জীবন সংগ্রামের স্বীকৃতি পেলেন তাসলিমা
২ এপ্রিল ২০২১ ২০:৩৭
ঢাকা: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনকারী বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের ‘রেজিলেন্স অ্যাওয়ার্ড ২০২১’ পেয়েছেন তাসলিমা খাতুন কাজল। কর্মক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তা, প্লেসমেন্ট, ভ্যালু অ্যাচিভমেন্ট ও কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
এ সম্মানে ভূষিত হয়ে তাসলিমা জানালেন তার জীবন সংগ্রামের গল্প। তাসলিমা জানান, বাবা-মা ও চার ভাইবোনের সংসারে ছোটবেলা থেকেই অভাব-অনটন দেখে বড় হতে হয়েছে তাকে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরই তাকে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগে পরিবার। বিয়ে হয়ে গেলে একজনের খাবার খরচ বেঁচে যাবে এমন কথাও শুনতে হতো তাসলিমাকে, তাই পরীক্ষার ফল হাতে পেয়েই খুলনা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। পরিবার ছেড়ে তাসলিমার এভাবে হুট করে চলে আসার কারণ ছিল স্বাধীনভাবে বাঁচার ইচ্ছা।
তাসলিমা বলেন, ‘আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য জোরাজুরি করা হচ্ছিল। তাই সাহস করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি ভাবতাম বাড়িতে থাকলে পরিবার যা বলবে তাই শুনতে হবে। দূরে থাকলে কিছুটা স্বাধীনতা পাব’।
২০০৯ সালে ঢাকায় তাসলিমার সংগ্রাম শুরু হয়। প্রথমে ছোটখাটো একটি চাকরিতে যোগ দেন তিনি। এরপর ২০১১ সালে ইউনিলিভার বাংলাদেশে চাকরি পান সেলস অফিসার হিসেবে। শুরু থেকেই দায়িত্বপালনে মনোযোগী ছিলেন তাসলিমা। তাই তিন মাসের মধ্যেই সিনিয়র সেলস অফিসার হিসেবে পদোন্নতি হয় তার। এখন তাসলিমা আছেন টঙ্গিতে, শপিং কমপ্লেক্সে। সেখানেই থাকেন স্বামীর সঙ্গে। স্বামী ও স্ত্রী দু’জনেই কর্মজীবী হওয়ায় খুলনায় তাসলিমার মায়ের কাছে তাদের পাঁচ বছরের মেয়েটিকে রেখে এসেছেন।
নিজের প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততার কথা জানাতে গিয়ে তাসলিমা বলেন, ‘আমি আউটলেট থেকে অর্ডার কালেকশনের কাজ করি। মেয়েদের জন্য মার্কেটিংপ্লেসগুলাতে যাওয়া অবশ্যই একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আমি আমার পেশাকে সম্মান করি’।
নারী হওয়ায় এক সময় পরিবারের সদস্যদের লাঞ্ছনা সহ্য করেছিলেন তাসলিমা। কিন্তু এখন উপার্জনের বড় একটি অংশই গ্রামে পাঠিয়ে দেন তিনি। ছোটভাইবোনদের পড়াশোনার খরচ চালান। এই স্বপ্নটি তাসলিমা অনেক আগে থেকেই দেখতেন। তিনি বলেন, ‘যখন আমি পড়াশোনা করতাম তখন থেকেই ইচ্ছা ছিল চাকরি করে পরিবারকে সাহায্য করব, এখন তাই করছি’।
তবে তাসলিমার এই চলার পথ একেবারে মসৃণ ছিল না। ২০২০ সালের শেষের দিকে চাকরি ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। সংসারের চাপ ও স্বামীর ইচ্ছায় ভেবেছিলেন চাকরি ছেড়ে দেবেন। কিন্তু ওই দুঃসময়ে ইউনিলিভার তার পাশে ছিল।
তাসলিমা বলেন, ‘আমার দায়িত্বটা ফেলে রাখার মতো কোনো কাজ নয়। সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে হয়। সব মিলিয়ে স্ট্রাগল করছিলাম। আমার স্বামী চাকরি ছেড়ে দিতে বলেছিল। খারাপ সময়টাতে অফিস আমাকে সব-রকমের সহযোগিতা দিয়েছে। মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকতে সাহায্য করেছে। সেজন্য চাকরি ছাড়িনি’।
সম্প্রতি কাজের প্রতি এই দায়বদ্ধতার স্বীকৃতিও পেলেন তাসলিমা। কর্মক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তা, প্লেসমেন্ট, ভ্যালু অ্যাচিভমেন্ট ও কাজের স্বীকতি হিসেবে তিনি অর্জন করেছেন রেজিলেন্স অ্যাওয়ার্ড ২০২১। পুরস্কার পাওয়া প্রসঙ্গে তাসলিমা বলেন, ‘এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় একটি ঘটনা। ইউনিলিভারের রেজিলেন্স অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে যখন আমার নাম ধরে ডাকা হয়, তখন মনে হলো এতদিনের সব পরিশ্রম সার্থক হয়েছে’।
এতসব অর্জনের মাঝেও মন্দ সময়টা ভুলতে পারছেন না তাসলিমা। এজন্য তিনি দোষারোপ করেন নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে। তাসলিমা বলেন, ‘একটা ব্যাপার কি জানেন! একজন মানুষের কারণে তো পরিবারের খাওয়ায় কম পড়ে না। এটা আসলে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। আমাদের সমাজ নারীদের এভাবেই দেখা হয়’।
জীবন সংগ্রামে জয়ী তাসলিমা চান তার মতো অন্য নারীরাও ক্ষমতায়িত হক। তিনি বলেন, ‘অনেক নারীই আছেন চাকরি খুঁজছেন কিন্তু পাচ্ছেন না। তাদের জন্য কর্মক্ষেত্রে আরও বেশি সুযোগ তৈরি করা উচিত। চাকরি না করলেও সব নারীরই কিছু না কিছু করা প্রয়োজন। এতে তারা আত্মবিশ্বাসী হবে’।
বৈষম্যহীন কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে বরাবরই সচেষ্ট ইউনিলিভার। ইউনিলিভারের তরফ থেকে জানানো হয়, তাসলিমার সঙ্গেই এখন অনেক নারী সহকর্মী কাজ করছেন। বর্তমানে সারাদেশে ইউনিলিভারের প্রায় ৯০ জন নারী ডিস্ট্রিবিউটর রয়েছেন। ২০২১ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি এ সংখ্যা ১০ শতাংশ ও ২০২৩ সালের মধ্যে তা ২৫ শতাংশ বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছে। পরিশ্রমী তাসলিমার স্বপ্ন ইউনিলিভারে এফএসই ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া।