ইতিহাসের স্বর্ণালী অধ্যায় থেকে আজকের আফগানিস্তান
১৮ আগস্ট ২০২১ ১১:৩০
এই লেখাটা যখন লিখতে বসি ততক্ষণে আফগানিস্তান পুরোপুরি তালেবান দখলে। দেশটির রাষ্ট্রপতি আশরাফ গনি আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়েও গিয়েছে। কারণ হিসেবে বলেছেন যে তিনি তার দেশে কোন ধরনের রক্তপাত এড়াতে চেয়েছেন। আর হাজার হাজার মানুষ ভীড় করেছে বর্তমানে আফগানিস্তানে একমাত্র জায়গা যাকে নিরাপদ ভাবা হচ্ছে সেই কাবুল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। তালেবানের হাতে আফগানিস্তানের এই পতন দেখে আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যেও দুই ধরনের অনুভূতি দেখা যাচ্ছে। এক পক্ষ যারা এখনও কিছুটা স্বাধীনতাকামী, তারা বলছে আফগানিস্তান আবারও সেই ৯০ দশকের শেষদিকের মত বর্বর যুগে ফিরে যাচ্ছে। আবার অপরদিকে ধর্মীয় গোড়ামিতে পূর্ণ ব্যক্তিদের মতে আফগানিস্তানে ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে পুনরায়। অনেকটা একই অনুভূতি আফগানিস্তানেও চলছে বলে ধারণা করি। কাজের কারণেই কিছু আফগানি লোকের সাথে পরিচয়। যার একজনের সাথে গত কয়েকদিন দেখা হচ্ছে। আফগানিস্তানের রাজনীতি নিয়ে কথা উঠলেই তালেবানকে সমর্থন দেওয়া সেই লোক বলে, ‘কই কোন আফগানি তো পালিয়ে যাচ্ছে না? আফগানিস্তানে প্রায় ৬০ শতাংশেরও বেশি পাশতুনের বাস। তাদের কিছুই হচ্ছে না। পালিয়ে যাচ্ছে যারা উজবেক বা যারা তুর্কিমিনিস্থান থেকে এসে আমাদের দেশে ভিটে মাটি গড়েছে তারা। আমাদের এক বছর সময় দাও দেখবে তুমিও আফগানিস্তানে যেতে পারবে। দেখে নিও এবার আফগানিস্তানে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আফগানিস্তানের এই অবস্থা আর ইতিহাস দেখে ভাবি, একসময় ইউরোপিয়ান বা আমেরিকান ভ্রমন পিপাসুদের জন্য ‘হিপ্পি ট্রেইল’ বলে জনপ্রিয় এক ভ্রমণপথ ছিল এটি। যা কিনা বাই রোড ধরে ইরান হয়ে আফগানিস্তান দিয়ে ভারতে আসতো। পুরনো ছবিতে দেখা সেই আফগানিস্তানের সঙ্গে এখনকার আফগানিস্তানকে যেন মিলানো যায় না। কীভাবে ১৯৭০-৮০ থেকে ১৯৯০ আসতে আসতে আফগানিস্তানের এই অবস্থা হয়ে গেল? যে ধারা এখনও চলমান। কেন আজ আফগানিস্তান বিশ্বের অন্যতম অনিরাপদ স্থান? এই সবের উত্তরের জন্য আমাদের উচিৎ ইতিহাস থেকে ঘুরে আসা। না, আমি ১৯৯০ বা তার আশেপাশে যেতে বলবো না। আফগানিস্তানের ভূ-রাজনীতি বুঝতে বা কীভাবে আফগানিস্তান আজকের এই অবস্থায় তা বুঝতে যেতে হবে প্রায় ২০০ বছর আগে।
ব্রিটেন-আফগান যুদ্ধ
ইতিহাসে আফগানিস্তানকে বলা হয় ‘রাজাধিরাজদের মৃত্যুপুরী’। যুগে যগে বহু রাজা, বহু প্রতাপশালী রাজ্য আফগানিস্তান দখল করতে আসলেও প্রায় সকলকেই ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। মেসিডোনিয়ার আলেক্সান্ডার, মঙ্গোলিয়ার চেঙ্গিস খান বা মোঘল সম্রাট শাহজাহান, আওরঙ্গজেব আফগানিস্তান দখলে সমর্থ হলেও দীর্ঘসময় ধরে রাখতে পারেন নি। বলা হয় আফগানিস্তানের যোদ্ধারা বিদেশীদের জন্য মৃত্যুপুরী বানিয়ে দেয় পর্বত-খন্দকের এই দেশটিকে। আমাদের আলোচনা অত পিছনেও যাবে না। সময়টা ১৮০০ সালের শুরুর দিকে। তখনকার দিনে একপাশে ছিল বিশাল ‘রাশিয়ান সাম্রাজ্য’ আর অপরদিকে ‘ব্রিটিশদের ভারত রাজ’। আর এই দুই পরাক্রমশালী রাজ্যের মধ্যে দখলমুক্ত ছোট্ট এক অঞ্চল যাকে আজ আমরা আফগানিস্তান নামে জানি। ১৮৩৮ সালের কথা। রাশিয়ান সম্রাজ্যের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন, প্রভাব বা যেকোন কারণেই হোক, ব্রিটিশদের নজর পড়ে এই অঞ্চলের দিকে। আফগানিস্তানের সেসময়ের রাজা ‘আমির দোস্ত মোহাম্মদ’ যাকে ব্রিটিশরা সরিয়ে দিয়ে নিজেদের কাঠ পুতুল ‘শাহ সুজা’কে আফগানিস্তানের মসনদে বসিয়ে দেয়।
আফগানিস্তানের রাজাদের সেসময় কোন প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী ছিল না। এই অঞ্চলের লোকেরা তখন ছোট ছোট অঞ্চলে বাস করত এবং প্রতিটা অঞ্চলের একজন নেতা থাকত। যখনই আফগানিস্তানের রাজাদের যুদ্ধে সৈন্য প্রয়োজন হতো, তখনই এসব অঞ্চলের নেতাদের টাকা দিয়ে সৈন্য ভাড়ায় নেওয়া হতো। ১৮৩৯ সালের কথা। শাহ সুজার আমলে এই টাকার ভাগ অনেক কমে যায় এসব স্থানীয় নেতাদের। আর এ থেকেই তারা একত্রিত হয়ে শাহ সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। যা ইতিহাসে ‘প্রথম ব্রিটেন-আফগান যুদ্ধ’ নামেই পরিচিত। প্রায় তিনবছরব্যাপি এই যুদ্ধ্ব ব্রিটিশদের হার হয়। শাহ সুজাকে হত্যা করা হয় এবং আমির দোস্ত মোহাম্মদকে পুনরায় ক্ষমতায় বসানো হয়।
দ্বিতীয় ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধ
১৮৭৮ সালে ব্রিটেন পুণরায় আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এবং এবার এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের জয় হয়। ব্রিটেন সেবারও পুরো আফগানিস্তান দখল করে নি। কারণ তাদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক বানানো। আর তাই সেবার ব্রিটেন আফগানিস্তানে নতুন আমির হিসেবে আবদুর রহমান খানকে নিযুক্ত করে। যাকে ইতিহাসে আয়রন আমির নামেও ডাকা হয়।
ডুরান্ড লাইন
১৮৯৩ সালে ব্রিটেন আফগানিস্তান এবং ব্রিটিশ ভারতের মাঝে একধরনের সীমারেখা টেনে দেয়। যা ডুরান্ড লাইন হিসেবে পরিচিত। এটি আজও পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সীমানারেখা।
ব্রিটিশ-রাশিয়া সম্পর্ক স্থাপন
১৯০৭ সালে ব্রিটেনের সঙ্গে রাশিয়ার বহু কাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এবছর রাশিয়া আফগানিস্তানকে ব্রিটেন দ্বারা রক্ষিত দেশ হিসেবে মেনে নেয়। এবং কখনোই আফগানিস্তান দখলের চেষ্টা করবে না বলে চুক্তি করে।
সমাজতান্ত্রিকতার হাওয়া
যখন ব্রিটিশ-রাশিয়া সম্পর্ক স্থাপিত হয় ঠিক তার কাছাকাছি সময়েই রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয় এবং লেনিনের হাতে রাশিয়ার ক্ষমতা আসে। সে হাওয়া এসে পৌঁছায় আফগানিস্তানেও। লেনিনের ক্ষমতা গ্রহণের ঠিক এক বছর বাদেই ১৯১৯ সালে আফগানিস্তান ব্রিটেনের বিপক্ষে আবারও যুদ্ধ ঘোষণা করে যা আফগানিস্তানের ইতিহাসে ‘আফগানিস্তানের স্বাধীনতা যুদ্ধ’ নামেও পরিচিত। আফগানিস্তান এই যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং পুরোপুরিভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। দিনটি ছিল ১৯১৯ সালের আজকের দিন অর্থাৎ ১৯ আগস্ট। আফগানিস্তানের সেসময়ের রাজা ছিল আমির আমানুল্লাহ খান।
আমানুল্লাহ খান-এর সময়কাল
আমির আমানুল্লাহ খান আফগানিস্তানকে প্রথমেই সাংবিধানিকভাবে রাজতান্ত্রিক দেশ বানিয়ে ফেলেন। যার ফলে আফগানিস্তানের নাম হয়ে যায় ‘কিংডম অফ আফগানিস্তান’। আমানুল্লাহ খানকে বলা হয় সময়েরও আগে জন্ম নেওয়া একজন ব্যক্তি। আফগানিস্তানের আগের আমিরদের মত তিনি একাধিক বিয়ে করেন নি। আবার ছিল না অন্যদের মত একাধিক উপপত্নী বা নারীসঙ্গের লোভ। তিনি বিয়ে করেছিলেন নিজের বহুদিনের প্রেমিকা সুরাইয়া তার্জিকে। আর দুজন মিলে মনোযোগ দেন এক নতুন আফগানিস্তান তৈরিতে। তাদের দুজন মিলে নেওয়া নতুন আফগানিস্তানের কিছু পদক্ষেপ ছিল-
* একাধিক বিয়ের বিপক্ষে জনমত গড়ে তোলা
* নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার দেওয়া
* মেয়েদের জন্য স্কুল তৈরি করা
* নারীদের সমান অধিকার দেওয়া
* সকল ধর্ম/বর্ণের মানুষের জন্য সমান বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা।
সুরাইয়া তার্জি ছিলেন নারী জাগরণের অন্যতম কান্ডারি। এক জনসমাবেশে তিনি বলেছিলেন ‘ইসলামে কোথাও শরীরকে বিশেষ কোন কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়ার কথা বলা নেই। সুতরাং এই হিজাবেরও কোন প্রয়োজন নেই। কারো ইচ্ছে হলে পরবে নয়তো না’। এই কথা বলে ভরা জনসমাবেশেই নিজের হিজাবকে টেনে ছিড়ে ফেলেছিলেন।
আমানুল্লাহ খান এবং সুরাইয়া খান মিলে যখন সামাজিক বিপ্লব নিয়ে আসছিলো আফগানিস্তানে, তখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আফগানিস্তানে একটা ধর্মীয় গোষ্ঠী এই বিপ্লবের বিপক্ষে ছিল। বারবার তারা আমানুল্লাহ খান এবং সুরাইয়া তার্জিকে থামিয়ে দিতে চাচ্ছিল। ১৯২৩ এবং ১৯২৬ সালে তারা দুবার আমানুল্লাহ খানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। প্রথম দুবার ষড়যন্ত্রকারীদের থামিয়ে দেয়া গেলেও তৃতীয়বার এসে ষড়যন্ত্রকারীরা জিতে যায় ১৯২৯ সালে। আমানুল্লাহ খানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গড়ে ওঠে। এবং সেই বিদ্রোহের ফলে আমানুল্লাহ খান এবং সুরাইয়া তার্জি পালিয়ে বর্তমান ভারতের মুম্বাই চলে আসেন। আর সেই থেকে আফগানিস্তানে শুরু হয় কখনো না থামা এক সংঘর্ষের। যেখানে ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, ক্ষমতার লোভ, দূর্নীতি সব মিলেমিশে একাকার।
লেখক- ফিচার লেখক ও ব্লগার
সারাবাংলা/আরএফ