Sunday 20 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সমতার নতুন আন্দোলন— ‘সেইম প্যাশন’

রেহমান মোস্তাফিজ
৯ এপ্রিল ২০২১ ১৯:৫১

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বদলের ছোঁয়া লেগেছে প্রায় সবকিছুতে। বদলে গেছে জীবন ও জীবিকা। পাল্লা দিয়ে বদলে গেছে বিউটিফুল গেম খ্যাত ফুটবলও। ৭০-৮০ হাজার দর্শকের চিৎকারে ভারী হয়ে থাকা সান্তিয়াগো বার্নাব্যু, ন্যু ক্যাম্প, এনফিল্ড বা ওল্ডট্রাফোর্ড যেন এখন শুষ্ক ধু ধু প্রান্তর। এমন বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিতি থাকলেও অভ্যাস ছিল না। কেননা খেলা দর্শকের জন্যই, সেই দর্শকই যদি মাঠে না থাকে, তবে খেলার আকর্ষণ কমে যায় বৈকি। কিন্তু তবুও বাস্তবতা মেনে নিতে হয়। জীবনই যেখানে বদলে গেছে, সেখানে ফুটবল নিয়ে অভিযোগ করার সুযোগ কোথায়। দর্শকবিহীন মাঠেই ফুটবলারদের দিনের পর দিন খেলে যেতে হচ্ছে। করোনাভাইরাসের শুরুতে যদিও কয়েক মাস মাঠের খেলা বন্ধ ছিল, তারপর একটা সময় এসে দর্শক মাঠে আসতে পারবে না শর্ত মেনে নিয়েই ফুটবলকে মাঠে নামাতে হয়েছে। তাও ভালো, মাঠে খেলা না থাকার চেয়ে শূন্য মাঠেই খেলা চললে তবুও মেসি-রোনালদো-এমবাপ্পে- নেইমারদের পায়ের কারুকার্য অন্তত দেখা যাবে টিভিতে। তবে এর সাথে আর্থিক বিষয়ও জড়িত আছে। মূলত সেটাই খেলা চালানোর মুখ্য কারণ। খেলা মাঠে না গড়ালে আর্থিক ক্ষতি পোষানো সম্ভব হচ্ছিল না ক্লাবগুলোর পক্ষে। মাঠে দর্শক না থাকায় সেই আর্থিক ক্ষতি এখনও রয়ে গেলেও খেলোয়াড়দের বেতন কেটেছেটে সামাল দেওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

যেটা বলছিলাম, ২০২০ সালের কয়েক মাস খেলা বন্ধ ছিল বলে ইউরোপীয়ান ফুটবল লিগগুলো সিজন শেষ হতে হতে পরের সিজন চলে আসে। ফলে কিছুটা দেরিতেই শুরু হয়েছিল চলতি সিজন। আর তাই সময়টাকে পুষিয়ে নিতে প্রতিটা খেলার মাঝে বিরতি ছিল সামান্যই। ফলে খেলোয়াড়দের দম ফেলার ফুরসত মিলছে না বললেই চলে। খেলোয়াড়দের রোবটের মতো খেলতে গিয়ে পড়তে হচ্ছে একের পর এক ইনজুরিতে। এসব বাস্তবতার সাথেও মানিয়ে নিতে হচ্ছে ফুটবলকে।

বিজ্ঞাপন

ক্লাব ফুটবল যেহেতু ফিরে এসেছে তাই ফিরে এসেছে ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে জনপ্রিয় আসর চ্যাম্পিয়ন্স লিগও। ইতিমধ্যেই চলতি মওসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থকে বিদায় নিয়েছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, বার্সেলোনা, জুভেন্টাসের মতো বড় বড় সব ক্লাব। কোয়ার্টার ফাইনাল আসতে আসতে স্পেনের শেষ আশা হিসেবে টুর্নামেন্টে রয়ে গেছে স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়েল মাদ্রিদ। আর কোয়ার্টারের ড্রতে তাদের প্রতিপক্ষ ইংলিশ জায়ান্ট লিভারপুল।

লিভারপুল এবং রিয়েল মাদ্রিদ—দুই দলই চোট সমস্যায় জর্জরিত। ইতিমধ্যেও চোটের কারণে পুরো সিজন আর মাঠে ফিরতে পারছেন না লিভারপুলের ডিফেন্সের প্রাণ ভার্জিল ভ্যান ডাইক। চোট সমস্যায় খেলতে পারছে না অধিনায়ক হেন্ডারসনও। আর রিয়েল মাদ্রিদে তো ইউরোপীয়ান ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ইনজুরির রেকর্ডই করে বসলো এবার। পুরো ৫০টি ইনজুরির ধকল কাটাতে হচ্ছে তাদের, এবং সিজন শেষ হতে এখনও বাকি দুই মাস। এ সংখ্যা যে সামনে বাড়বে সেই আশঙ্কা রয়েই যায়। লিভারপুল আগেই জানতো তাদের যেমন ভার্জিল ভ্যান ডাইক, হেন্ডারসন নেই তেমনি রিয়েলেও নেই সার্জিও রামোস, দানি কার্ভাহালহো এবং এডেন হ্যাজার্ডের মতো তারকা। আর প্রথম লেগের ম্যাচের দিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে দল থেকে ছিটকে গেলেন রিয়েলের রক্ষণদূর্গের অন্যতম ভরসা বিশ্বকাপ জয়ী রাফায়েল ভারান। দুই দলেই ইনজুরিজনিত সমস্যা থাকলেও ম্যাচটিতে উত্তাপের কমতি ছিল না। বারবার ফিরে আসছিল ২০১৮ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কিয়েভের সেই ফাইনাল। রামোসের ট্যাকেলের শিকার হয়ে যেখানে মোহাম্মদ সালাহ আর খেলতে পারেনি। লিভারপুলও হারে ৩-১ গোলের ব্যবধানে। এবারের ম্যাচে তাই প্রেসবক্সে বারবার প্রতিশোধের কথাই আসছিল। দুই দলই অবশ্য জানিয়েছে তাদের মনে কোনো খেদ নেই। শোধ প্রতিশোধের কথা ভাবছে না তারা। তবে নাকচ করে দিলেও মনে যে কিছুটা প্রতিশোধ ভাবনা আছে সেটা লিভারপুলের কথাতেই আচ করা যাচ্ছিল। ম্যাচের আগেই লিভারপুল কোচ মাদ্রিদের বর্তমান স্টেডিয়াম আলফ্রেডো ডি স্টেফানো কোনো স্টেডিয়ামই নয় বলে খুঁচা দিয়েছেন। উল্লেখ্য গত দেড় বছর ধরে বি টিম ক্যাস্তিয়ার এই মাঠে খেলে আসছে মাদ্রিদ। মূল মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে চলছে সংস্কার কাজ। তবে এই আলফ্রেডো ডি স্টেফানা বি টিমের মাঠ হলেও ইউরোপের বহু ক্লাবের মূল স্টেডিয়ামের চেয়েও ঢের উন্নত।

যাইহোক, সেদিনের ম্যাচটি শুরু হয় স্বাভাবিক নিয়মেই। লিভারপুলের ইনজুরি সমস্যাকে লক্ষ্য করে প্রথমার্ধেই দুই গোল তুলে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে গোল দুটি করে ব্রাজিলিয়ান তরুণ ভিনিসিয়াস জুনিয়র এবং স্প্যানিশ উইঙ্গার মার্কো এসেন্সিও। এই গোল দুটি বিশেষ গুরুত্ববহ কারণ, গোল না পাওয়ার জন্য দুজনই বেশ কিছুদিন ধরে সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছিলেন। ভিনিসিয়াসের সমালোচনা ছিল গোল মুখে গিয়ে গোল করতে না পারা আর এসেন্সিওকে বলা হচ্ছিল সে আর কখনওই আগের রূপে ফিরতে পারবে না। জানার জন্য বলে রাখি, ২০১৯-২০ পুরো সিজনই তার বাইরে কেটেছে এসিএল ইনজুরির কারণে। যে ইনজুরি অনেক বড় বড় খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ার নষ্ট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সমালোচনার কারণেই হোক বা নিয়মিত গোল না পাওয়ার কারণে, গত কিছুদিন ধরেই এসেন্সিওকে নিয়মিত একাদশে রাখা হচ্ছিল না। আর তাই অনেকদিন বাদে একাদশে ফিরেই গোল পাওয়ায় তার উদযাপনে ছিল বুনো উল্লাস। আর করবেই বা না কেন? চ্যাম্পিয়ান্স লিগের ম্যাচে গোল বলে কথা।

এসেন্সিওর উদযাপন থেকেই ঘটনার শুরু। চলতি বছর রিয়েল মাদ্রিদ নিজেদের নারী ফুটবল দলও গড়ে তুলেছে। ছেলেদের মতো এখনও তেমন সাফল্য পায়নি তারা। লিগেও আছে বর্তমানে তিন নাম্বারে। কিন্তু নামটা তো রিয়েল মাদ্রিদ। আর মাদ্রিদের হয়ে অনুভূতি সেটা ছেলে হোক বা মেয়ে— সবারই এক ও অভিন্ন। আর তাই এসেন্সিওর সেই বুনো উল্লাসের ছবিটা নিয়ে নিজের এক ম্যাচের ছবি একসাথে দিয়ে টুইটারে টুইট করেছিলেন রিয়েল মাদ্রিদ দলের নাম্বার ওয়ান গোলকিপার মারিয়া ইসাবেল রোদ্রিগেজ। ভক্তরা যাকে ডাকে মিসা বলে। আর দুটো প্রায় একই রকম উদযাপনের সেই ছবির ক্যাপশন হিসেবে মিসা লিখেছিল “misma pasion”। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘একই অনুভূতি’।

নিজের দলকে ভালবেসে করা এই ছোট টুইটটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। পুরুষতন্ত্রে অন্ধ একদল মানুষের তাতে আপত্তি। তাদের কথা হলো— নারী হয়ে ফুটবল খেলায় ছেলেদের সমান তিনি হন কী করে। কিছু মানুষের তীব্র কটাক্ষ আর পুরুষতান্ত্রিক মন্তব্যে দূষিত হয়ে উঠে সামাজিক মাধ্যম। কেউ কেউ করে গালাগালি। মিসার দোষ, তিনি নারী হয়ে পুরুষের সমান অনুভূতি ধারণ করেন। দূষিত কটাক্ষে বিরক্ত হয়ে এক সময় টুইটার থেকে নিজের টুইটটি ডিলেট করে দেন মিসা।

এ ঘটনাটি যখন ঘটছে রিয়েল মাদ্রিদ-লিভারপুল ম্যাচ তখনও চলছিল। রিয়েল মাদ্রিদ ম্যাচটি জিতে নেয় ৩-১ গোলের ব্যবধানে। ম্যাচ শেষে রিয়েল মাদ্রিদ উইঙ্গার মার্কো এসেন্সিও জানতে পারেন ঘটনাটি। আর তাই তখনই এসেন্সিও মিসাকে ট্যাগ করে টুইটারে সেই একই ছবি দিয়ে লিখেন  ‘misma pasion’।  আর সাথে অতিরিক্ত লাইন হিসেবে লিখে দেন, ‘যে বা যারা তোমাকে তোমার মনের কথা প্রকাশ করতে দেয় না, তোমাকে তোমার মতো থাকতে দেয় না তাদের প্রশ্রয় দিও না’। এসেন্সিওকে দিয়ে শুরু— একে একে তাদের নারী ফুটবলারের পাশে দাঁড়ান দলের অভিজ্ঞতম থেকে তরুণতম সদস্যরা। মার্সেলো, লুকাস ভাস্কেস, ফেদে ভালভার্দে, রাফায়েল ভারান, ভিক্টর চাস্টসহ অনেকেই নিজের উদযাপনের ছবির সঙ্গে জুড়ে দেন মিসার সেই ছবি। আর ক্যাপশনে লিখেন- ‘misma pasion’ অর্থাৎ ‘একই অনুভূতি’। এদিকে রিয়েল মাদ্রিদের এই আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে পুরো ফুটবল দুনিয়াতেই। একে একে মিসার সাথে যোগ দিয়েছে বার্সেলোনা, টটেনহাম, বায়ার্ন মিউনিখ, ফ্ল্যামেঙ্গোসহ প্রায় সব ইউরোপীয়ান ফুটবল ক্লাব। আরও যোগ হয়েছে স্পেন ও ব্রাজিল জাতীয় দল। এই সবারই টুইট ছিল একই, ‘সেইম প্যাশন’।

শুধু ফুটবল দুনিয়াতেই সীমিত থাকেনি এই আন্দোলন। ছড়িয়ে গেছে অন্য ক্ষেত্রেও। টুইটারে প্রায় সকল অঙ্গনের নারী এবং পুরুষ নিজের একাউন্ট থেকে তাদের সাথে থাকা সহকর্মীদের ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখছেন—‘সেইম প্যাশন’।

সারাবাংলা/আরএফ/আইই

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর