Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে নারী ও শিশুদের ভবিষ্যৎ কী?

ফিচার ডেস্ক
২৩ আগস্ট ২০২১ ১৯:৩১

ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে মোবাইলের কল রিসিভ করলেন আফগানিস্তানের এক নারী সাংবাদিক। অন্যপাশ থেকে যে বার্তাটি এলো তা শুনে চোখেমুখে আতঙ্ক আরো বেড়ে গেলো। বার্তাটি ছিলো ‘তারা (তালেবান) শিগগিরই আসছে’। অন্যদিকে আফগানিস্তান তালেবানদের দখলে যাওয়ার পর থেকে নিজের হত্যাকারির অপেক্ষায় আছেন এক নারী আইনজীবী। কারণ যেকোন সময় তালেবানরা এসে তাকে হত্যা করতে পারে। ছোট্টশিশুরও আশঙ্কা, তার জন্য কতদিনই বা স্কুলের গেট খোলা থাকবে।

বিজ্ঞাপন

এমনই এক ভয়ঙ্কর আর আতঙ্কিত বাস্তবতার মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন আফগানিস্তানের নারী ও শিশুরা। যদিও তালেবানরা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে বলছে, সেখানকার নারীরা শোষিত হবে না। কিন্তু ভয়ঙ্কর বাস্তবতাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারছেন না আফগান নারীরা। জোরপূর্বক বিয়ে, কর্মজীবী নারীদের চাকরিচ্যুত করার ঘটনার মধ্য দিয়ে গত ২০ বছরের নারী স্বাধীনতা ও নারী অধিকারের যে অর্জন তা শেষ হওয়ারই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

ইন্টারন্যাশনাল সিভিল সোসাইটি অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (আইসিএএন) এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিকস এর সেন্টার ফর ওম্যান পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি’র পরিচালক সানাম নারাগি অ্যান্ডারলিনি এ বিষয়ে বলেন, “আমরা কি তালেবানদের কথা মেনে নেব এবং বলবো যে, অহ্, এখন তো সবকিছু ঠিক হবে, কারণ এই তালেবান আগের মতো না, তাদের পরিবর্তন হয়েছে। নাকি এসব কর্মকাণ্ডসহ তাদের গ্রহণ করবো?”

আইসিএএন এর ওম্যান্স অ্যালায়েন্স ফর সিকিউরিটি লিডারশিপ (ডাব্লিউএএসএল) এর কর্ণধার অ্যান্ডারলিনি বলেন, “তালেবানদের নিয়ে একটি বড় উদ্বেগ ছিল যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অধিকাংশই যখন আফগানিস্তান ত্যাগ করবে তখন তাদের এই মধ্যপন্থী ঘোষণাটির বাস্তবায়ন কেমন হবে। যখন কূটনীতিক, সাংবাদিক এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো আফগানিস্তান ত্যাগ করবে তখন মূলত তারা সব ধরনের পথ বন্ধ করে দেবে…. সৃষ্টিকর্তাই জানেন আমরা তখন কি দেখব।”

তালেবানের শাসনে নারী ও শিশুদের চিত্র কেমন হতে পারে তার একটি ধারণা নিচে আলোচনা করা হলো।

মেয়েরা কি স্কুলে যেতে পারবে?
মেয়েরা স্কুলে যেতে পারবে ও তাদের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ থাকবে জানিয়ে সোমবার তালেবান মুখপাত্র সুহায়েল শাহিন বলেন, “নারী ও শিশু শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারবে। নারীরা স্কুলে শিক্ষকতাও করতে পারবেন।”

কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। স্থানীয়দের মধ্যে তালেবানদের নিয়ে রয়েছে চরম অবিশ্বাস। কারণ এরাই ক্ষমতায় থাকার সময় ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শিশু ও তরুণীদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। কাবুলের নারী অধিকার কর্মী ও লেখক হুমাইরা কাদেরি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে ফোনে জানান, “যেসব মেয়েরা এখনো স্কুলে যেতে পারছে তারা এই ভেবে আতঙ্কিত যে, কখন স্কুলের গেট তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়!” গত দুই দশকে আফগানিস্তানে শিক্ষা অনেক বেশি বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তালেবানরা মেয়েদের শিক্ষার উপর জাতীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। নব্বইয়ের দশকেও এমনকি করেছিল তারা।

নরওয়ের খ্রিষ্টান মিচেলসেন ইনস্টিটিউটের নৃবিজ্ঞানী তরুণ উইম্পালম্যান বলেন, “বয়ঃসন্ধির পর তালেবানরা মেয়েদের শিক্ষা বন্ধ করে দেয় কি না সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। জানান, তালেবানদের পক্ষ থেকে এমন ঘোষণাও আসতে পারে যে, যতদিন পর্যন্ত নারী অধ্যাপক পাওয়া যাবে ততদিন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা হবে। যেটি মূলত হতে পারে উচ্চশিক্ষা থেকে নারীদের বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা। উচ্চশিক্ষা থেকে নারীদের বাদ দেওয়ার ফলাফল খুবই মারাত্মক হবে।”

এ বিষয়ে অ্যান্ডারলিনি বলেন, “আরেকটি উপায়ে তালেবানরা নারীশিক্ষার পথ বন্ধ করতে পারে। সেটি হলো, যেসব পরিবার মেয়েদের বাইরে বের হতে দেবে তাদের জরিমানা করা। এভাবে তারা সরাসরি সহিংসতার পথ এড়িয়ে অন্যভাবে নিজেদের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারে।”

নারীরা কি বাইরে কাজ করতে পারবে?
২০ বছর আগে তালেবানরা যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন নারীদের বাইরে কাজ করা নিষেধ ছিল। ২০০১ সালে তারা ক্ষমতা থেকে বিতারিত হওয়ার পর নারীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতেন। ২০২১ সালের শুরুর দিকে দেশটির জাতীয় সংসদের ২৭ শতাংশ আসন ছিল নারীদের দখলে। কিন্তু গত বছর যখন তালেবান এবং মার্কিন সমর্থিত আফগান সরকারের মধ্যে শান্তি আলোচনা চলছিল, তখন থেকেই নারী সাংবাদিকসহ কর্মজীবী নারীদের ওপর আক্রমণ চালানো হয় ও হত্যা করা হয়।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স এর তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ের শুরুর দিকে বিদ্রোহীরা দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কান্দাহারের আজিজি ব্যাংকের কার্যালয়ে প্রবেশ করে এবং সেখানে কর্মরত ৯ নারীকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। তাদের বলা হয়েছিল, তাদের জায়গায় কাজ করবে পুরুষ আত্মীয়রা।

তালেবানরা আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত নারীরা ভয় আর শঙ্কা নিয়ে দিন পার করছেন। তাদের আশঙ্কা, তালেবানরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাদেরকে শাস্তি দিতে পারে এমনকি মেরেও ফেলতে পারে। আফগানিস্তানের প্রথম নারী মেয়র জারিফা গ্যাফারিও তাদের মধ্যে একজন। ২৭ বছর বয়সী এই নারী গত সপ্তাহে ব্রিটেনের আইনিউজকে বলেন, “আমি এবং আমার পরিবারকে সাহায্য করার মতো এখানে কেউ নেই। পরিবার ও স্বামী নিয়ে আমি তালেবানদের আসার অপেক্ষায় আছি। তারা আমার মতো মানুষকেই খুঁজছে এবং আমাকে হত্যা করবে। আমরা এখন কোথায় যাবো?”

উইম্পালম্যান বলেন, “জাতীয় পর্যায়ে তালেবানরা বলছে, নারীরা ইসলামী শরীয়তের মধ্যে থেকে আগের মতো কাজ করতে পারবে, কিন্তু প্রদেশগুলোতে এটি কীভাবে কাজ করবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।” তিনি আরো বলেন, এগুলো থেকে ধারণা করা যাচ্ছে যে, “তালেবানদের এমন কিছু কাঠামো থাকবে যেখানে নারী ও পুরুষ একসঙ্গে বা এক রুমে থাকতে পারবে না। যার মাধ্যমে নারীদের তাদের বর্তমান অবস্থান থেকে বাদ দেওয়া হবে।”

নারী সংবাদকর্মীদের কি টেলিভিশনে দেখা যাবে?
একজন তালেবান যোদ্ধা সোমবার সিএনএনকে বলেন, নারী সাংবাদিকরা ততক্ষণ কাজ করতে পারবে যতক্ষণ না তারা নিকাব পরা এবং পরিবারের বাইরে পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা না করার মতো নিয়মগুলো মেনে চলবে। নারী সাংবাদিকদের কথা বলতে না দেওয়া, পুরুষদের সঙ্গে একই ঘরে থাকা থেকে বিরত থাকার মতো নিয়মগুলো তাদের সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

মিডিয়া গ্রুপের পরিচালক সাদ মোহসেনির টুইট অনুযায়ী, মঙ্গলবার সকালে কাবুলের রাস্তায় কাজ করতে গিয়ে ফিরে এসেছেন আফগান সংবাদ সংস্থা টলো’র দুই নারী সাংবাদিক। টলো’র সংবাদ প্রধান মিরাকা পোপাল আরেকটি টুইটে জানান তারা নারীদের দিয়ে সংবাদ উপস্থাপন শুরু করেছেন।

কিন্তু বেশ কয়েকজন নারী সাংবাদিক সিএনএনকে জানিয়েছেন, তারা তালেবানদের কাছ থেকে ফোনে হুমকি পাচ্ছেন। সম্প্রতি এর মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। কাবুলের এক বিশিষ্ট নারী সাংবাদিককেও ফোন করে বলা হয়েছে ‘তারা(তালেবানরা) শিগগিরই আসবে’।

নারীদের কেমন পোশাক পড়তে হবে?
অ্যান্ডারলিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফগান নারীরা বিশেষ করে শহরগুলিতে মাথায় স্কার্ফ ও চুল দেখিয়ে বাইরে বের হতে পেরেছে। তালেবানরা সর্বশেষ ক্ষমতায় থাকাকালীন যা ছিল অকল্পনীয়। সেসময় তথাকথিত শালীনতার নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য সেখানকার নারীদের বর্বর সব শাস্তি পেতে হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে, “বোরকার নিচে এক বা দুই ইঞ্চি চামড়া দেখা গেলে, পড়ালেখার চেষ্টা করা হলে প্রকাশ্যে মারধর করা হতো, পরকীয়া বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জন্য প্রকাশ্যে পাথর ছুঁড়ে মারা হতো। সেসময় নারীদের জনজীবনে দেখা যায়নি। বাড়িতে বন্দি ছিলেন তারা।”

কুন্দুজ শহর থেকে কাবুলে আশ্রয় নেওয়া এক নারী বৃহস্পতিবার সিএনএনকে বলেন, “কুন্দুজ এখন থাকার মতো জায়গা না, কারোই সেখানে থাকা উচিত নয়। আমি আমার সাবেক সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছি। সে জানিয়েছে, নারীরা বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না, ঘরের মধ্যে আটকে আছে। যারা বাইরে কাজ করে তারা বের হতে ভয় পাচ্ছে। সবাই তালেবানের ভয়ে আতঙ্কিত।”

নতুন তালেবান নেতৃত্বের বিধিনিষেধ কতটা কঠোর হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। অ্যান্ডারলিনি বলেন, “তালেবানরা বলছে, নারীরা হিজাব পরে কাজ করতে পারবে। কিন্তু হিজাব বলতে তারা কি বোঝাতে চাইছে? তারা কি বোরকা বোঝাতে চাইছে? নাকি এক ধরনের ভারী আবরণকে বোঝাচ্ছে? অথবা সেখানে কি কোন স্বাধীনতা আছে?”

তালেবানদের দখল নেওয়ার পর থেকে বোরকা বিক্রি বেড়ে গেছে। কাবুলের এক দোকানদার সিএনএনকে জানিয়েছেন, “তালেবানদের ভয়ে পুরুষরা তাদের স্ত্রী, কন্যা ও পরিবারের অন্য নারীদের জন্য বোরকা কিনছেন। তারা মনে করছেন, রাস্তায় চলাচলের জন্য এটিই এখন সবচেয়ে নিরাপদ।”

নারীরা কি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে?
পূর্বে তালেবান শাসনের অধীনে আফগান নারীরা পুরুষ আত্মীয় ছাড়া ভ্রমণ করতে পারতেন না। সম্প্রতি আবারো তারা বিভিন্ন জায়গায় এই নিয়ম চালু করেছে। উইম্পালম্যান বলেন, “তালেবানরা জাতীয় পর্যায়ে এসব নিয়ম চালু করতে না পারলেও নারীদের চলাফেরায় বিধিনিষেধ আরোপ করার অনেক পথ আছে তাদের। এমনকি ২০০১ সালে তালেবানদের ক্ষমতা পতনের পরও পুরুষ ছাড়া বাইরে বের হওয়া নৈতিক অপরাধ বলে অভিযুক্ত ছিল। তাই এ ধরনের অভিযোগ এখন অনেক বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এমনটি হলে নারীর অধিকারে অনেক বেশি প্রভাব পড়বে। পুরুষের সঙ্গে একা ট্যাক্সি, রেস্টুরেন্ট, ব্যক্তিগত বাড়ি এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার জন্য নারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, এমন চিত্র আমরা এখন কল্পনাও করতে পারি না। ”

নারী ও শিশুদের কি জোর করে বিয়ে দেওয়া হবে?
অ্যান্ডারলিনি বলেন, জঙ্গিরা এরমধ্যেই জোরপূর্বক বিয়ে বা ধর্ষণের জন্য ছোট ছোট মেয়েদের পরিবার থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। এসব আদেশ কোথা থেকে আসছে তা স্পষ্ট নয়। এসব ঘটনার সঙ্গে তালেবানের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সংযোগ নাও থাকতে পারে।

তবে যাই হোক না কেন, তালেবানরা জাতীয় পর্যায়ে যেসব বার্তা দিচ্ছে তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। স্থানীয় শহর ও এলাকাগুলোতে বিপরীত ঘটনাই ঘটছে।

সিএনএন অবলম্বনে

সারাবাংলা/এসএসএস

আফগান নারী আফগানিস্তান কাবুল টপ নিউজ তালেবান নারী নারীশিক্ষা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর