পাচারের শিকার নুরজাহানের দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা
৬ মে ২০২১ ২২:৫৫
বয়ঃসন্ধিকালীন আর দশটা কিশোরীর মতোই তার রঙিন জীবন ছিল কুমিল্লার লাকসামের মেয়ে নুরজাহানের (ছদ্মনাম)। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। তবু চোখে স্বপ্ন, মনে আশা। জীবনকে বদলে দেওয়ার কত পরিকল্পনা! কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। অন্ধকার ঘিরে ধরে। ভেঙে যায় সুন্দর স্বপ্নের ঘোর। জীবন বদলাতে মেয়েটি দেশ ছেড়ে গিয়েছিল ভারতে। সেখানে মেয়েটির কি না জায়গা হলো বেঙ্গালুরুর এক যৌনপল্লীতে! আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর মানবাধিকারকর্মীদের প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত সেই যৌনপল্লী থেকে বের হতে পেরেছে মেয়েটি। তবে মুক্তি মেলেনি এখনো। বন্দি আছে পশ্চিমবঙ্গের কারাগারে।
গত বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) ১৬ বছর বয়সী বাংলাদেশি কিশোরী নুরজাহানকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণার পঞ্চবেড়িয়া সীমান্ত থেকে আটক করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। আউটলুক ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নুরজাহানের জীবনের এই নির্মম অধ্যায়ের কথা। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি বলছে, নুরাজাহানের মতো এমন অনেক কিশোরীই পাচার চক্রের শিকার হয়। আর শেষ পর্যন্ত তাদের গন্তব্য হয় যৌনপল্লী। নুরজাহান এই যৌনপল্লীর অন্ধকার থেকে মুক্তি পেলেও অন্য অনেকেই শেষ পর্যন্ত সেখান থেকেও মুক্তি পায় না।
আউটলুকের প্রতিবেদন বলছে, সুখী ও সুন্দর এক জীবনের আশায় আরও অনেকের মতোই ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল নুরজাহান। ভারতে অবস্থানরত এক ‘স্বজন’ ছিল তার গন্তব্য। অবৈধভাবে মানব পাচারে যুক্ত চক্রের কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয় নুরজাহানের। সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যব্স্থার ফাঁক-ফোকড় গলিয়ে তারাই ভারতে পার করে দেন মেয়েটিকে।
ভারতে গিয়েও ভাগ্য বদল হয়নি নুরজাহানের। কয়েকটি শহর ঘুরে শেষ পর্যন্ত ব্যাংগালুরুর এক যৌনপল্লীতে স্থান হয় তার। পরে মানবাধিকারকর্মীদের তৎপরতায় সেখান থেকে বের হতে পারলেও আর কিছু করতে পারেনি সে। বিভিন্ন শহরে ঘুরেও কোনো সুবিধা না করতে পারায় একসময় আরও কয়েকজনের সঙ্গে দেশে ফেরার চেষ্টা করে নুরজাহান। তখনই পঞ্চবেড়িয়া সীমান্তে ধরা পড়ে। তার সঙ্গেই ভারতীয় পুলিশের হাতে আটক হয় সুরদ বিশ্বাস। মুম্বাই থেকে কলকাতা ফেরার পথে দমদম বিমানবন্দরে এক এজেন্টের মাধ্যমে তার সঙ্গে নুরজাহানের পরিচয় হয়েছিল। তাদের ঠিকানা এখন কারাগার।
আউটলুকের প্রতিবেদন বলছে, নুরজাহান ও সুরদকে আটকের পর উত্তর চব্বিশ পরগণার বনগাঁওয়ের বাগদহ পুলিশ স্টেশনে হস্তান্তর করে বিএসএফ। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে আদালতে হাজির করে। আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। নুরজাহানের বয়স ১৬— মেয়েটি এ তথ্য জানালেও অবশ্য মামলার নথিতে তার বয়স লেখা হয়েছে ১৮।
আউটলুকের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে, ফেসবুকের মাধ্যমে নুরজাহানের সঙ্গে পরিচয় হয় ব্যাংগালুরুর শান্তা আফরিন জারা নামে একজনের। তবে নুরজাহানের মায়ের কাছে ইশরাত নামের একজনের কথা শোনা যায়। ইশরাত আর শান্তা একই ব্যক্তি কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ভারতে যেতে পারলে বিউটি পার্লারে নুরজাহানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন এই শান্তাই। তিনি নুরজাহানকে নড়াইলের সবুজ নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। তার মাধ্যমে সাতক্ষীরার আরুল নামে একজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয় নুরজাহানের। তার বাড়িতে একসপ্তাহ থাকতে হয় নুরজাহানকে, দিতে হয় ২০ হাজার টাকা। পরে আরুল তাকে অবৈধভাবে বেনাপোল সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। বিভিন্ন সূত্রের খবর বলছে, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নুরজাহান পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাতে ধরা পড়লে সেখান থেকে আবার স্থানীয় এজেন্ট ৭০ হাজার টাকা দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নেয়।
বেনাপোল থেকে কলকাতা পৌঁছানোর পর মার্চের শেষের দিকে সবুজ তাকে ব্যাংগালুরু নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে পার্লারে কাজ না দিয়ে দুই সপ্তাহ আটকে রাখা হয় একটি যৌনপল্লীতে। ওই সময় তাকে মাদক দিয়ে বেহুঁশ করে রাখা হতো। সেখান থেকে তাকে চেন্নাই নিয়ে পুরোপুরি যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। পরে ব্যাংগালুরু ও হায়দরাবাদেও যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয় নুরজাহানকে।
২২ এপ্রিল তারিখে ভাগ্য কিছুটা প্রসন্ন হয় নুরজাহানের প্রতি। হায়দরাবাদে একজন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ভারতীয় প্রকৌশলীর সঙ্গে দেখা হয় তার। এ কয়দিনে কিছুটা হিন্দি শিখেছে নুরজাহান। ভাঙা ভাঙা সেই হিন্দি দিয়েই তার কাছে সহায়তা চায়। সেই প্রকৌশলী এক হাজার রুপি দিয়ে তাকে পুলিশের কাছে পৌঁছে দেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই প্রকৌশলী আউটলুক প্রতিবেদকের কাছে সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন এভাবে— ‘আমি ওর কথার কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পরে আমার স্ত্রীকে ডেকে ওর সঙ্গে কথা বলতে বলি। তখন আমরা ভাবছিলাম ওকে কিভাবে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে দেওয়া যায়। সেই চিন্তা থেকেই বানজারা থানায় কল করি। স্থানীয় এক মন্দিরের পাশে আমরা ছিলাম। সেখানে একটি বাইকে চড়ে দু’জন পুলিশ সদস্য এলেন আমাদের কল পেয়ে। পরে মেয়েটিকে অটোরিকশায় করে নিয়ে গেলেন।’
ওই প্রকৌশলী বলছেন, নুরজাহানের কাছ থেকে যতটুকু তথ্য তিনি পেয়েছেন তাতে জানতে পেরেছেন— চেন্নাইয়ে নুরজাহানের এক বোন আছে, যার সঙ্গে তার দেখাও হয়েছে। আর ওই প্রকৌশলীর স্ত্রী জানান, মেয়েটির কাছে একটি নকল আধার কার্ডও (ভারতীয় পরিচয়পত্র) ছিল, যেখানে তার নাম লেখা ছিল রিতা।
বানজারা থানার দায়িত্বরত ছাড়াও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে আউটলুক বলছে, সেদিন ফোন পেয়ে একটি মেয়েকে (নুরজাহান) উদ্ধার করে বানজারা থানা পুলিশ। পরে ব্যাংগালুরু থেকে একজন ফোন দিয়ে নিজেকে মেয়েটির বোন হিসেবে পরিচয় দেন। একজন পুরুষও ফোন করে মেয়েটিকে ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু থানায় এসে মেয়েটিকে ছাড়িয়ে নিতে বললে রাজি হননি কেউ। পরে নুরজাহানকে পুলিশ একাধিক শেল্টার হোমে নিয়ে যায়। কোভিড নেগেটিভ সনদ না থাকায় কোথাও ঠাঁই হয়নি তার। এর মধ্যে নুরজাহানও বারবার তাকে বাইরে যেতে দিতে বলে। একপর্যায়ে পুলিশ তাকে কিছুক্ষণের জন্য থাকা থেকে বের হতে দিলে সে আর থানায় ফেরেনি।
বানজারা থানা পুলিশ বলছে, নুরজাহানের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। তাই তাকে সেভাবে আর খোঁজা হয়নি। তার সঙ্গে থাকা আধার কার্ডও আসল নাকি নকল, সেটিও পরীক্ষা করে দেখেনি পুলিশ।
এদিকে, কুমিল্লার নুরজাহানের মা-বাবার খোঁজও শুরু করে আউটলুক। রাজধানী ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় তাদের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রতিবেদকের কাছে নুরজাহানের বাবা জানান, তার মেয়ে তেজগাঁওয়ের একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ভারতে তার এক চাচার বাড়িতে সে গিয়েছিল, তবে আর ফিরে আসেনি। এখন তারা জানেন না তাদের মেয়ে কোথায় আছে। ইশরাত নামে এক বান্ধবীর সঙ্গে নুরজাহান ভারতে গিয়েছিল বলে জানান নুরজাহানের মা।
মানব পাচার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক
বিএসএফ দক্ষিণ বাংলা ফ্রন্টিয়ারের ১০৭ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার অলক কুমার আউটলুককে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে গরীব ও অসহায় মেয়েদের ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে ভারতে পাচার করে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। একবার এই ফাঁদে পা দিলে সেই মেয়ের জীবন শেষ।’
পাচারের শিকার নারী-শিশুদের একটি আশ্রয়কেন্দ্র চালান হায়দারাবাদের সামাজিক অধিকারকর্মী ড. সুনিতা কৃষ্ণন। তিনি আউটলুককে বলছেন, বাংলাদেশ থেকে হায়দারাবাদে সুপরিকল্পিতভাবে মানবপাচারের ঘটনা বেড়েই চলেছে। কোভিড মহামারি শুরু হওয়ার পর এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত থেকে শুরু করে হায়দারাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত এই পাচার চক্র। নারী-কিশোরীদের পাচারের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
ড. সুনিতা জানান, প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তারা বাংলাদেশ থেকে আসা মেয়েদের সন্ধান পান। বাংলাদেশের তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে গত একবছরে অন্তত ২৬ জন বাংলাদেশিকে তারা ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। আবার গত প্রায় মাসখানেকের মধ্যেই পাচারের শিকার এমন আরও ২৬ জনের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হয়েছে তাদের।
এই পাচার চক্রের তৎপরতা বন্ধে বৃহত্তর উদ্যোগ প্রত্যাশা করছেন ড. সুনিতা। তিনি বলেন, মানবপাচারের মতো আন্তঃরাষ্ট্রীয় অপরাধের বিষয়টি জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) বা জাতীয় সন্ত্রাসবাদবিরোধী টাস্কফোর্সের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। সেটি না হওয়ার কারণে কেবল স্থানীয় কিছু ব্যক্তি ধরা পড়ছে। পাচারের সঙ্গে জড়িত বিশাল নেটওয়ার্কের কারও নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না।
পাচারের শিকার নারীদের নিয়ে কাজ করে থাকে বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। সংস্থাটি বলছে, ঢাকার পুলিশ সদর দফতরের মানব পাচার রোধ সংক্রান্ত মনিটরিং সেলের তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আট বছরে ছয় হাজারের মতো মানবপাচার সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়েছে। এছাড়াও উদ্ধার হয়েছেন ১০ হাজার নাগরিক। এর মধ্যে ১১ শতাংশ শিশু ও ২১ শতাংশ নারী।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার নারী ও শিশুকে ভারতে পাচার করা হয় পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার দরিদ্র শিশু, কিশোরী ও নারীরা এর শিকার বেশি জন। কুমিল্লা, যশোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঝিনাইদহের মতো প্রায় ৩০টি জেলা ভারতের সীমান্তবর্তী। এসব এলাকা থেকেই পাচার বেশি ঘটে থাকে।
যথাযথভাবে তদন্ত করতে না পারা এবং পাচারের শিকার শিশু ও নারীদের দ্রুত শনাক্ত ও উদ্ধার করতে না পারায় পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন।
তিনি বলেন, ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন পাস হয়েছে বাংলাদেশে। এই আইনে বিদেশে পাচার হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনা ও পুনর্বাসনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার নুরজাহানকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং তাকে পর্যাপ্ত আইনি সমর্থন ও নিরাপত্তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে পাচার একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় অপরাধ। তাই পাচারের শিকার ব্যক্তিদের বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা ও তাকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। আমার জানামতে, দুই দেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক রয়েছে। এখন নুরজাহান বা তার মতো পাচারের শিকার অন্য মেয়েদের কতটা সহজে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়, সেটি নির্ভর করবে দুই দেশের কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর।
তাসলিমা আরও বলেন, আন্তঃরাষ্ট্রীয় এই অপরাধ চাহিদা ও সরবরাহের প্রবণতার ওপরও নির্ভরশীল। ভারতের পতিতালয়গুলোতে মেয়েদের চাহিদা রয়েছে। ফলে যৌনকর্মীতে পরিণত করার উদ্দেশ্যেই অনেক মেয়েকে পাচার করা হয়। আমার মনে হয়, সংঘবদ্ধ অপরাধ প্রতিরোধের মানসিকতা নিয়ে এই অপরাধটিকে দেখতে হবে। একটি মেয়ে কেন সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে সেটি নয়, বরং তাকে পাচারের সঙ্গে কে জড়িত সেদিকে বেশি মনোযোগ দিতে বলেই আমি মনে করি।
আউটলুক ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অবলম্বনে রাজনীন ফারজানা
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর