নারীবাদী কণ্ঠস্বর রুথ বেডার গিন্সবার্গ
১ জুলাই ২০২১ ১০:৩২
নেটফ্লিক্সে ‘অন দ্যা বেসিস অফ সেক্স’ সিনেমাটি দেখলাম। সিনেমাটি যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং দ্বিতীয় নারী বিচারপতি রুথ বেডার গিন্সবার্গের জীবনকাহিনী নিয়ে তৈরি। সিনেমাটি দেখার পর বিশদভাবে তাকে জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ফলে রুথকে নিয়ে তৈরি ডকুমেন্টারি এবং সাক্ষাৎকারগুলো দেখতে চেষ্টা করি। রুথ বেডার গিন্সবার্গকে গভীরভাবে জানার আগ্রহ আমার মধ্যে তৈরি হওয়ার কারণ, তাঁর একনিষ্ঠতা, একাগ্রতা এবং প্রবল আত্মবিশ্বাস, যা মানুষকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। রুথ গিন্সবার্গও এগিয়ে গেছেন তাঁর কঠিন এবং আদর্শিক ব্যক্তিত্ব দিয়ে। একজন গুরুত্বপূর্ণ নারীবাদী হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীদের শীর্ষ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন।
‘অন দ্যা বেসিস অফ সেক্স’ মুভির চুম্বক অংশ ছিল এক অবিবাহিত বয়স্ক পুরুষের পক্ষে আইনি লড়াইয়ের ঘটনা। পুরুষটির নাম চার্লস মরিটস। বাড়ি আমেরিকার ডেনভারে। সময়কাল সত্তরের দশক। চার্লসের মা বয়সের ভারে শারীরিক এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাকে দেখাশোনা করার জন্য সার্বক্ষণিক একজন পাশে থাকা প্রয়োজন। কিন্তু চার্লসের পক্ষে তা সম্ভব নয়। কারণ তাকে জীবিকার জন্য কাজে যেতে হয়। এমতাবস্থায় মাকে দেখভালের জন্য একজন নার্স নিয়োগ করেন। এক্ষেত্রে কেয়ারগিভার বা সেবা শুশ্রূষাকারী ব্যক্তি হিসেবে চার্লসের কর পরিশোধের ক্ষেত্রে কিছু ছাড় বা সুবিধা পাওয়ার কথা। মার্কিন কর আইনে সেই সুবিধা আছে। কিন্তু চার্লস সেই সুবিধা পাচ্ছিলেন না। কারণ আইনে বলা আছে, কেয়ারগিভার হবেন একজন নারী। যেহেতু চার্লস পুরুষ, সেহেতু তিনি এই সুবিধা পাবেন না। তখন রুথ বেডার গিন্সবার্গ কেইসটি হাতে নেন এবং শেষপর্যন্ত এই বিষয়ে আইনি লড়াইয়ে তিনি সাড়া ফেলেছিলেন। চার্লস মরিটসের প্রসঙ্গটি তিনি আদালতে এনে প্রমাণ করেছিলেন যে, আইনে লিঙ্গ বৈষম্য বিরাজমান। আইন নারী ও পুরুষকে সমান চোখে দেখছে না। নাহলে চার্লস মায়ের কেয়ারগিভার হিসেবে করের সুবিধা পেত। সেই বৈষম্যমূলক আইনকে চ্যালেঞ্জ করে গিন্সবার্গের জিতে আসার ঘটনা নিয়ে ‘অন দ্যা বেসিস অফ সেক্স’ মুভির মূল কাহিনী, যেখানে বোঝা গেল, আইনে সব নাগরিকের সমান অধিকার থাকলেও বাস্তবে তা প্রয়োগ হয় না। এভাবে গিন্সবার্গ আইনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
১৯৩৩ সালের ১৫ মার্চ, নিউ ইয়র্কে রুথ বেডার গিন্সবার্গ জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন রাশিয়ার ইহুদি শরণার্থী। আইন নিয়ে পড়ার পরিকল্পনা তার ছিল না। ১৯৫৪ সালে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগে স্নাতক হন। স্নাতক স্তরে তৃতীয় বর্ষ চলাকালীন তিনি সিদ্ধান্ত নেন আইন নিয়ে পড়বেন। সেসময় যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েতের রাজনৈতিক সম্পর্ক খুবই খারাপ ছিল। এমন পরিস্থিতিতে মৌলিক অধিকারের পক্ষে বেশ কিছু আইনজীবী সরব হয়েছিলেন, যা তাকে আইনজীবী হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। মেয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করবে, তাতে একদমই মত ছিল না বাবা-মায়ের। কেননা আইনজীবী একজন পুরুষের পেশা। তবুও এই অসম লড়াইতেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় মহিলা বিচারপতি হয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন বৈষম্যের বিরুদ্ধেও আসে জয়। পরবর্তীতে রুথ বেডার গিন্সবার্গ যুক্তরাষ্ট্রের লিঙ্গবৈষম্য এবং নারীবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ হয়ে উঠলেন।
কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে আলাপ হয় মার্টিন গিন্সবার্গের সঙ্গে। তার সঙ্গেই ১৯৫৪ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। রুথের ভাষায়, ‘মার্টি ছিলেন সেই যুবক, যিনি বুঝেছিলেন, আমার বুদ্ধি আছে’। যেখানে মহিলাদের সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি, বুদ্ধিকে নয়। কিন্তু মার্টিন গিন্সবার্গ রুথের ব্রেইনের গুরুত্ব দিতে গিয়ে সবরকম সহযোগিতা করেছিলেন। তাছাড়া মার্টিন নিজেও একজন নিউ ইয়োর্কের নামকরা ট্যাক্স লইয়ার ছিলেন। রুথ হার্ভার্ড ল’ স্কুল-এ পড়তে যান স্বামী এবং শিশুসন্তান নিয়ে। কলম্বিয়া ল’ স্কুল থেকে যুগ্মভাবে প্রথম হয়ে আইনের পাঠ শেষ করেন। পাঁচশো ছাত্রের সঙ্গে নয়জন ছাত্রীর সেই শিক্ষা অভিযানের শুরু হয়েছিল। তখন হার্ভার্ডের ডিন ছাত্রীদের ডিনারে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ছেলেদের জায়গা দখল করে হার্ভার্ডে পড়তে এসেছ কেন?’ বাধা যত এসেছিল রুথ তত চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আইন নিয়ে পাশ করার পরে প্রথম হোঁচট খেতে হয় চাকরি খুঁজতে গিয়ে। ‘মহিলা’ আইনজীবী হিসেবে রুথের পক্ষে কাজ পাওয়া সে যুগে প্রায় অসম্ভব ছিল। ‘পুরুষ অধ্যুষিত’ প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। বার বার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদন করেও তাকে ফিরে আসতে হয়েছিল।
কর্মজীবনের শুরুতে রুথ ছিলেন সহকারী গবেষক। একটি চাকরি পাওয়ার জন্য খুব দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তাকে। তিনি নারী বলে ১৯৬০ সালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ফেলিক্স ফ্রাঙ্কফারটার তাকে মুহুরির কাজে নিয়োগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। অথচ তাকে সুপারিশ করেছিলেন হার্ভার্ডের ডিন প্রফেসর অ্যালবার্ট মার্টিন স্যাক্স। এরপর কলম্বিয়ার আইনের প্রফেসর জেরাল্ড গান্থার বিচারপতি এডমান্ড পালমেরিকে জোর দেন রুথকে চাকরি দেওয়ার জন্য। অবশেষে পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে কম বেতনে সেই চাকরিটি তিনি পেয়ে যান। স্বাধীন এবং দৃঢ়চেতা রুথের সাফল্যের দৌড় সেখান থেকেই শুরু।
১৯৬৩ সালে রুতগার্স ল’ স্কুলে অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন রুথ। কিন্তু বৈষম্যের ছায়া পিছু ছাড়েনি সেখানেও; এমনকি বেতনও কম ছিল। তবে এই সমতা ফেরানোর জন্যই ১৯৭০ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘ওইমেন’স রাইট ল’ রিপোর্টার’ পত্রিকা, যা প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৭২ সালে রুথ বেডার প্রতিষ্ঠা করেন নারী অধিকার প্রকল্প। যুক্তরাষ্ট্রের একপেশে সমাজ ব্যবস্থা এবং আইনের খোলনলচে বদলে ফেলাই ছিল তার একমাত্র উদ্দেশ্য। সুপ্রিম কোর্টেও তিনি সেই সময় মামলা করেন সংবিধান থেকে লিঙ্গবৈষম্যকে সরিয়ে ফেলার আবেদন নিয়ে।
১৯৭২-এ রুথ ‘আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ় ইউনিয়ন’-এর ‘নারী অধিকার প্রকল্প’-এর জেনারেল কাউন্সেল হলেন। তার তিনশোর বেশি মামলার মধ্যে শীর্ষ আদালতে গিয়ে লড়া ছ’টি মামলার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সমানাধিকারের সংগ্রামের ময়দান হিসেবে রুথ বেছে নিয়েছিলেন আদালত কক্ষকেই। কারণ শুধু নারীর নয়, সকল নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার দাবি করতেন তিনি। যে আইন ‘আপাত ভাবে মহিলাদের জন্য হলেও আসলে পুরুষের উপর নির্ভরতা বাড়ায়’, তাকে বদলাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। তাই শুশ্রূষাকারী পুরুষ অথবা বিপত্নীক ব্যক্তির অধিকার নিয়েও সওয়াল করেছেন। মহিলাকর্মীর সম-পারিশ্রমিকের অধিকার, মেয়েদের স্বাস্থ্য, গর্ভপাতের অধিকার ইত্যাদি নিয়ে গিন্সবার্গের সিদ্ধান্ত আইনের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। আন্তর্জাতিক আইন, জনজাতি সংক্রান্ত আইনেও স্বচ্ছন্দ ছিলেন। ‘সেক্স’ শব্দকে সরিয়ে আদালতে উচ্চারণ করেছেন ‘জেন্ডার’। দেশের প্রথম সমলিঙ্গ বিয়ের হোতা ছিলেন তিনি।
রুথের লেখা প্রথম বইটাই বেস্টসেলার— মাই ওন ওয়ার্ডস। তিনি ‘মি টু’ আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ‘হল অব ফেম’-এ স্থান করে নিয়েছেন এবং একাধিক ‘সাম্মানিক ডক্টরেট’ পেয়েছেন। ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার রুথকে কলম্বিয়ার ‘কোর্ট অব অ্যাপিলস’-এর বিচারপতি নিযুক্ত করেন। ১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তার নাম প্রস্তাব করেন এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। রুথ গিন্সবার্গ ছিলেন আমেরিকার শীর্ষ আদালতের দ্বিতীয় মহিলা বিচারপতি। প্রায় দেড় দশক ধরে সুপ্রিম কোর্টই রুথের কাজের জায়গা হয়ে ওঠে। আমৃত্যু দীর্ঘ ২৭ বছর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসাবেই কাজ করেছেন। চেয়েছিলেন আসন্ন নির্বাচনে নতুন রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতায় দেখে স্বেচ্ছাবসর নেবেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের বিজয় দেখে আর যেতে পারেননি। নির্বাচনের আগেই থেমে গেলো রুথের হৃদস্পন্দন। ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০-এ বিদায় নিলেন রুথ বেডার গিন্সবার্গ। চলে যাওয়ার আগে, তিনি শিখিয়ে গেলেন ন্যায়বিচার এবং অধিকারের জন্য অক্লান্তভাবে কিভাবে লড়ে যেতে হয়।
সঙ্গীতপ্রেমী রুথকে আইনের ছাত্ররা আদর করে ডাকত ‘ডাকসাইটে আরবিজি’। বুশ বনাম গোর-এর মামলায় সংখ্যাগুরুর উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে ‘রেসপেক্টফুলি’ উড়িয়ে দিয়ে বুক ঠুকে বলেছিলেন, ‘আই ডিসেন্ট!’ ভিন্নমত পোষণের সাহসই গিন্সবার্গকে সব দেশের সংবিধান ও স্বাতন্ত্র্যপ্রেমী নাগরিকের সামনে দৃষ্টান্তের মতো দাঁড় করিয়েছে। নিজের কারুকাজ করা গলাবন্ধের নাম দিয়েছিলেন ‘বিরোধী কলার’। তার শরীরে দু’বার ক্যানসার বাসা বেঁধেছিল। প্রিয় মার্টি-র প্রয়াণের দিনেও আদালতে গিয়েছিলেন। প্রয়াত যোদ্ধার এই লড়াইকেই শ্রদ্ধা জানাতে হাজারো মানুষ মোমবাতি আর প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছিল শীর্ষ আদালত প্রাঙ্গণে। সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকেও দাঁড়াতে হয়েছিল।
নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ রুথ বেডার গিন্সবার্গ তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ দিয়ে উন্মোচিত করে গেছেন আরও অনেক নারীর পথ। তাকে আজ অনুসরণ করছে বিশ্বময় লক্ষ লক্ষ নারী। রুথ এমন সময় আইন পেশাতে তার কর্মজীবন শুরু করেন যখন নারীদের এই পেশাতে যাওয়ার কোনো সুযোগ বা বলা যায় সাহস ছিল না। কেননা সেই জায়গাটি ছিল পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে, তাকে সামনে এগিয়ে দেন তার স্বামী মার্টিন গিন্সবার্গ। রুথ সম অধিকার, নারী অধিকার নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে নানা সময়ে তর্ক করে জয়ী হয়ে ফিরে এসেছেন এবং সেই জয় ছিল সমগ্র নারী জাতির জয়। ‘অন দ্যা বেসিস অফ সেক্স’ মুভিটি দেখার পর থেকে রুথ বেডার গিন্সবার্গকে নিয়ে ভাবছি, সেই সঙ্গে খুঁজে বেড়াচ্ছি বাংলাদেশের কোনো নারী আইনজীবীকে, যিনি নারী অধিকার নিয়ে লড়াই করেছেন এবং নতুন কোনো আইন নারীর জন্য তৈরি করেছেন! জানি না, তেমন নারী আইনজীবী কেউ আছেন কিনা, অর্থাৎ রুথ বেডার গিন্সবার্গের মতো! তবে লড়াই করতে হলে রুথ বেডারের মতো লড়তে হবে, এটাই বিশেষভাবে বুঝি এবং তিনি আমাদের কাছে চিরকালের অনুসরণীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক
সারাবাংলা/আরএফ/আইই