বিভীষিকাময় অতীতে ফিরে যাওয়ার আশঙ্কায় আফগান নারীরা
১৮ আগস্ট ২০২১ ১৭:১৪
দুই দশক পর আবারো আফগানিস্তানের দখল নিয়েছে উগ্রবাদী গোষ্ঠী তালেবান। এতে অতীতের সেই বিভীষিকাময় জীবনে ফিরে যাওয়ার চরম আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন আফগান নারীরা। অতীতে তালেবান শাসন অবসানের পর নারীরা যেভাবে সমাজের বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ শুরু করেছিলেন নারীরা—এখন তা হুমকির মুখে পড়েছে। চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন দেশটির নারীরা।
এদিকে মঙ্গলবার ভীতসন্ত্রস্ত আফগান নারীরা যখন বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন, তখন এক নারী সংবাদ উপস্থাপক দেশের পরিস্থিতি নিয়ে একেবারেই বিপরীত খবর প্রকাশ করছিলেন।
মঙ্গলবার সকালে, আফগানিস্তানের টেলিভিশন চ্যানেল ‘টলো নিউজের বেহেশতা আরগন্ধ নামক নারী সংবাদ উপস্থাপক এক তালেবান মুখপাত্রের সাক্ষাৎকার নেন। সেখানে তিনি তালেবান মুখপাত্রের কাছে কাবুলের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশির বিষয়ে জানতে চান।
অনুষ্ঠানে তালেবান মিডিয়া টিমের সদস্য মৌলভী আব্দুল হক হামেদ বলেন, ‘পুরো বিশ্ব এখন বুঝতে পেরেছে যে, তালেবানরাই আফগানিস্তানের প্রকৃত শাসক। তবে মানুষ এখনো তালেবানকে ভয় পাচ্ছে যা খুব অবাক করা বিষয়’।
রোববার রাজধানী কাবুল দখলের পর নারী সংবাদকর্মীর সঙ্গে তালেবান মুখপাত্রের এই সাক্ষাৎকারকে তাদের একটি বড় প্রচারণা হিসেবে মনে করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিশ্বের কাছে তালেবানের মধ্যপন্থী অবস্থান সম্পর্কে একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরই রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের একজন বিশিষ্ট উপস্থাপক খাদিজা আমিন একটি ক্লাবহাউজের চ্যাটরুমে অশ্রুসিক্ত হয়ে বলেন, ‘তালেবানরা তাকেসহ বহু নারী সংবাদকর্মীদের অনির্দিষ্টকালের জন্য বরখাস্ত করেছে’।
২৮ বছর বয়সী আমিন বলেন, “আমি একজন সাংবাদিক এবং আমাকেই কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এরপর আমি কী করব? গত ২০ বছরে আমরা যা অর্জন করেছি, তার কিছুই পরবর্তী প্রজন্ম পাবে না। তালেবান তালেবানই। তারা কখনোই পরিবর্তন হবে না”।
এই দুই সাংবাদিকের গল্প আফগান নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগকেই গভীরভাবে তুলে ধরেছে। লাখো নারী তালেবান শাসনের সেই বিভীষিকাময় অতীতে ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। অতীতে তালেবানের শাসনামলে নারীরা কাজ করতে বাইরে যেতে পারতেন না, পুরুষের অনুমতি ছাড়া বাইরে বের হওয়া নিষেধ ছিল। এমনকি মেয়েদের স্কুলে পড়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সেসময়। যারা তালেবানের নীতি লঙ্ঘন করতেন তাদের প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা হতো।
কিন্তু তালেবান মুখপাত্ররা বার বার আশ্বাস দিচ্ছেন যে, এবার সবকিছু অন্যরকম হবে। মঙ্গলবার কাবুলে এক সংবাদ সম্মেলনে তালেবান মুখপাত্র বলেন, ‘নারীরা বাইরে কাজ করতে পারবে এবং পড়াশুনা করতে পারবে’। আরেক মুখপাত্র নারীদের সরকারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন।
তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, ‘আমরা আশ্বাস দিচ্ছি যে, নারীদের বিরুদ্ধে কোনো সহিংসতা ঘটবে না। কোনো ধরনের কুসংস্কার মেনে নেওয়া হবে না। তবে ইসলামী মূল্যবোধই আমাদের কাঠামো। ইসলামী শরীয়তের মধ্যে থেকে নারীরা সমাজে অংশগ্রহণ করতে পারবেন”।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান শাসন নারীদের জন্য যেমন ছিল অন্ধকার একটি সময়, তেমনি নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই তা ছিল অনেক কষ্টের। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো, নারীদের চিকিৎসা।
মার্কিন সেনারা তালেবানদের হটানোর পর থেকে নারী অধিকারকে উৎসাহিত করতে ৭৮০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে ওয়াশিংটন। নারীরা সেনাবাহিনী, পুলিশবাহিনী এমনকি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। আফগান নারীরা অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করছে, এবং রোবোটিক্স টিমে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ারও দক্ষতা অর্জন করেছে। এসব সুযোগ তালেবান শাসনের সময় অকল্পনীয় মনে হতো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তালেবান যে ইসলামী শাসনব্যবস্থার কথা বলছে তা কি আগের মতো কট্টর হবে কি না? আশঙ্কার কথা হচ্ছে, কিছু কিছু জায়গায় তারা পুরনো আদেশ বাস্তবায়ন শুরু করেছে। কিছু কিছু প্রদেশে নারীদের পুরুষ আত্মীয় ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, পশ্চিম আফগানিস্তানের হেরাতে তালেবান বন্দুকধারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পাহারা দিচ্ছে এবং নারী শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষকদের ক্যাম্পাসে ঢুকতে দিচ্ছে না। দক্ষিণাঞ্চলের শহর কান্দাহারের এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, নারীদের স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নভেম্বরে তালেবানের দখলের পর থেকে কিছু কিছু জেলায় মেয়েদের স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেসব এলাকার নারীরা জানিয়েছেন, ভয়ে এবং তালেবানদের নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা বোরকা পড়তে শুরু করেছেন।
রাজধানীর কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের পুরুষ অভিভাবক ছাড়া ছাত্রাবাস থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। অন্তত দুই শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, শহরে কোনো পুরুষ অভিভাবক না থাকায় তারা কার্যত বন্দী হয়ে পড়েছেন। উত্তর আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরীফের ২৭ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলিয়া কাজিমি বলেন, শহরের বাজারে যেসব নারী একা কেনাকাটা করছেন তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং পুরুষ অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়ে আসার জন্য বলা হয়েছে। এক ক্ষুদে বার্তায় তিনি বলেন, ‘২০ বছর আগে যখন তালেবানদেন পতন হয়েছিল, তখন আমাদের প্রজন্মের জন্য অনেক কিছু করার সুযোগ তৈরি হয়। আমি পড়াশুনা করে আমার লক্ষ্য পূরণ করি এবং এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। কিন্তু এখন আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার এবং অনিশ্চিত। এতো বছরের কষ্ট ও দেখা স্বপ্ন—সব শেষ। ছোট ছোট মেয়েশিশু যারা মাত্র স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে, তাদের ভবিষ্যৎ কী?’
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি সভায় সোমবার মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস, আফগানিস্তানে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। যদিও বেশ কিছু মানবাধিকারের ওপর বিধিনিষেধ শিথিল করার প্রতিবেদন জাতিসংঘ পেয়েছে বলে জানান তিনি। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা অবশ্য সেসব প্রতিবেদনের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি। কিছু ক্ষেত্রে তারা নারীদের বিষয়ে আরও বেশি সহনশীল অবস্থানের বিষয়েও ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে তালেবানরা যা বলছে তার প্রতিফলন ঘটাবে, নাকি আগের নীতিতে ফিরে যাবে তা এখনি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, তাদের এক প্রতিনিধি সোমবার হেরাতে তালেবানের নিযুক্ত স্বাস্থ্য কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি জানান, স্বাস্থ্য বিভাগের নারীদের কাজে ফিরতে বলেছেন তালেবান।
প্রতিবেদনে ইউনিসেফ আরও বলেছে, শিক্ষার প্রশ্নে মিশ্র বার্তা পাওয়া গেছে। কিছু কিছু এলাকায় স্থানীয় তালেবান কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা শীর্ষ নেতার আদেশের অপেক্ষায় আছেন। কয়েক জায়গায় তালেবানরা বলছে, তারা ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা স্কুল চালু করতে চায়।
ইউনিসেফের অপারেশন প্রধান মুস্তাফা বেন মেসাউদ এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘আমরা এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। তবে সতর্ক আছি’।
টলো নিউজের সাক্ষাৎকারটিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। আফগান পর্যবেক্ষকরা বলেন, তালেবানের জন্য সিএনএন ও আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার নারী সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়া অসম্ভব ছিল। সেখানে দেশের ভিতরে নারী সাংবাদিকের কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়া খুবই বিরল ঘটনা।
কিন্তু টলো নিউজের সাবেক প্রযোজক রুখসার আজামি সোমবার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তালেবানরা সেই নারীর সঙ্গে এক টেবিলে বসেছে যাদের তারা হুমকি দিচ্ছে’। রুখসার আজমি ২০১৫ সালে মৃত্যুর হুমকি পেয়ে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যান।
হঠাৎ করে তালেবানদের এই পরিবর্তনকে সবাই স্বাগত জানালেও এগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় কাজ করছে। তালেবানরা দখল নেওয়ার পর থেকে অনেক নারী বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। বিলবোর্ডে যেসব বিজ্ঞাপনে নারীদের স্কার্ফ ছাড়া দেখানো হয়েছে সেগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।
এদিকে কাবুলে মুষ্টিমেয় কয়েকজন নারী বেশ সাহসের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে একটি চত্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা সশস্ত্র তালেবান যোদ্ধাদের সামনে সাইনবোর্ড ধরে নাগরিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছেন।
২০ বছর আগে তালেবান শাসনের সময় মন্ত্রণালয় থেকে আচরণ, পোশাক ও চলাফেরার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। যারা পিকআপ ট্রাকে ঘুরে বেড়াতো ও আদেশ মেনে চলতো না তাদের প্রকাশ্যে অপমান করা হতো এবং চাবুক মারা হতো। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য মতে, নেইল পলিশ দেওয়ার কারণে ১৯৯৬ সালে এক নারীর আঙ্গুল কেটে দেওয়া হয়েছিল। পরকীয়া করলে নারীদের পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলা হতো। সমকামিতার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। মেয়েদের স্কুলে পড়া ছিল নিষেধ। যার কারণে নারী শিক্ষকরা বাড়িতে গোপনে মেয়েদের স্কুল শুরু করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নারী চিকিৎসকরা কাজ করতে পারলেও তারা ছিলেন চরম বৈষম্যের শিকার।
কিন্তু নতুন প্রজন্মের আফগান নারীরা যারা স্কুলে গিয়ে অভ্যস্ত এবং অনেক স্বপ্ন দেখে, তালেবান যুগ হচ্ছে তাদের জন্য প্রাচীন একটি ইতিহাস। তাদের জন্য সেই সময়ে ফিরে যাওয়া অকল্পনীয়। তিন মাস আগে আফগানিস্তান থেকে ভারতে চলে যাওয়া নারী অধিকার কর্মী উইদা সাগরী জানান, দিল্লিতে তার বাড়িতে আরও তিনজন নারী কর্মীকে আশ্রয় দিয়েছেন। দেশের অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন তিনি। শান্তিপূর্ণভাবে ও সাহসিকতার সঙ্গে তালেবান বিধিনিষেধ প্রতিহত করার জন্য নারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এই নারী অধিকার কর্মী।
উইদা সাগরী বলেন, ‘তালেবানরা কখনোই নারীদের বাইরে কাজ করতে ও স্কুলে যেতে দেখেনি। আমাদের অবশ্যই তাদের প্রতিহত করতে হবে। আমাদের বাইরে কাজ করতে হবে এবং স্কুলে যেতে হবে। নারীরা কখনোই গুহার ভেতরে আটকে থাকতে পারে না’।
সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস
সারাবাংলা/এসএসএস
আন্তর্জাতিক আফগান নারী আফগান-তালেবান আফগানিস্তান আফগানিস্তানে নারী অধিকার টপ নিউজ তালেবান রোকেয়া সরণি