Friday 06 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঐতিহ্য অহংকারের জব্বারের বলীখেলা

আজহার মাহমুদ
২৫ এপ্রিল ২০২২ ১৬:২১
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বলীখেলা, যা এক বিশেষ ধরনের কুস্তি খেলা। এই খেলায় অংশগ্রহণকারীদেরকে বলা হয় বলী। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তি ‘বলী খেলা’ নামে পরিচিত। চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে প্রতিবছরের ১২ বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয় জব্বারের বলী খেলা। ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এই প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। তার মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। জব্বারের বলী খেলা একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমন্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত। বলী খেলাকে কেন্দ্র করে লালদিঘী ময়দানের আশেপাশে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার সবচেয়ে বৃহৎ বৈশাখী মেলা।

বিজ্ঞাপন

ভারতবর্ষের স্বাধীন নবাব টিপু সুলতানের পতনের পর এই দেশে বৃটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একইসঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলী খেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন।

চট্টগ্রামের মুরুব্বিদের ভাষ্য, চট্টগ্রাম বলির দেশ। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচন্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলিখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলি খেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা। কিন্তু এখন পেশাদার বলির (কুস্তিগীর) অভাবে বলিখেলার আকর্ষণ অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে পেশাদার বলি পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে। এখন আর কেউ বলি কিংবা কুস্তি খেলতে আগ্রহ দেখায় না। আগে গ্রামে গ্রামে এমন কুস্তি আর বলি খেলা হতো। আজ সেই দৃশ্য প্রায় কল্পনার পর্যায়ে চলে গেছে। তাই এই বিষয়টা আমাদের সকলের ভাবতে হবে। এখন থেকে তরুণ প্রজন্মকে এ খেলার প্রতি আগ্রহী করতে হবে। যেন এই ঐতিহ্য কখনও হারিয়ে না যায়।

বিগত দুই বছর করোনার কারণে এই বলী খেলা বন্ধ ছিলো। এই বলী খেলাকে কেন্দ্র করে যে মেলা গড়ে উঠে সেটাও বন্ধ ছিলো গত দু’বছর। এবছর জব্বারের বলী খেলার ১১৩ তম আসর অনুষ্ঠিত হবে। দু’বছর পর ঐতিহ্যের এই আসর ফিরে এসেছে এটাতেই চট্টগ্রামের তথা সারা দেশের মানুষ খুশি। বাংলাদেশের নানা জায়গা থেকে ছুটে আসে এই বলী খেলা দেখতে। সেই সাথে এই বলী খেলাকে কেন্দ্র করে যে মেলা হয় সেখানেও ফুঠে উঠে বাঙ্গালীয়ানার মুনসিয়ানা। বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, কালচার বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই মেলাটিও চমৎকার একটি উদাহরণ।

তাই অনেকে বলী খেলার পরিবর্তে একে বৈশাখী মেলা হিসেবেও চিনে। জব্বার মিয়ার বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়। খেলাকে কেন্দ্র করে তিন দিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও কার্যত পাঁচ-ছয় দিনের মেলা বসে লালদীঘির ময়দানের আশপাশের এলাকা ঘিরে।

জব্বারের বলী খেলার পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন স্থানে যেমন কক্সবাজারে ডিসি সাহেবের বলী খেলা, সাতকানিয়ায় মক্কার বলি খেলা, আনোয়ারায় সরকারের বলী খেলা, রাউজানে দোস্ত মোহাম্মদের বলী খেলা, হাটহাজারীতে চুরখাঁর বলী খেলা, চান্দগাঁওতে মৌলভীর বলী খেলা এখনও কোনরকমে বিদ্যমান। তবে জব্বারের বলী খেলা বর্তমানে বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল “চ্যানেল আই”তে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়ে থাকে। কয়েক বছর ধরে সিআরবি’র সিরিষ তলায় অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে সাহাবউদ্দিনের বলী খেলা। এটি অবশ্য পহেলা বৈশাখকে ঘিরে আয়োজন করা হয়ে থাকে।

জব্বরের বলী খেলার বর্তমান চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার শাহজালাল বলী। জব্বারের বলী খেলায় এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ চ্যাম্পিয়ন দিদার বলী। তিনি সর্বোচ্চ ১৩ বার বিজয়ী হয়েছেন। বর্তমানে দিদার বলী এ খেলা থেকে অবসরে আছেন। বলী খেলা যারা নিয়মিত দেখতে আসেন তাদেরই একজন জানান, যাকে তাকে সুযোগ না দিয়ে প্রকৃত বলীদের খেলায় সুযোগ দেওয়া উচিত। এতে করে এ খেলার মান এবং দর্শক দুটোই বেঁচে থাকবে। আশা করি, এসকল বিষয় কতৃপক্ষের দৃষ্টিতে আসবে।

পরিশেষে বলতে চাই, জব্বারের বলী খেলা আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, কালচার বাঁচিয়ে রাখার অনন্য নিদর্শন। প্রশাসনের উচিৎ এই নিদর্শনটি বাঁচিয়ে রাখতে সবধরনের সহযোগিতা করা।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

আজহার মাহমুদ ঐতিহ্য অহংকারের জব্বারের বলীখেলা

বিজ্ঞাপন

এ কোন রণবীর!
৬ জুন ২০২৫ ১২:৪৫

আরো

সম্পর্কিত খবর