদে কতোটুকু সহায়ক পরিবেশ ও সহযোগিতা পাবে তা নির্ভর করে ঐ প্রতিষ্ঠানে কতটা কার্যকরী নীতিমালা এবং স্বাতন্ত্র্য বিচার ব্যবস্থা বিদ্যমান তার উপর। কারণ এখনও ব্যবস্থাপনা এবং নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায়ে ৯০-৯৫ শতাংশই পুরুষদের প্রতিনিধিত্ব।
অভিযোগের সহায়ক পরিবেশ ও বিচারের আস্থাহীনতায় অনেক নারীই যৌন হযরানির শিকার হয়ে কর্মক্ষেত্র ত্যাগ করে। সুতরাং যৌন নির্যাতনের যে সংস্কৃতি তার জন্য দরকার প্রতিষ্ঠানের কঠোর অবস্থান ও নীতিমালা এবং আস্থাযোগ্য কার্যকরী বিচার প্রক্রিয়া। যার জন্য দরকার প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের জেন্ডার সমতায় বিশ্বাস এবং যৌন হয়রানীমুক্ত কর্মপরিবেশ গড়ে তোলার জন্য ‘শূন্য সহিষ্ণু’ দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ও অবস্থান।
সর্বোপরি, পরিবার, সমাজ, ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগী পুরুষদের চিন্তা, চেতনা এবং মানসিকতার পরিবর্তন। পুরুষের প্রচলিত ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন ঘটিয়ে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, সম-মর্যাদা ও সম-মূল্যায়নের মাধ্যমেই একজন পুরুষ পারে যৌন নিপীড়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অতি নীরবতার যে সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ এবং চর্চা তার চিত্র পাল্টাতে।
লেখক- টেকনিক্যাল হেড, জেন্ডার, জিভিবি, অ্যান্ড পিএসইএ, হিউম্যানিটারিয়ান ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম, ব্রাক
সারাবাংলা/আরএফ