Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মেয়েদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্যের গুরুত্ব ও কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা

সুমিত বণিক
২৮ মে ২০২১ ০০:৩৮

ঋতুস্রাব প্রাকৃতিক ঘটনা ও স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া। অনেকে একে পিরিয়ডও বলে থাকেন। মেয়ে মাত্রই এই মাসিক প্রক্রিয়ার সাথে নিবিড় সম্পর্কে জড়িত। ঋতুস্রাবের মাধ্যমেই একজন নারী গর্ভধারণের প্রাথমিক সক্ষমতা অর্জন করে। শুধুমাত্র তাই নয়,  ঋতুস্রাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে নারীর সারাজীবনের প্রজনন স্বাস্থ্য এবং স্বাভাবিক সুস্থ্যতা। একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর মেয়েদের যোনিপথের মাধ্যমে জরায়ুর অভ্যন্তরীণ আস্তরণ থেকে রক্ত এবং মিউকোসাল টিস্যুর সংমিশ্রণে নিয়মিতভাবে তরল পদার্থ আকারে নৃঃসিত হয়, যা মাসিক বা ঋতুস্রাব নামে পরিচিত। সাধারণত ৯ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে মেয়েদের প্রথম ঋতুস্রাব শুরু হয়।

বিজ্ঞাপন

তবে মেয়েদের নিজস্ব শারীরিক গঠন ও হরমোনের প্রভাবে এই ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার সময়ের তারতম্য থাকে। মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের কাজের সুবাদে জানার সুযোগ হয়েছে যে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকাংশ কিশোরীই জীবনে প্রথমবার ঋতুমতি হওয়ার আগে এ নিয়ে কোন স্পষ্ট ধারণা লাভের সুযোগ পায় না। ফলে তারা জীবনের শুরুতেই ঋতুস্রাব নিয়ে একটি অনাকাঙ্খিত বা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এই বিষয়টির সঙ্গে পরিচিতি হয়। পাশাপাশি স্বাভাবিক এই প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে নেতিবাচক অভিজ্ঞতারও মুখোমুখি হয়। কখনো কখনো শুরুর সময়ে এই নেতিবাচক অভিজ্ঞতাটি তাকে ঋতুস্রাবের মত একটি স্বাভাবিক বিষয় সম্পর্কে একটা দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অসুস্থতা তৈরি করে। প্রায় দুই বছরের অধিক সময় ধরে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় কিশোরী ও নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের পাশাপাশি ঋতুস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছি। ইতোপূর্বে কাজের সুবাদেই হাওর অঞ্চলসহ বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রত্যন্ত এলাকায় মাঠ পর্যায়ে কাজের সুযোগ পেয়েছি। এসব অভিজ্ঞতায় আমার উপলব্ধি পাহাড় কিংবা সমতল নির্বিশেষে নারীর জীবনের ঋতুস্রাব প্রক্রিয়ার ঘটনা বা তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো প্রায় একই রকম। তবে এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং দুর্গমতার ভিন্নতা অনুযায়ী প্রেক্ষাপটগুলো আরও বেশি করুণ হয়ে থাকে। এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপকরণ ব্যবহার ও স্বাস্থ্য পরিচর্যার রীতিতে অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত এক সূত্রের তথ্য মতে, বিশ্বব্যাপি প্রতিদিন প্রায় ৮০০ মিলিয়ন নারীর ঋতুস্রাব হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য মতে, একজন মেয়ের ঋতু শুরুর গড় বয়স হচ্ছে ১২ এবং এই প্রক্রিয়া শেষ বা মেনোপজ শুরু হওয়ার গড় বয়স হলো ৫১ বছর। আর প্রতি মাসে একজন কিশোরী বা নারীর ঋতু চলাকালীন সময় ২ থেকে ৭ দিন। আর এই কয়দিনই তাকে বিভিন্ন ধরনের কষ্টকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে চলতে হয়। ধরে নেওয়া যায়, একজন নারী বেঁচে থাকা অবস্থায় প্রায় ৩৯ বছর এই স্বাভাবিক ও নিয়মিত শারীরিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চললে, তাকে তার পুরো জীবনে প্রায় ৪৬৮ বার এই অভিজ্ঞতার সম্মুক্ষীণ হতে হয়। বিষয়টি ভিন্নভাবে বললে, বলা যায় একজন নারী তার পুরো জীবনে প্রায় ৩ হাজার দিন এই মাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন, যেটাকে বছরে হিসাব করলে দেখা যায় প্রায় ৮ বছর।

এই হিসাবটি মূলত একটি গড় চিত্র। এই সংখ্যাটি নির্ভর করে নারীর জীবনাচরণ, পারিপার্শ্বিক  অবস্থা, দৈহিক গঠন, খাদ্যাভ্যাস, এবং হরমোনের প্রভাবের উপর। মোটকথা আমরা মোটামুটি সংখ্যাতাত্ত্বিক একটা গড় সময়ের হিসেবে বোঝা যায় ঋতুস্রাব একজন নারীর জীবনে কতটা সময় ধরে ও কত ঘনিষ্ঠভাবে মিশে আছে।

অস্বাস্থ্যকর ঋতুকালীন স্বাস্থ্য পরিচর্যা, স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলির অসহজলভ্যতা এবং দুর্বল স্যানিটেশন অবকাঠামো সমগ্র বিশ্বের নারী ও মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিকভাবে সামাজিক অবস্থানকে বাধাগ্রস্থ করছে। ফলস্বরূপ, বিভিন্ন বয়সের লাখ লাখ নারী তাদের সম্পূর্ণ সম্ভাবনার বিকাশ করতে পারছেন না। নীরবতা ভেঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এবং ঋতুস্রাবের সঙ্গে সম্পর্কিত চারপাশের বিদ্যমান এই নেতিবাচক সামাজিক নিয়মগুলো পরিবর্তন করতে বিশ্বব্যাপী ২৮ মে বিশ্ব ঋতুকালীন স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ২০১৩ সালে জার্মানভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াশ ইউনাইটেড’ কর্তৃক এই দিবসটি পালন করা শুরু হয়েছিল। ২০১৪ সালে প্রথম উদযাপনের পর থেকে সারা বিশ্বে এই দিবসটি পালনের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০২১ সালে এ দিবসটি পালনে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ও পরিচর্যার জন্যে প্রয়োজন আরও কার্যকর উদ্যোগ ও বিনিয়োগ।’

যে বিষয়টি উৎকন্ঠার, সেটি হলো ঋতুকাল ঘিরে এখনো রয়েছে নানা কুসংস্কার ও বদ্ধমূল ধারণা। যেগুলো নারীর জীবনের সার্বিক সুস্থতাকে অনেক ক্ষেত্রেই বাধাগ্রস্থ করে। কোভিড-১৯ এর মতো অতিমারি এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াকে আরও কঠিন করে তুলছে। কারণ, এই মহামারির সময়েও ঋতুস্রাবের মত প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া থেমে থাকে না। বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলের মতো পশ্চাৎপদ এলাকার কিশোরী ও নারীদের জন্য এটি বড় সমস্যা। জ্ঞান বিজ্ঞানের যথেষ্ট বিকাশ ঘটা স্বত্ত্বে পাহাড়ি জনপদে নারীর ঋতুকালীন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা খুবই নাজুক অবস্থায়। তবে বাস্তব কর্ম অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যারা পড়াশোনা, জীবিকার তাগিদে শহরমুখী হয়েছেন, তাদের মধ্যে সচেতনতার জায়গাটা কিছুটা হলেও সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে।

আশার কথা হল, তিন পার্বত্য জেলায় ইউরোপিয় ইউনিয়নের অর্থায়নে সিমাভি নেদারল্যান্ডস্ ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস) এর সহায়তায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ১০টি সহযোগী স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় আওয়ার লাইভস্, আওয়ার হেলথ্, আওয়ার ফিউচারস্ (আওয়ারএলএইচএফ) প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১২ হাজার কিশোরী ও যুবতী নারীকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ, কমিউনিটি পর্যায়ে মা, বাবা, পরিবারের ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরকে সম্পৃক্ত করে ঋতুস্রাব বিষয়ে বদ্ধমূল ধারণা ও কিশোরী এবং নারীদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য সমন্বিতভাবে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

তাছাড়া ঋতু সংক্রান্ত বিধিনিষেধের কারণে নারী ও কিশোরীরা কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। এগুলো ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কার বা সামাজিক প্রথা আছে, যা একজন নারীকে একজন মানুষ হিসেবে প্রাপ্য অধিকার ভোগ করা থেকে বঞ্চিত করে। ঋতুস্রাব সংক্রান্ত প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি অন্ধ বিশ্বাস, নিয়ম ও বিধিনিষেধ নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণকে প্রভাবিত করে। স্কুলে, কর্মস্থলে, বা বিভিন্ন স্থানের কর্মকান্ডে নারীর স্বাভাবিক ও সক্রিয় অংশগ্রহণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এর ফলে সে শুধু শারীরিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হয় না, মানসিকভাবেও হীনমন্যতায় ভোগে। সুতরাং আমরা দেখতে পাই, প্রতি মাসেই চলমান একটি স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া নিয়েও আমরা পরিবার বা সমাজে কোনো আলোচনা করি না। সেই সাথে বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতে এটি নিয়ে বিশেষ কোনো কার্যকর সেবা বা কাউন্সেলিংয়ের সুব্যবস্থাও নেই।

অথচ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে পরিবার, সমাজ, স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে আরো বেশি বেশি করে আলেচনা ও সেবার সুযোগ তৈরি করা দরকার। এ সময় নারীদের সহযোগিতা করা উচিত, যেন তারা সঠিকভাবে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ব্যাবস্থাপনা করার ব্যাপারে সংকোচবোধের বদলে উৎসাহিত হয়। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোন এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ। তাই ঋতুকালীন স্বাস্থ্যের পরিচর্যার অনুকুল পরিবেশ, স্বাস্থ্যসম্মত এবং নিরাপদভাবে ঋতুকালীন ব্যবস্থাপনার জন্য এখনই সময় প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং যথাযথ বিনিয়োগ করার।

আমরা স্বপ্ন দেখি, কোন কিশোরী বা নারীর জীবন ঋতুকালীন স্বাস্থ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে বিপন্ন হবে না। সেই সঙ্গে একজন নারী তার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ পরিচর্যার বিষয়টি স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ও মর্যাদার এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সাথে সম্পন্ন করতে সমর্থ হবে। আর এ কাজে সামাজিক বিদ্যমান কুসংস্কার ও সামাজিক রীতি-নীতিগুলো পরিবর্তিত হয়ে নারীর জন্য স্বাস্থ্যবান্ধব হবে। এজন্য সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সমাজের সচেতন মানুষের আন্তরিক অংশগ্রহণ, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং গণমাধ্যমের সংক্রিয় ভূমিকার বিকল্প নেই।

লেখক- বেসরকারি অধিকার ভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মর

সারাবাংলা/আরএফ/

ঋতুকালীন সুস্থতা ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ঋতুস্রাব

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর