রোকেয়ার চিন্তাচেতনায় নারী-পুরুষের সমতায়ন
২৪ এপ্রিল ২০২১ ১৬:৪৭
নারীপুরুষ একে অপরের পরিপূরক। এই পৃথিবীর সৃষ্টি এবং সৌন্দর্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াস অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি উন্নয়নের সোপানে পৌঁছাতে হলে নারীপুরুষ একত্রে কাজ করবে, এমনটাই প্রত্যাশা করে প্রগতিবাদীরা। ঠিক এই মানসিকতা নিয়ে এই উপমহাদেশে আগমন ঘটে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের। তিনি মনে করতেন, পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে নয়, বরং নারী-পুরুষের সহযোগিতা ও সহানুভূতির ভিত্তিতেই সমাজ ও দেশের সার্বিক উন্নতি সম্ভব। কবি নজরুলের ভাষায়, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’, এমন পঙক্তির ভাবের মধ্যে নারী-পুরুষের সম্মিলিত ভূমিকাকে মহান করে তোলে। তেমনি রোকেয়াও তাঁর কর্মযজ্ঞ এবং তাঁর লেখনীর মাধ্যমে নারী-পুরুষের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বিশেষভাবে প্রতিভাত করেছেন।
নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন আজীবন সমাজসংস্কারমূলক কাজ করে গেছেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি নারীদের অধঃপতনের নির্মম রূপ অবলোকন করেছেন, করেছেন উপলব্ধি। তাই নারীকে জাগিয়ে তোলার জন্য নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। পুরো সমাজের চিত্র বদলে প্রগতির দিকে এগিয়ে যাবে সেই প্রত্যাশায় নারী-পুরুষের সমতার কথা তাঁর প্রতিটি রচনায় উল্লেখ করেছেন। কাব্য-সাহিত্যে খুঁজলে এমনতর আরও অনেক বলিষ্ঠ উচ্চারণ পাওয়া যাবে, যা সমাজ, সংসার এবং বৃহত্তর সভ্যতা বিনির্মাণে নারী ও পুরুষের সমগুরুত্ব সম্যকভাবে বোঝানো হয়েছে। ঠিক একই মানসিকতা নিয়ে রোকেয়া নারী-পুরুষের সমতা আনার জন্য নারীকে যেভাবে আক্রমণ করেছেন, তেমনি পুরুষকেও আক্রমণ করেছেন; সেইসাথে আক্রমণ করেছেন প্রথা মেনে চলা সমাজকে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন ধর্মীয় গোড়ামিকে।
এরই প্রেক্ষিতে রোকেয়া একটি গাড়ি চলার জন্য দুটি চাকার সমান ভূমিকার কথা বলেছিলেন, যা নারী-পুরুষকে সমান চোখে দেখবার জন্য প্রায়োগিক এবং মানবিক। এমন উদাহরণ সত্যি বিরল। তিনি বলেছিলেন, কোনো শকটের (গাড়ির) দুটি চাকা যদি সমান না হয়, তাহলে সেই গাড়ি চলতে পারে না। অসমান চাকা নিয়ে গাড়িটি চালাতে গেলেই সেটি একই চক্রে শুধু ঘুরপাঁক খেতে থাকবে। এ তত্ত্বে তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, আমরা যে দুটি চাকায় ভর করে সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের গাড়িটি চালাচ্ছি বা চালাতে চেষ্টা করছি সেটা সামনে এগোতে পারবে না! তিনি আরো বলেছেন, ‘নারী ও নর, উভয়েই একই বস্তুর অঙ্গ বিশেষ। যেমন একজনের দুইটি হাত কিম্বা কোনো শকটের দুইটি চক্র; সুতরাং উভয়ে সমতুল্য, অথবা উভয়ে মিলিয়া একই বস্তু হয়। তাই একটিকে ছাড়িয়া অপরটি সম্পূর্ণ লাভ করিতে পারিবে না। এক-চক্ষু-বিশিষ্ট ব্যক্তিকে লোকে কানা বলে।’ এমন বক্তব্য দিয়ে রোকেয়া যা বুঝাতে চেয়েছেন তা আমাদের বোধের ঘরে নাড়া দিয়ে গেছে।
রোকেয়ার অন্তর্দৃষ্টি এবং বিবেক বিবেচনায় তাঁর বিচারশক্তিই পথপ্রদর্শক হয়েছিল। কখনই তিনি মাত্রাজ্ঞান হারাননি। নারী-পুরুষের অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা মাথায় রেখেই তিনি লিখেছেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধ অঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠবে কিরূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে, একই। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই। শিশুর জন্য পিতামাতার উভয়েই সমান দরকার।… জগতের যেসকল সমাজের পুরুষেরা সঙ্গিনীসহ অগ্রসর হইতেছেন, তাহারা উন্নতির চরমসীমায় উপনীত হইতে চলিয়াছেন। আমাদের উচিৎ যে, তাহাদের সংসারের এক গুরুতর বোঝাবিশেষ না-হইয়া তাহাদের সহায়তা করি। আমরা অকর্মণ্য পুতুল জীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্ট হই নাই, একথা নিশ্চিত।’ রোকেয়ার এমন বক্তব্য নারীকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়েই প্রকাশ।
রোকেয়া নারীকে কুসংস্কার ধারণা থেকে মুক্ত করে মনুষ্যত্বের উন্মুক্ত ধারণায় অর্থাৎ মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তারই লক্ষ্যে তিনি সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজে-কথায় এবং লেখনীতে কঠিনভাবে প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘স্ত্রীজাতি সুবিধা না-পাইয়া সংসারের সকল প্রকার কার্য হইতে অবসর লইয়াছে এবং ইহাদিগকে অক্ষম ও অকর্মণ্য দেখিয়া পুরুষজাতি ইহাদের সাহায্য আরম্ভ করিল। ক্রমে পুরুষ পক্ষ হইতে যতই বেশি সাহায্য পাওয়া যাইতে লাগিল, স্ত্রী-পক্ষ ততই অধিকতর অকর্মণ্য হইতে লাগিল। এদেশের ভিক্ষুকদের সহিত আমাদের বেশ তুলনা হইতে পারে। একদিকে ধণাঢ্য দানবীরগণ ধর্মোদ্দেশ্যে যতই দান করিতেছেন অন্যদিকে ততই অধম ভিক্ষুক সংখ্যা বাড়িতেছে। ক্রমে ভিক্ষাবৃত্তি অলসদের একটা উপজীবিকা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এখন আর তাহারা ভিক্ষা গ্রহণ করাটা লজ্জাজনক বোধ করে না।’ এমন উক্তিতে বর্তমান নারী সমাজের চিত্র যেন ফুটে উঠছে। ধর্মীয় আগ্রাসনে এমন চিত্র আরও প্রকট হচ্ছে। অথচ, ঠিক একই চিত্রের কথা শত বছর আগে রোকেয়া বলে গেছেন। অবস্থার পরিবর্তন কি খুব একটা হয়েছে?
নারী-পুরুষের সমতায়নে রোকেয়া যেভাবে নারীকে বিদ্ধ করেছেন, তেমনি পুরুষকেও বিদ্ধ করেছেন। মতিচূর (প্রথম খণ্ড) গ্রন্থে বর্ণিত আছে, ‘আজ ভারতের নারীসমাজ এত অবনতির অতলতলে পড়িয়া গিয়াছে কেন? তাহার একমাত্র কারণ পুরুষ। পুরুষ নিজের সুখ-স্বার্থের ষোলআনা পুরামত্রায় আদায় করিয়া লইয়া ঘর শূন্য করিয়া দিয়াছে। ইহা পশুশক্তির চূড়ান্ত নিদর্শন। নারীকে অজ্ঞ, মূর্খ, প্রিয় বস্তুটি করিতে গিয়া পুরুষ যে কি-বিষময় ফল লাভ করিয়াছে ও করিতেছে তাহা আজও তাহার দৃষ্টিগোচর হইতেছে না।’ রোকেয়ার লেখায় আরও আছে, ‘কলিযুগে আমাদের ন্যায় অর্ধাঙ্গী লইয়া পুরুষগণ কিরূপ বিকলাঙ্গ হইয়াছেন, তাহা কি কেহ একটু চিন্তাচক্ষে দেখিয়াছেন? আক্ষেপের (অথবা ‘প্রভু’দের সৌভাগ্যের) বিষয় যে, আমি চিত্রকর নহি, নতুবা এই নারীরূপ অর্ধাঙ্গ লইয়া তাহাদের কেমন অপরূপ মূর্তি হইয়াছে, তাহা আঁকিয়া দেখাইতাম।’ নারীদের বিষয়ে রোকেয়ার দৃষ্টি ছিল প্রখর। তাঁর সমস্ত রচনাবলীতে নারীদের অবনতির জন্য নারীদের অসচেতনতাকেই বেশি দায়ী করেছেন। তিনি নারীকে প্রচলিত সামাজিক এবং ধর্মীয় ধারা থেকে বের করে এনে এক উন্নততর জীবন দিতে চেয়েছিলেন। সেইসাথে নারী-পুরুষের মধ্যে যে ব্যবধান তা ঘোচানোর চেষ্টা করেছেন।
সার্বিক উন্নয়নের জন্য নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াস কতটা যে অপরিহার্য তা রোকেয়া সেই সময়ে তীব্রভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তারই প্রেক্ষিতে তাঁর যত কর্মযজ্ঞ। সমতা অর্জনের লড়াইয়ে নারীকেই বেশি অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে একথা রোকেয়া দৃপ্তকণ্ঠে বলে গেছেন। পুরুষ তো তার স্বভাবসুলভ আচরণ দিয়ে সবকিছু নিজ কব্জায় করায়ত্ত করে রেখেছে; সেখানে নারীকে ব্যবহার করছে পুরুষের প্রয়োজনে। এই বিষয়টা যদি নারী উপলব্ধি করতে না পারে, তাহলে কখনই নারী মানুষের মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে চলতে পারবে না। তাই রোকেয়া তাঁর সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি নিয়ে লিখেছিলেন, ‘বিবেক আমাদিগকে আমাদের প্রকৃত অবনতি দেখাইয়া দিতেছে, এখন উন্নতির চেষ্টা করা আমাদের কর্তব্য।’ তিনি দৃঢ়চেতা মন নিয়ে বলেন, পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা যাহা করিতে হয়, তাহাই করিবো।’
নারী জাগরণের জন্য রোকেয়ার এমন দ্ব্যর্থহীন আহবান তাঁর সকল কর্মকাণ্ডে অব্যাহত ছিল।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেবো।’ সভ্য ও শিক্ষিত জাতি গঠনে নারীর ভূমিকার কথা তিনি গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছেন, যা নারীকে পুরুষের সমান সক্ষমতায়, মর্যাদায়, প্রয়োজনীয়তায় দেখতে সাহায্য করে। পুরুষ তার জন্মদাত্রী মা, বোন এমনকি জীবনসঙ্গিনীকে কি গুরুত্ব দিয়ে দেখে? তারা যদি গভীরভাবে এদের নিয়ে ভাবতো এবং সেইসাথে মূল্যায়ন করতো তাহলে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ অনেকটা হ্রাস পেত এবং পুরুষের কাছে নারী হয়ে উঠতো অনন্য। কিন্তু এতসব বাস্তব জ্বাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও নারীদের দুর্দশা কি কমেছে? সমাজবিজ্ঞানের ভিত্তিতে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর অবস্থান সুদৃঢ় করে বাস্তবায়নের কথা বললেও দিকে দিকে শুধু আহত, বিধ্বস্ত আর অধস্তন নারীর মুখ দেখি! তাহলে নরীর অধিকার, মর্যাদা এবং অবস্থানগত পরিবর্তনের জন্য গৃহিত হাজার রকম চেষ্টা কি ব্যর্থ হল?
আজ নারীর ক্ষমতায়ন বা ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত না করেই তথাকথিত উন্নয়নের গাড়ি ছুটছে, যার দুটি চাকাই অসমানে; যেভাবে রোকেয়া একশত বছর আগে দেখেছিলেন তা এখন পর্যন্ত ভারসাম্যহীন চলমান অবস্থায় আছে।
রোকেয়া পাঠে বিশেষভাবে বলতে পারি, শুধু নারী উন্নয়নের কথাই তার লেখনীতে বিধৃত হয়নি, পাশাপাশি পুরুষের মানসিক পরিবর্তনের জন্যও লিখেছেন; যাতে নারীপুরুষ একসাথে সম্মিলিত সুখী সমৃদ্ধ এবং মর্যাদাসম্পন্ন জীবনযাপন করতে পারে। রোকেয়া যেভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে তার প্রাসঙ্গিকতা এখনঅ আমরা উপলব্ধি করি।
সারাবাংলা/আরএফ
টপ নিউজ নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন