Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘ঘটনা সত্য’ নাটক নির্মাণ একটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ!

তাওহিদা জাহান শান্তা
২৭ জুলাই ২০২১ ০০:২৭

নাটকে আমাদের চারপাশের সামাজিক জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। সম্প্রতি আলোচিত ঈদের নাটক ‘ঘটনা সত্য’ও এর ব্যতিক্রম নয়। এই নাটকে যে বার্তা দেওয়া হয়েছে তার মাধ্যমে আমাদের সমাজের একটি চরম বিকারগ্রস্ত প্রতিচ্ছবিই ফুটে উঠেছে। অথচ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে আমাদের একটি প্রতিবন্ধীবান্ধব সমাজ বিনির্মাণ করার কথা ছিল। যে পরিবারগুলো আপনজনের প্রতিবন্ধকতাকে হাসিমুখে মেনে নিয়ে অসীম দুঃখ পথে নিত্য সংগ্রাম করে চলেছেন তাদের হৃদয়ের যে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে ‘ঘটনা সত্য’ নাটক- তার জন্য কোন ক্ষমা নেই। বাংলা ভাষার অভিধানে তাদের ক্ষমা চাওয়ার বা ক্ষমা করে দেবার মত কোন ভাষা নেই।

বিজ্ঞাপন

উল্লেখ্য, ঈদের বিশেষ নাটক ‘ঘটনা সত্য’ চ্যানেল আইয়ে প্রচারের পর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল মিউজিক অ্যান্ড ভিডিও (সিএমভি)-র ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হয়। মঈনুল সানুর চিত্রনাট্যে নাটকটি নির্মাণ করেন নির্মাতা রুবেল হাসান; প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন আফরান নিশো ও মেহজাবীন চৌধুরী। প্রকাশের পর নাটকটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। ‘ঘটনা সত্য’ নাটকটি দেখার পর আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই মর্মাহত হই। আমি নাটকের নির্মাতা রুবেল হাসানের ফেসবুক পেইজে এই নাটক নিয়ে তীব্র নিন্দা জানাই এবং অনতি বিলম্বে নাটকটি অপসারণ পূর্বক ক্ষমা চাওয়ার জন্য আবেদন করলে তিনি জবাবে জানান, ‘জ্বী আমি আন্তরিকভাবে দু:খিত। নাটকটির সংশোধনের কাজ চলছে। মানুষ মাত্রই ভুল করে। আপনারা আমাদের ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন। সকল পিতামাতার প্রতি সম্মান রেখে আমরা আমাদের ভুল সংশোধন করছি। আমাকে ক্ষমার সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।’

বিজ্ঞাপন

তখনও পর্যন্ত তারা প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার কোন বিবৃতি দেননি। পরবর্তীতে ঘন্টা দুয়েক পরে ফেসবুকের ভেরিফাইড পেইজ থেকে নাটকে বিশেষ শিশুদের বাবা-মায়ের ‘পাপ কর্মের ফল’ বলে বার্তা দেওয়ার অভিযোগের বিষয়টি ‘একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত’ ভুল বলে দুঃখ প্রকাশ করে ‘ঘটনা সত্য’ নাটকের নাট্যকার, পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পী এবং কলাকুশলীদের পক্ষ থেকে একটি যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ঘটনা সত্য’ নাটকের নাট্যকার, পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পী এবং কলাকুশলীদের পক্ষ থেকে আমরা গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। আপনাদের অনেকেই জানিয়েছেন, এ নাটকের মাধ্যমে ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগটির সাথে আমরা সহমত পোষণ করছি। বিষয়টি একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। যারা আমাদের নাটক ‘ঘটনা সত্য’র এ বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেছেন, সবাইকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাই। প্রথম বার্তা পাবার পরপরই আমরা উপলব্ধি করি, অসাবধানতাবশতঃ নাটকে আমরা ভুল একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলাম। এরপর আমরা সঙ্গে সঙ্গেই নাটকটি ইউটিউব থেকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেই। প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর নাটকটি পুনরায় আবারো পরবর্তীতে প্রকাশ করা হবে। সবশেষে প্রত্যেক বাবা-মা ও সন্তানের প্রতি আমাদের ভালোবাসা জানাই। সেই সাথে, ভবিষ্যতে এমন প্রযোজনা তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যা সঠিক বার্তা সমাজে ছড়িয়ে দেয় এবং দর্শকদের সঠিক পথে পরিচালিত করে। আপনাদের অমূল্য সহায়তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।‘বিবৃতির সঙ্গে নাটকটির অভিনেতা আফরান নিশো, অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী, পরিচালক রুবেল হাসান, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিএমভি নাম সংযুক্ত করা হয়।

‘ঘটনা সত্য’ নাটকের কলা-কুশলীদের বিবৃতি আমাকে দ্বিতীয়বারের মত ব্যথিত করে। নাটকের কলা-কুশলীদের বিবৃতির দিকে লক্ষ করুন, যে নাটকের পটভূমি রচিত হয়েছে ‘প্রতিবন্ধী শিশু বাবা মায়ের পাপের ফল’ সেই নাটক নিয়ে গণ প্রতিবাদের মুখে একেবারে দায়সারাভাবে নাটক বিষয়ে যে ‘অসাবধানতাবশত নাটকে আমরা ভুল একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলাম’, ‘বিষয়টি একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত’- এই ক্ষমার ভাষা কতখানি গ্রহণযোগ্য?

নাটকের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে বাবা-মায়ের অন্যায়-অপরাধকে ঘিরে এবং এর কাহিনীর ইতি টানা হয়েছে সেই বাবা-মায়ের একটি বিশেষ শিশু জন্ম দেবার মাধ্যমে। যেখানে নিজেদের পাপের বা কর্মের ফল হিসেবে এই শিশুর আগমনে তাদের মধ্যে অনুশোচনা দেখা গেছে। এখানেই শেষ নয়, সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, নাটকের শেষে নেপথ্য কন্ঠে বলা হয়েছে, ‘মা-বাবা তাদের নিজেদের পাপের ফল পেয়েছেন’। অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ পা নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুটিকে বাবা মায়ের পাপের ফল হিসেবে দেখানোর ষোলকলা পূর্ণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এমনকি শেষে বলা হয়েছে- ‘ঘটনা সত্য! কী ভয়ংকর অবস্থা!’— এই বার্তা কখনোই অসাবধানতাবশত বা অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল হতে পারে না। সচেতনভাবেই এই নাটকের পটভূমি নির্মিত হয়েছে। কলা-কুশলীদের বিবৃতিতে যে ভুল বার্তার জন্য ক্ষমা চাওয়া হয়েছে সেটি একটি বা দুটি সংলাপ হলে হয়তো ক্ষমার প্রসঙ্গ আসতে পারত। যে পুরো নাটকটি নির্মাণ করা হয়েছে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ধর্মান্ধ, অবৈজ্ঞানিক ভিত্তি ও সমাজের একটি বিশেষ মানব সম্প্রদায়কে ছোট করে সেই নাটক নির্মাণের জন্য কোন ক্ষমা নেই। যিনি তার বিকারগ্রস্ত মস্তিষ্ক থেকে এই নাটক লিখেছেন তার কোন ক্ষমা নেই! যিনি এই নাটকের চিত্রনাট্য পরিচালনা করেছেন তার কোন ক্ষমা নেই! যিনি এই নাটক পরিচালনা করেছেন তার কোন ক্ষমা নেই! যারা এই নাটকে অভিনয় করেছেন তাদের কোন ক্ষমা নেই। আমরা এমন অনুর্বর মস্তিষ্কের তোতা পাখি অভিনেতা-অভিনেত্রী চাই না। আমরা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিএমভিকে এর জন্য কোন ক্ষমা করতে পারি না! ঈদের বিশেষ নাটক হিসেবে যে টেলিভিশন চ্যানেল ‘চ্যানেল আই’ এই নাটকের প্রচার করেছে তাদের জন্য আমাদের কাছে কোন ক্ষমা নেই। যে সরকারী প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’ এই নাটকের অর্থ সাহায্য করেছে সেই প্রতিষ্ঠানের জন্যেও কোন ক্ষমা নেই!

আমরা দৃঢ় চিত্তে বলতে চাই, ‘ঘটনা সত্য’ মনগড়া, বানোয়াট, ভিত্তিহীন, অবৈজ্ঞানিক একটি নাটক। যেখানে প্রতিবন্ধকতা আছে যে শিশু ও মানুষদের তাদের মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার প্রবর্তিত ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’- এর ৩৭(৪) ধারায় স্পস্ট উল্লেখ রয়েছে যে, ‘কোন ব্যক্তি, পাঠ্যপুস্তকসহ যে কোন প্রকাশনা ও গণমাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিবন্ধী ব্যাক্তি বা প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে নেতিবাচক, ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর ধারণা প্রদান বা নেতিবাচক শব্দের ব্যবহার বা ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যঙ্গ করা হইলে উহা এই আইনের অধীনে অপরাধ হইবে এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক তিন বছরের কারাদন্ড বা অনধিক পাঁচ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দন্ডে দণ্ডিত হবেন।‘

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সঙ্গে লেখক

সুতরাং, আমরা ‘ঘটনা সত্য’ নাটকে প্রতিবন্ধিতা সর্ম্পকে যে ধরনের অযৌক্তিক ও নেতিবাচক বক্তব্যের মাধ্যমে প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে যে বিরূপ ও ভ্রান্ত ধারনা দেওয়া হয়েছে তার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এছাড়াও নাটকের রচনাকারী, অর্থদাতা প্রতিষ্ঠান, পরিচালক, প্রযোজক, কলাকুশলী ও সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ এর আওতায় এনে দ্রুততার সাথে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি করছি।

আমরা বিশ্বাস করি সমাজে সচেতনতা সৃষ্টিতে দায়িত্বশীল মিডিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ! ভবিষ্যতে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া বিশেষ শিশু ও সমাজের প্রতিবন্ধকতা আছে এমন মানুষদের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করবে বলেই আমাদের আশা। প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক কোন নাটক, সিনেমা বা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের আগে অবশ্যই এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণকে সেই বিশেষ নাটক, সিনেমা বা প্রামাণ্যচিত্রের পাণ্ডুলিপি দেখিয়ে নেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের সম্মানিত শিক্ষকগণ পাণ্ডুলিপি পর্যালোচনার এই কাজটি সাদরে করে দেবেন। ‘ঘটনা সত্য’ নাটকটি প্রচারের সাথে সাথেই যে সকল অভিভাবকগণ, বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ শিশু সংগঠন এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ ও সমব্যথী। ধন্যবাদ জানাই স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন, তরী ফাউন্ডেশন, অটিজম বাংলাদেশ চাইন্ড ফাউন্ডেশন, অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনকে। আমি বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের আমার প্রিয় শিক্ষার্থীদের যারা ‘ঘটনা সত্য’ নাটকটি প্রচারের সাথে সাথেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।

সবশেষে বলতে চাই, মিডিয়ার মাধ্যমে যেমন সমাজে প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার সম্ভব হয়েছে ঠিক তেমনি মিডিয়ার মাধ্যমে সমাজে প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দূর করাও সম্ভব। আমরা মিডিয়ার দায়িত্বশীল ভূমিকার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীলতার বার্তা প্রচার করে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সুযোগ্য কন্যা অটিজম বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদ-এর নেতৃত্বে একটি প্রতিবন্ধীবান্ধব সমাজ নির্মাণে ভূমিকা রাখতে চাই।

লেখক- অটিজম বিশেষজ্ঞ ও চেয়ারপারসন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সারাবাংলা/আরএফ

অটিজম ঘটনা সত্য শান্তা তাওহিদা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর