নারী উন্নয়নে বরাদ্দ কম, কিন্তু সেটুকুও খরচ হয় না
১০ জুন ২০২১ ০২:৪২
নারী ও শিশুর জন্য বাজেটে বরাদ্দ থাকে কম। আবার যা থাকে সেটুকুও খরচ হয় না। গতবছরের বাজেটের এমন চিত্র তুলে ধরে এবারের বাজেটে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে গুণগত বরাদ্দের প্রতি জোর দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
বুধবার (৯ জুন) বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে ‘বাজেট পরবর্তী’ সংবাদ সম্মেলন এসব কথা তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শরমিন্দ নিলোর্মী। এসময় তিনি বলেন, ‘মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য গতবছর ৬৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও তার সবটুকু খরচ হয়নি যা এটা ন্যায্য নয়। বাজেট ঘাটতি হলেও প্রয়োজনীয় ব্যয় করতে হবে নাহলে সরকারের ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পাবে, দরিদ্র্যদের উপর করের বোঝা বাড়বে।’
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে ২০১৯-২০২০ ও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন না দেওয়ায় বিস্ময় ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। পাশাপাশি জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন আকারে উপস্থাপনের মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মসূচিতে নারীর জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণের নীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানানো হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘ই-কমার্স, মোবাইল ব্যাংকিং ভিত্তিক সেবার উপর কর আরোপ করায় নারী উদ্যোক্তা যারা ঘরে বসে কাজ করছে তাদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জেন্ডার বাজেট কার্যকর করতে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে জেন্ডার সংবেদনশীল কাঠামো তৈরি, জেন্ডার ডিসি এগ্রিগেটেড ডাটা সংগ্রহের প্রতি জোর দিতে হবে।
প্রণীত হতে যাওয়া শিশু দিবাযত্ন নীতি ২০২১ এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিখাত ও অন্যান্য খাতকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনার দাবি জানান অধ্যাপক সায়মা। পাশাপাশি তিনি বলেন কোভিড পরিস্থিতিতে নারীরা যারা কাজ হারিয়েছেন তাদের জন্য স্বল্প সুদে বা সুদবিহীন এককালীন অর্থ সহায়তা দেওয়া যেতে পারে ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘জেন্ডার বাজেট বই বের না হলেও নারীর জীবনযাপনের কল্যাণে, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে, গৃহীত প্রকল্পের অগ্রগতির মূল্যায়নের একটা সংক্ষিপ্ত খতিয়ান প্রকাশ করতে হবে।’
শরমিন্দ নিলোর্মী আরও বলেন, ‘২০২০ এ কোভিড পরিস্থিতির পর আর জেন্ডার বাজেট প্রকাশিত হয় নি। এবছরেও প্রণয়ন করা হবে ভাবলেও দেওয়া হয়নি। একারণে নারীর জন্য প্রকল্পগুলো থেকে কি সুবিধা পাওয়া যাবে এটা এখন আর জানা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের জন্য থাকা বরাদ্দ এবার কমেছে। স্টিমুলাস প্যাকেজে গতবছর ৫ শতাংশ নারীদের দেওয়া কথা বলা হলেও এর বেশি দিতে সরকারের পক্ষ থেকে কোন বাধা নেই। কিন্ত বাস্তবে দেখা গেছে ব্যাংকগুলোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। জমিতে ছোট ছোট যন্ত্রপাতির ব্যবহারে নারীদের সুযোগ পেতে পরিবারভিত্তিক কৃষক কার্ড দিতে হবে, ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারাল এক্সটেনসনকে নারী কৃষাণীদের সুবিধা দিতে আরও কাজ করতে হবে।’
সভায় বক্তারা আরও বলেন জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন থেকে কেন সরকার সরে আসলেন তা পরিষ্কার নয়। কোভিডকালীন সময়ে নারীর প্রতি অভিঘাত আরও বেশি হয়েছে। তাই কোভিড মোকাবেলায় জেন্ডার ইস্যুকে গুরুত্ব দিতে হবে, নারীর নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বস্তির নারীদের জন্য সহায়তা দিতে হবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির জন্য সুদ ছাড়াই এককালীন অর্থ সহায়তা দিতে হবে। কেয়ার অর্থনীতির জন্য পলিসি ও নীতিগত সহায়তা দেওয়া যেতে পারে।
এসময়ে তারা শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্যে অগ্রগতির কথা বলা হলেও নারীর প্রতি যে অবহেলা তা কমেছে কিনা, নারীর জন্য থাকা ঋণ সুবিধা তারা কতটুকু পায়, সেটা মনিটরিং করা হচ্ছে কি-না তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
আবার এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম কমানো হলেও তা প্র্রান্তিক নারীর কাছে পৌঁছাবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ থেকেই যায়। তাই বক্তারা এসময় প্রান্তিক ও সরকারি বিভিন্ন প্রজেক্টে কর্মরত নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যাবহারে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে সাবসিডি দেওয়ার দাবি জানান।
মডারেটর হিসেবে উপস্থিত সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘বাজেট হল আর্থিক ক্ষতিয়ান। যেকোন দেশের উন্নতির জন্য নারীর অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ, ও রাষ্ট্র নারীকে সহায়তা করছে তবে নারীর অংশীদারিত্বের খতিয়ান বাজেটে কোথাও দেখিনা। এর স্বীকৃতি দিতে হবে। জেন্ডার বাজেটের এর ধারাবাহিক পরীবীক্ষণ মূল্যায়ন করতে হবে; প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। মহিলা মন্ত্রণায়লকে সহিংসতা প্রতিরোধে আরও তৎপর হতে হবে যাতে বাজেট বরাদ্দ ব্যয় যথাযথ হয়। সেফটি নেট প্রোগ্রামের বরাদ্দ কোথায় কিভাবে হচ্ছে তা দেখতে হবে।’
এছাড়াও শিক্ষায় নারীর ঝরে পড়ার হার ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে রোধে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও শিক্ষামন্ত্রণালয়কে আরও সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাতকে পুরোপুরি ঢেলে সাজিয়ে নারীর জন্য স্বাস্থ্য কমিশন তৈরি এবং তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় নিয়ে আসার দাবি জানান।
সভা সঞ্চালনা করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত আন্দোলন সম্পাদক রেখা চৌধুরী।
সারাবাংলা/আরএফ/