টিক্কা খানকে শপথ পড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন যে বিচারপতি
১৪ এপ্রিল ২০২১ ১৬:৫১
দু’টি শপথের গল্প শুনবো আজ। অস্ত্রের মুখে মৃত্যুভয় দেখিয়েও বেলুচিস্তানের কসাইখ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ করানোর জন্য রাজি করা যায়নি এক বাঙালি বিচারপতিকে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে সামরিক বিধি সংশোধন করে টিক্কা খানকে নিয়োগ দিতে হয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকারের। এরপর বাঙালিদের উপর নৃশংস গণহত্যা চালিয়ে এপ্রিলে লাখো বাঙালির রক্তের উপর হেঁটে টিক্কা খান এই ভূখণ্ডের গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করে। অন্যদিকে তার কিছুদিনের মধ্যেই আরেকটি শপথে আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু হয়েছিল সদ্য স্বাধীন একটি দেশের যুদ্ধকালীন বিপ্লবী সরকারের। যে সরকারের অসমসাহসী কমান্ডারেরা শত্রুর হাতে বন্দী সর্বাধিনায়কের নামে প্রবল বিক্রমে দখলদার শত্রুর বিরুদ্ধে দুর্দমনীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলা মুক্তিবাহিনীকে অসামান্য নেতৃত্বে পরিচালিত করেছিল বিজয়ের পথে।
১৯৭১ সালের মার্চে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার বেলুচিস্তানের কসাই নামে কুখ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদে নিয়োগ দেয়। ৯ মার্চ তার শপথ গ্রহণের দিন ঠিক করা হয়। কিন্তু বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল তখন। প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ছিল সারাবাংলা। তেমন এক পরিস্থিতিতে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বদরুদ্দীন আহমদ সিদ্দিকী (বি এ সিদ্দিকী)-এর উপর ভার পড়ে নতুন গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাওয়া টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ করানোর। কিন্তু বেলুচিস্তানে গণহত্যা ও জেনোসাইড চালিয়ে আসা টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী।
একজন বাঙালি বিচারপতির এমন ‘স্পর্ধায়’ চমকে গিয়ে হুমকি দিতে থাকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। তারই ধারাবাহিকতায় পরদিন ১০ মার্চ বিচারপতি বি এ সিদ্দিকীকে গভর্নর হাউজ (বর্তমান বঙ্গভবনে) আসার জন্য লোক মারফত সমন জারি করা হয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের আদেশ পালনে তাকে বাধ্য করার জন্য পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা বিচারপতি সিদ্দিকীর সরকারি বাসভবন ঘেরাও করা হয়। গভর্নরকে শপথ গ্রহণ করাতে রাজি হলে তাকে এবং তার পরিবারকে নিরাপদে পাকিস্তানে পৌঁছানোর আশ্বাস দেওয়া হয়। পুনরায় বিচারপতি সিদ্দিকী শপথ গ্রহণ করাতে তার অপারগতা প্রকাশের মাধ্যমে সরাসরি পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতা করেন। বিচারপতি সিদ্দিকীর এই সাহসী পদক্ষেপ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বি এ সিদ্দিকী স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, জেনারেল টিক্কা খানকে শপথ বাক্য পাঠ করানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার দৃঢ় অবস্থানের ফলে দ্বিতীয় দিনের মতো টিক্কা খানের পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ নেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এমন অচলাবস্থায় শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান বিধি সংশোধন করে টিক্কা খানকে সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়।
বাঙালি বিচারপতির কাছে শপথ গ্রহণে ব্যর্থ হয়ে বেলুচিস্তানের কসাই সেই টিক্কা খান পরবর্তীতে অপারেশন সার্চলাইট নামে নৃশংস গণহত্যা ও জেনোসাইড চালিয়ে লাখো বাঙালিকে হত্যা করেছিল এবং তাদের রক্তের উপর হেঁটে এপ্রিলের ৯ তারিখে এই ভূখণ্ডের গভর্নর হিসেবে শপথ নিয়েছিল। একজন খুনি নরপিশাচ একটা ভূখণ্ডের আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে শপথ নিলে ঠিক কী ঘটতে পারে, তার প্রত্যক্ষ ভয়াবহতা দৃশ্যমান হয়েছে একাত্তরের বাকি নয় মাসে। ভয়াবহ ও নির্মমতম জেনোসাইডের শিকার হয়েছে লাখো লাখো মানুষ। স্বজন হারিয়ে, পায়ের নীচের জমিন, মাথার উপরের আশ্রয় হারিয়ে উদ্বাস্তু ও নিঃস্ব হয়েছে কোটি মানুষ।
ঠিক সেই সময়েই ১০ এপ্রিল অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ভূখণ্ডে গঠিত হয় যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকার। মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলার আমবাগানে ১৭ এপ্রিল নবগঠিত সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। বঙ্গবন্ধুর নামানুসারে বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে ৩ এপ্রিল বৈঠকের সূত্র ধরে তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ এবং এমপিএদের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। ওই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। এই মন্ত্রিপরিষধ এবং এমএনএ এবং এমপিএ-গণ ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেন। তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য নিয়োগ করা হয়। ১১ এপ্রিল এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়।
এই সময় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সেগুলোর দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়। এরপরেই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার বা মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ নামের এই দলিল যতদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলেছে ততদিন মুজিবনগর সরকার পরিচালনার অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে কার্যকর ছিল।
১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুক্তাঞ্চল বৈদ্যনাথতলা অর্থাৎ মুজিবনগরে নবগঠিত সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান এম এন এ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এম এন এ। নবগঠিত সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে এখানে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু যেহেতু পাকিস্তানের জেলে বন্দী, সুতরাং তার পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজ্রুল ইসলাম মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন মেহেরপুরে তাৎক্ষণিকভাবে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে।
সেখানে তিনি বলেন, ‘সমবেত সাংবাদিক বন্ধুগণ এবং উপস্থিত জনসাধারণ, আপনাদের সামনে আমার মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রীকে আপনাদের সামনে সর্বপ্রথমে উপস্থিত করছি। জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ। এ সময় উপস্থিত সবাই করতালি দিয়ে নতুন সরকারের মন্ত্রিপরিষদ অভিনন্দন জানান। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সরকার গঠন এবং ১৭ এপ্রিল সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলেও মন্ত্রীদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন হয় ১৮ এপ্রিল।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীনের দেওয়া ভাষণটি ১০ এপ্রিল শনিবার রাত ৯টার দিকে বিএসএফের বেতার যন্ত্রে প্রচারিত হয়। পরদিন ১১ এপ্রিল কলকাতার আকাশবাণী থেকেও একাধিকবার ভাষণটি প্রচার করা হয়েছিল। অসম্ভব অনুপ্রেরণাদায়ী দূরদর্শী সেই বিশাল ভাষণটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এমন,
“…স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাইবোনেরা,
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানসের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাদের, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাদের মূল্যবান জীবন আহূতি দিয়েছেন। যতদিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যতদিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে ততদিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের বীর শহিদদের অমর স্মৃতি বাঙালির মানসপটে চির অম্লান থাকবে।
২৫শে মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন তা প্রতিরোধ করবার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আপনারা সব কালের সব দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের সাথে আজ একাত্ম। পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আপনারা গড়ে তুলেছেন তা এমন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যে, পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে আপনাদের এ অভূতপূর্ব সংগ্রাম সর্বকালের প্রেরণার উৎস হয়ে রইল। প্রত্যেক দিনের সংগ্রামের দিনপঞ্জি আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করছে, বিশ্বের কাছে আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করছে।
বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্যে রচিত হোক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শোষণ করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ক্ষুধা, রোগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি। এই পবিত্র দায়িত্বে নিয়োজিত হোক সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙালি ভাইবোনের সম্মিলিত মনোবল ও অসীম শক্তি।
যারা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলার মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা; গণমানসের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তিপ্রস্তরে লেখা হোক জয় বাংলা, “জয় স্বাধীন বাংলাদেশ”।