Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাহসী মেয়ের ভিড়ে বখাটেদের রেহাই নাই, মেলায় যাইরে


১২ এপ্রিল ২০১৮ ১৩:১৭

জান্নাতুল মাওয়া।।

ডিজাইনার শোরুম, শপিং মল, ফুটপাতেজুড়ে বসা চুড়ির দোকান, মেকওভার সেলুন সমস্ত জায়গায় এই দারুণ চৈত্র দিনেও লেগেছে বৈশাখের আমেজ। লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন, পত্রিকার লাইফস্টাইলের পাতা পয়লা বৈশাখের দিন কার কেমন সাজ হবে, কার রান্নাঘরে নতুন কী পদ রান্না করা যেতে পারে সেই সবের রঙিন গল্প আর ছবিতে ঠাসা।

নববর্ষের শোভাযাত্রায়, মেলায়, উৎসব মানেই ভিড়। ভিড় মানেই আমাদের বৈশাখের এক বিপুল জনপ্রিয় গান বলছে “ললনাদের রেহাই নেই”!  আমাদের দেশের নারীদের অভিজ্ঞতাও এই গানের ব্যতিক্রম নয়! তাহলে বাংলা বছরের প্রথম দিনে মেয়েরা সাজবে, সেজেগুজে তারা কোথায় যাবে?

শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান জানিয়েছেন, তারা প্রতিবারের মত এবারেও সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেবেন। মেয়েদের ভয় পাবার কোন কারণ আছে বলে তিনি মনে করেন না। ২০১৫ সালে নববর্ষ উদযাপনের ভিড়ে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিতেই আবুল হাসান বলেন, সে তো অনেক আগের কথা। এর পর তো আরও কত উৎসব হল; এমন ঘটনা তো আর ঘটেনি।

এটা ঠিক যে তেমন বড় মাত্রায় আর হয়তো নিপীড়নের ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু ভিড়ের মুখে মেয়েদের অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়ার বিষয়টি যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।  এইসব ভয়েই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী জেরিন নববর্ষের উৎসবে মেলায় বা শোভাযাত্রায় অংশ নেন না। জেরিন জানান, পয়লা বৈশাখে তিনি নতুন শাড়ি পরেন, সাজেনগুজেন, ঘরেই কয়েকটা ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দেন। এদিন সারাটা দিনই কাটান সামজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবার আনন্দ উৎসব দেখে দেখে।

এদিকে বৈশাখের আয়োজনে নিয়মিত অংশ নেন সানজিদা। তিনি বলেন, নববর্ষ উৎসব তো শুধু ছেলেদের জন্যে না।  মেয়েরা কেন এমন একটা আনন্দের দিনে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে? মেয়েরা ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকলে তো বখাটেরা তাদের অন্যায় আচরণকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেবে! সানজিদা জানান, তিনি এসব ভিড়ে বেশ সাহস নিয়ে চলাফেরা করেন। তার মতে মেয়েরা লজ্জা পেয়ে চুপ করে থাকে বলেই বখাটেদের বখাটেপনা বেড়ে যায়। তিনি জানান, এইসব মুহূর্তে তিনি সাহসের সাথে প্রতিবাদ করেন।

বিজ্ঞাপন

মেয়েরা সেজেগুজে মেলায় অবশ্যই যাবে। তবে নববর্ষ উদযাপনের প্রস্তুতিতে আরো কিছু অনুষঙ্গ যোগ করে নিতে হবে মেয়েদেরকে।  এই প্রস্তুতি বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মাসরুফ হোসেন মেয়েদেরকে সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মেয়েদের মূল সমস্যা তাদের শারীরিক সক্ষমতায় নয়, মাইন্ডসেটে। বছরের পর বছর সমাজের ভুল কন্ডিশনিং এর ফলে একটা মেয়ে নিজেকে দুর্বল ভাবতে শেখে, আর এর সুযোগ নেয় হায়েনার দল। আমাদের মেয়েরা খুব ভালোভাবেই সক্ষম নিজেকে রক্ষা করতে, শুধু  প্রয়োজন মাইন্ডসেট পাল্টানো।

মাসরুফ হোসেন অপরাধীদের মাইন্ডসেট নিয়েও কথা বলেন। তার মতে, ভিড়ের মধ্যে একটা মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে যৌনসুখ পায় যে পুরুষেরা তদের  সাহস নেই সুস্থ ভদ্রোচিত উপায়ে একটা মেয়েকে প্রপোজ করার। এদের একটাই অস্ত্র- আপনি প্রতিবাদ না করে চেপে যাবেন এই বিশ্বাসটুকু। তাই তিনি মেয়েদের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রিয় বোনেরা,  যে মুহুর্তে বুঝলেন কেউ আপনাকে বাজেভাবে স্পর্শ করছে,  নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে আশেপাশে নরক গুলজার করে তুলতে হবে। মনে রাখবেন, নিজেকে রক্ষা করার পূর্ণ আইনগত অধিকার আপনার আছে (পেনাল কোড ধারা একশ দেখুন)। যে মুহূর্তে আক্রান্ত হচ্ছেন, মানবতা সভ্যতা ইত্যাদি ভুলে যান। এমন ধোলাই দিন যেন আর এ জীবনে কোন মেয়ের গায়ে হাত দেবার কথা দুঃস্বপ্নেও না ভাবে।’ মাশরুফ হোসেন আরও বলেন,  ‘একসাথে চার পাঁচজন দল বেঁধে চলুন। হ্যারাসমেন্টের ভয়ে ঘরে বসে থাকাটা কোন সমাধান না। দু’দিন পর এরা আপনার ঘরে ঢুকে আক্রমণ করবে যদি আজ আপনি এদের প্রশ্রয় দেন। আপনার “ইজ্জত” এত সস্তা না যে কেউ গায়ে হাত দিলে তা চলে যাবে। “সমাজের” কথায় পাত্তা দেবেন না। যেই  সমাজ সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের শিকার মেয়েটাকেই উল্টো বলে যে তার চলন বলন ঠিক নেই, সেই সমাজ একটা অপরাধী সমাজ। এর না আছে আপনাকে রক্ষা করার ক্ষমতা, না আছে আপনার দিকে আঙুল তোলার অধিকার।’

বিজ্ঞাপন

মাসরুফ হোসেন ও বিশিষ্ট খিউকুশিন কারাতে প্রশিক্ষক সেনসেই আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ হোসাইনের উদ্যোগে পয়লা বৈশাখসহ রাস্তাঘাটে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।  পর্যায়ক্রমে এক একটি দল ‘যোদ্ধানারী’ নামের এই প্রশিক্ষন নেন। ১৬টি সেশনে বিভক্ত আড়াই মাসের এই প্রশিক্ষণে ১৩ থেকে শুরু করে যেকোন বয়সী নারী অংশ নিতে পারেন। সেনসেই আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ হোসাইন বলেন, শুধু পয়লা বৈশাখ নয়, শৈশব থেকে প্রতিটি মেয়ের আত্মরক্ষার কৌশল শেখাটা জরুরি। লেখাপড়া, গানবাজনার পাশাপাশি এই জিনিসটিও সব মেয়েকে জানতে হবে।

দেশে যোদ্ধানারী ছাড়াও বিভিন্ন কারাতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো হয়। এ ধরনের প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। সাথে চাই আত্মবিশ্বাস, সাহস, সচেতনতা, আত্মসম্মানবোধ এবং নিজেকে একজন পূর্ণ মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখা।

বর্ষবরণের আনন্দে যোগ দিতে মেয়েদেরও বের হতে হবে সদলবলে। পয়লা বৈশাখের আগের প্রস্তুতির লিস্টে সাজগোজ আর রান্নাবান্নার সাথে সাথে  বখাটেরদেরকে শায়েস্তা করার জন্যে শারিরীক ও মানসিক প্রস্তুতির বিষয়টিও যোগ করে নিতে হবে ।

এখনই সময়, গাইতে হবে নতুন গান- ‘‘সাহসী মেয়ের ভিড়ে বখাটেদের রেহাই নাই; মেলাই যাইরে!’’

 

 

সারাবাংলা/জেএম/এসএস

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর