Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্মৃতিচারণ: পটশিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তী

নমিতা চক্রবর্তী
২২ নভেম্বর ২০২১ ২১:৪০

২২ নভেম্বর শিল্পীকে যখন শেষবারের মতো চারুকলা প্রাঙ্গণে আনা হয়েছিল, তখনো কুয়াশার চাদরে ঢাকেনি ঢাকা শহর। শীতের আমেজে জবুথবু হয়নি শহরের মানুষ। অগ্রহায়ণের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে ছিল চারুকলার আঙিনাজুড়ে। তবু নবান্নের উৎসবকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত বকুলতলা শোকে যেন মুষড়ে পড়েছিল। সবার চোখে জল। পটশিল্পী রঘুদা আর কখনো আসবেন না চারুকলায়। অথচ তিনি চারুকলার ছাত্র বা শিক্ষক নন। ছবি আঁকায় নেই তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। মায়ের সঙ্গে আলপনা আঁকা থেকেই তার তার শিল্পী জীবনের হাতেখড়ি। তার শেষযাত্রায় সঙ্গী হলেন সবাই। শ্রদ্ধা জানালেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ছাত্র-শিক্ষক সবার ভালোবাসায় সিক্ত হলেন বাংলার অন্যতম বিশিষ্ট পটশিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তী।

বিজ্ঞাপন

পটচিত্রকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তী। ১৯৬৯ সালের ১ নভেম্বর গাইবান্ধার শনিমন্দির রোডে জন্ম নেন রঘুনাথ চক্রবর্তী। বাবা বাসুদেব চক্রবর্তী ও মা অঞ্জলী চক্রবর্তী। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয়। মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন পূজার আলপনা আঁকা থেকেই তার ছবি আঁকা ও প্রতিমা তৈরিতে আগ্রহের শুরু। গ্রামবাংলার সৌন্দর্য, পারিপার্শ্বিক জীবন ও প্রকৃতির খুঁটিনাটি ছিল তার পটচিত্রের বিষয়। মোটা কাপড় বা কাগজের খণ্ডে তুলির সাহায্যে রঙ লাগিয়ে এক অসাধারণ সহজ ভঙ্গিতে তিনি এঁকে গেছেন মানুষ, মাছ, পশু-পাখি, বৃক্ষ, লতাগুল্ম, ফুল-ফল ইত্যাদি নিজস্ব ঢঙে।

বিজ্ঞাপন

বাংলার অপরূপ রূপ রঘুনাথ চক্রবর্তীর ভেতরের অনবদ্য প্রতিভা ও শিল্পী সত্তার বিকাশ ঘটিয়েছিল। হাজার বছরের বাঙালি এতিহ্যের বাহক এই পটচিত্র। পৌরাণিক, সমসাময়িক বা লোকজ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠত বিভিন্ন সংগীত, মঙ্গলকাব্য অথবা পটচিত্র। মনসামঙ্গল, আনন্দমঙ্গল, কৃষ্ণ লীলা ইত্যাদি গল্প-গাঁথার গল্প ধারাবাহিক চিত্রায়ন এই পটচিত্র। পটচিত্র ছিল এ উপমহাদেশের জন-জীবনের আনন্দ, বিনোদন ও শিক্ষার অনন্য এক মাধ্যম।

রঘুনাথ চক্রবর্তীর আঁকা কিছু শিল্পকর্ম

কলেজ শেষের পরপরই ঢাকায় চলে আসেন পটশিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ও শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট প্রাঙ্গণ হয়ে উঠে তার সার্বক্ষণিক বিচরণ ক্ষেত্রে। পটচিত্রই হয়ে ওঠে তার জীবন ও জীবিকা। দৃক, ছায়ানটসহ প্রবাসেও শিল্পীর দশটিরও বেশি একক চিত্র প্রদর্শনী হয়েছিল। সচ্ছলতার মুখ তিনি দেখেননি। তবে বয়ে গেছে দিন।

২০১৫ সালে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মস্তিস্কে অকস্মাৎ রক্তক্ষরণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। অমূল্য কিছু পটচিত্র রেখে স্বর্গলোকে প্রবেশ করেন নিঃসন্তান এই শিল্পী। চারুকলা, সোনারগাঁয়ের শিল্পাচর্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে রক্ষিত আছে পটশিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তীর অনবদ্য শিল্পকর্ম।

রঘুনাথ চক্রবর্তীর অনন্তলোকে যাত্রার ছয় বছর পূর্ণ হলো আজ। তার আঁকা ছবি, রঙ-তুলি আর যাপিত জীবনের স্মৃতিটুকু সম্বল করে শহরের এক কোনায় এখনো বেঁচে আছি। এই শহর ছাড়তে ইচ্ছা করে না। সারা শহরে পটশিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তীর পদচিহ্নকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। অগ্রহায়ণে চারুকলায় এখনো উৎসব হয়। আঙিনায় ছেলে-মেয়েরা রঙ-তুলি দিয়ে জীবনের প্রতিচ্ছবি আঁকে। ওদের পাশে বসে, ওদের আনন্দিত মুখের মধ্যে খুঁজে বেড়াই রঘুনাথ চক্রবর্তীর মুখ। উত্তরাধিকার বলতে তো সম্বল ওইটুকুই।

লেখক: প্রয়াত রঘুনাথ চক্রবর্তীর স্ত্রী

সারাবাংলা/টিআর

পটশিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তী