চুকনগর জেনোসাইড, একসঙ্গে সর্বোচ্চ মানুষ হত্যার বীভৎসতা
২০ মে ২০২২ ১৫:১৮
একদিনে একসঙ্গে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ মেরে ফেলার রেকর্ড হিসেবে লিপিবদ্ধ আছে ভিয়েতনামের মাইলাই গণহত্যার কথা। দেড় হাজার মানুষকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল মাইলাইতে। ১৯৭১ সালের ২০ মে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অধিকৃত স্বাধীন বাংলাদেশের খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে মাত্র ৪ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যা করেছিল কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষকে। সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা। লাইট মেশিনগান সজ্জিত পাকিস্তানি কন্টিনজেন্ট। চার মাইল এলাকা। চার ঘণ্টা। কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষ। কিন্তু তবুও এই অচিন্ত্যনীয় নির্মমতম গণহত্যার কথার উল্লেখ নেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো জেনোসাইডাল ডকুমেন্টসে, হাজার হাজার মানুষের ভয়ার্ত আর্তচিৎকারের খবর আমরাই জানার চেষ্টা করিনি!
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো— চার ঘণ্টাব্যাপী এই অবিরাম ব্রাশফায়ার আর হত্যাযজ্ঞ সেদিন থেমে যেতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায়! দলটির নেতৃত্বে ছিলেন পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ হায়াত। বিকেল ৩টার দিকে গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার পর আর সামনে বাড়ার নির্দেশ দিতে পারেননি তিনি। এরই মধ্যে পায়ের নিচে মাটি আর নদীর পানি নিরীহ বাঙালির টাটকা তাজা রক্তে ভেসে গেছে, পায়ের নিচে জমেছে লাশের স্তূপ। সেদিন যদি রক্তলোলুপ উন্মত্ত নরপিশাচ হায়াতের বাহিনীর গুলি না ফুরাত, আরও কত মানুষ মারা যেত সেদিন?
ভারতীয় সীমান্তের নিকটবর্তী হওয়ায় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পর বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন সীমান্ত অতিক্রমের জন্য জড়ো হতেন চুকনগরে। ভদ্রা, কাজীবাছা, খড়িয়া, ঘ্যাংরাইল প্রভৃতি নদীপথে এবং কাঁচা রাস্তায় দাকোপ, বটিয়াঘাটা, রামপাল, তেরখাদা ও ফকিরহাট উপজেলা থেকে খুলনা-ডুমুরিয়া হয়ে চুকনগর ছিল ওই সময়ের বিবেচনায় ভারতমুখী সবচেয়ে নিরাপদ রুট। মাটির রাস্তা ও অসংখ্য নদীর কারণে বিচ্ছিন্ন এই পথ দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চলাচল করত না। ভারতগামী ক্লান্ত লোকজন চুকনগরে বিশ্রাম নেওয়ার পাশাপাশি সীমান্ত পর্যন্ত পরবর্তী রাস্তার অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন। এখান থেকে ভারতে যাওয়ার মূল রুট ছিল মঙ্গলকোট-সরসকাটি-কলারোয়া হয়ে হাঁটা পথে। খুলনা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ভারত সীমান্তবর্তী ভদ্রা নদীর তীরবর্তী এই অঞ্চলটি পড়েছে ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নে।
এই গণহত্যার প্রতক্ষ্যদর্শী খুলনার বটিয়াঘাটার উত্তর রাঙ্গেমারি গ্রামের বলাইও বলেন, এই পথের সুবিধার কথা জেনে মে মাসের পর সীমান্ত পথযাত্রীদের ভিড় বাড়তে থাকে। মে মাসের ১৮ ও ১৯ তারিখে দেশ ছাড়তে জনস্রোত যেন সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। আটলিয়া ইউনিয়নের মালতিয়া গ্রামের এরশাদ আলী শোনান সেদিনের কথা, ওইদিন তার বাবা কৃষক চিকন আলী মোড়লকেই প্রথম গুলি করে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল পাকিস্তানি সেনারা।
তিনি বলেন, তখন আটলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন গোলাম হোসেন। তিনি যুদ্ধ শুরুর পর নাম লেখান শান্তি বাহিনীতে। সেই গোলাম হোসেন ও ভদ্রা নদীর খেয়া ঘাটের ইজারাদার শামসুদ্দিন খাঁ নামের এক বিহারি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাতক্ষীরা ক্যাম্পে গিয়ে খবর দেয় চুকনগর বাজারে ভারতে যেতে হিন্দুদের ঢল নেমেছে। খবর পেয়ে ক্যাম্প থেকে রওনা হয় সেনাবোঝাই একটি ট্রাক ও জিপ। অন্য এক ভাষ্যে পাওয়া যায় মূলত খেয়াঘাটে এক বিহারি খানের সঙ্গে এক বাঙালির কথা কাটাকাটির জের ধরে ওই বিহারি খান এসময় পাকিস্তানি সেনাদের ডেকে স্থানীয়দের দেখিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। ধারণা করা যায়, ওই খানই ছিল ঘাটের ইজারাদার শামসুদ্দীন, যে পাকিস্তানিদের ডেকে এনেছিল।
১৯ মে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ গ্যাংরাইল নদীর পাশের উঁচু এলাকা, চুকনগরের পাতখোলা বিল, ভদ্রা নদীর কাঁচাবাজার, মাছবাজার, কাপুড়িয়া পট্টি, গরুহাটা, বাজারের কালী মন্দির, বটতোলাসহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেয়। ২০ মে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে ১১টা নাগাদ সাতক্ষীরা থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি ট্রাক ও একটি জিপ চুকনগর-সাতক্ষীরা সড়ক ধরে মালতিয়া মোড়ের ঝাউতলায় এসে থামে। এলাকাটি স্থানীয়দের কাছে পাতখোলা নামে পরিচিত। এ সময় পুটিমারি বিলের পাশে নিজ বাড়ি থেকে অল্প দূরত্বে পাট খেতে কাজ করছিলেন এরশাদ আলীর বাবা চিকন আলী মোড়ল। অধিকাংশ শরণার্থী পরিবার সকালের খাবার শেষ করে ভারতে পাড়ি জমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন।
চিকন আলী গাড়ির শব্দে উঠে দাঁড়ানো মাত্র পাকিস্তানি সেনারা তাকে দেখে গুলি করতে গেলে তিনি হাতের কাস্তে ছুঁড়ে মারেন তাদের দিকে, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ব্রাশফায়ার। নিহত হন বৃদ্ধ সুরেন কুন্ডু। তার গলার রুদ্রাক্ষের মালা তাকে হিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছিল।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শীর জবানীতে এসেছে— হাতে কাস্তে ছুঁড়ে মেরে তিনি চেঁচিয়ে বাকি সবাইকে সতর্ক করার চেষ্টা করছিলেন, যেন তারা পালিয়ে যায়। একটু দূরে দাঁড়িয়ে এমন ঘটনাটি চোখের সামনে দেখতে হয় এরশাদকে। সদ্য মৃত বাবার জন্য শোক কিংবা ক্ষোভ কোনো অনুভূতি প্রকাশের সময়টুকু জোটেনি এরশাদের। প্রাণভয়ে বাকিদের নিয়ে ছুটে পালাতে হয় তাকে। তারপর পুটিমারির ঋষিপাড়ার দিগম্বরসহ আরও কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। এরপরেই মূলত শুরু হয় পাকিস্তানি লাইট মেশিনগানের নির্বিচার অবিরাম ব্রাশফায়ার।
এরশাদ জানান, তার বাবাকে হত্যার পর কয়েক দলে ভাগ হয়ে ব্রাশফায়ার করতে করতে এগোয় পাকিস্তানি সেনারা। পাতখোলা বাজারে ঢুকে নিরীহ মানুষদের লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার শুরু হয়। আরেক দল পাতখোলা বিল থেকে চাঁদনী, ফুটবল মাঠ, চুকনগর স্কুল, মালতিয়া, রায়পাড়া, দাসপাড়া, তাঁতিপাড়া, ভদ্রা ও ঘ্যাংরাইল নদীর পাড়ে জমা হওয়া মানুষের উপর গুলি চালাতে শুরু করে। পরে গুলি চালাতে চালাতে চুকনগর বাজারের দিকে অগ্রসর হয়। প্রাণভয়ে মানুষ সেদিন পুকুরে, ডোবায়, ভদ্রাপাড়ের বিশাল ঘন গাব গাছ, কালীমন্দির, কালীবাড়ির বটের শেকড়ের নিচে বড় গর্তে পালিয়েও বাঁচতে পারেনি। বটের আড়ালে থাকা মানুষগুলোকে পাকিস্তানি সেনারা নৌকা থেকে গুলি করে মারে, গাব গাছের মানুষগুলোকে মারে পাখি মারার মতো।
অসহায়ের মতো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যু অথবা সবকিছু, এমনকি সন্তান পর্যন্ত ফেলে পালানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না চুকনগরের দুর্ভাগা হাজারও মানুষের। মানুষের ভিড় এবং হৈচৈয়ের মধ্যে অনেকে বুঝতে পারেনি, অনেকে বুঝতে পেরেও পালাতে পারেনি পথঘাট চিনত না বলে। রাঁধতে অথবা খেতে বসেছিল অনেকে, অনেকে ছিল পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন— চাইলেও পরিবারের বাকি সদস্যদের একত্র করে পালাতে পারেনি।
বিকেল ৩টা পর্যন্ত চলে ভয়াবহ এই নরমেধযজ্ঞ। কত মানুষকে যে হত্যা করা হয়েছে, তার সঠিক কোনো সংখ্যা জানা অসম্ভব। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চুকনগর গণহত্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিক ফজলুল বারী দৈনিক জনকণ্ঠের এক নিবন্ধে লিখেছিলেন—
‘লাশের ওপর লাশ, মায়ের কোলে শিশুর লাশ, স্বামীকে বাঁচাতে স্ত্রী জড়িয়ে ধরেছিল। বাবা মেয়েকে বাঁচাতে জড়িয়ে ধরেছিল। মুহূর্তে সবাই লাশ হয়ে যায়। ভদ্রা নদীর পানিতে বয় রক্তের বহর, ভদ্রা নদী হয়ে যায় লাশের নদী। কয়েক ঘণ্টা পর যখন পাকিস্তানিদের গুলির মজুত ফুরিয়ে যায় তখন বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছিল মানুষগুলোকে।’
প্রত্যক্ষদর্শী দেবীতলার প্রফুল্ল কুমার ঢালীর ভাষায়—
‘সেদিন কত লোক দেখিলাম বলা মুশকিল। আমি ওখানে কয়েক বিঘা এলাকা ঘুরিছি। সব জায়গায় শুধু লাশ আর লাশ। গায়ে গায়ে লাশ। লাশের উপরে লাশ। সব মরি পড়ি আছে। কোথাও পা দেওয়ার জায়গা নাই। অনেক সময় লাশ পারায় যাতি হইছে। নদীর পাশ দিয়েও অনেক লাশ। নদীর ভিতরেও অনেক লাশ ভাসতিছে। রক্তে চারদিক লাল হইয়ে গেছ। মাটি-জল সব লাল।’
তবে যারা সেদিন লাশ ফেলেছিলেন, তাদের ভাষ্য থেকে ধারণা করা হয়— কমপক্ষে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার মানুষকে সেদিন হত্যা করেছিল পাকিস্তানিরা। তাদের রক্তে লাল হয়ে ওঠে ভদ্রা নদীর পানি। এরশাদ আলী বলেন, দীর্ঘ চার ঘণ্টা ধরে চলা গণহত্যা গুলি ফুরিয়ে আসার কারণে থেমে যায় দুপুর ৩টায়। যারা সাঁতরে নদীর ওপাড়ে পৌঁছাতে পেরেছিলেন, তারাই কেবল বাঁচতে পেরেছিলেন। ভদ্রা নদীর পানির রঙ পাল্টে যায় সেদিন। লাল টকটকে রক্তে ভেসে যায় পুরো নদী, কোথাও কোথাও লাশের কারণে নদীপথও আটকে যায়।
লাশ পচে বিকট গন্ধ বের হতে শুরু করলে নদীতে ফেলে দেওয়ার জন্য চুকনগর বাজার কমিটির সদস্য সিরাজ উদ্দীন মোড়ল, গোলাম হোসেন নুরুজ্জামান ও হায়দার নামের তিন ব্যক্তি লাশ নদীতে ফেলার জন্য লোক ঠিক করে। বলা হয়, লাশপ্রতি ৫০ পয়সা পারিশ্রমিক দেওয়া হবে। ৪০-৪২ জন মানুষ তখন পারিশ্রমিকের বিনিময়ে লাশ নদীতে ফেলতে শুরু করেন। তাদের একজন আনসার আলী সরদার জানিয়েছিলেন, তারা সারাদিন ধরে ৪২ জন মিলে ২১টি বাঁশে করে লাশ ঠেলে নদীতে ফেলেছিলেন। প্রতিবার ২শ করে লাশ। একুশ তারিখ থেকে চব্বিশ তারিখ পর্যন্ত ৪২ জন মিলে চার হাজার লাশ গুনে হাল ছেড়ে দেন।
সেদিনের লাশ নদীতে ফেলানোর কাজে দায়িত্বে থাকা মো. ওয়াজেদ আলী বলেন, দু’জনে মিলে একটি লাশ সে সময় আমরা ভদ্রা নদীতে ফেলেছি। এভাবে চার হাজার লাশ আমরা গুনেছিলাম। এরপর আর গুনিনি।
ওয়াজেদ আলীর দেওয়া তথ্যমতে, চার হাজার লাশ গোনা সম্ভব হলেও তার দ্বিগুণের বেশি, তিন গুণের কাছাকাছি লাশ তারা নদীতে ফেলেছেন। তবে স্থানীয় একাধিক বৃদ্ধ জানিয়েছেন, এরপরও অনেক লাশ ক্ষেতের মধ্যে, বনজঙ্গলে, বাড়ির মধ্যে পড়েছিল। এমনকি ভদ্রা নদীর আশপাশে তখন যাওয়া যেত না গলিত মরদেহের গন্ধে। চুকনগরের ধানী জমিতে চাষ দিতে গেলে এখনও মানুষের হাড়গোড় ওঠে আসে। শুধু মানুষের হাড়গোড় নয়, সোনার আংটি কিংবা কানের দুল পাওয়া যায় মাটির মধ্যে। নিহত মানুষের স্বর্ণালংকার দেহাবশেষ এখনো চুকনগরের মাটিতে মিশে যায়নি।
সেদিন বিকেল ৪টার দিকে বর্তমান চুকনগর কলেজের সামনে পাতখোলা বিলে তখন গুলিবিদ্ধ অসংখ্য লাশের স্তূপ। এরশাদ আলী বাবার লাশ খুঁজতে বেরিয়েছেন। হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় এক ফুটফুটে শিশুর দিকে, কন্যা শিশু, গায়ে রক্তমাখা। গুলিতে মারা যাওয়া মায়ের স্তনের বোঁটা চুষে আকুল চেষ্টায় দুধপানের চেষ্টা করছিল শিশুটি। ভয়ংকর এই দৃশ্যটা দেখে চোখের সামনে বাবা হারাবার প্রচণ্ড শোক গৌণ হয়ে যায় এরশাদ আলীর কাছে। কোলে তুলে নেন মেয়েটিকে, নিয়ে আসেন বাড়িতে। নাম রাখেন ‘সুন্দরী’।
মৃত মায়ের কপালে সিঁদুর ও হাতের শাখা দেখেই বুঝেছিলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বী তারা। সুন্দরীকে সনাতন ধর্মাবলম্বী এক পরিবারেই বড় করেন তিনি। ১৯৮৪ সালে তার বিয়ে হয় একই এলাকার বাটুল সরকারের সঙ্গে। ১৯৯০ সালে স্বামীকে হারানো এই নারী আছেন ছেলেদের সঙ্গে। ডুমুরিয়া উপজেলার কাঁঠালতলা নদীরপাড়ে সরকারিভাবে বরাদ্দ পাওয়া আবাসন প্রকল্পের একটি টিনশেড ঘরে বসবাস করেন সুন্দরী। ডুমুরিয়া উপজেলা শিল্পকলা একাডেমিতে অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরিও করছেন।
এক সাক্ষাৎকারে সুন্দরী বলেছিলেন, ‘আমি তো জানি না আমার পৈত্রিক বাড়ি কোথায়, কোথা থেকে এসেছিলেন আমার মা-বাবা। চুকনগরের এই জায়গায় এলে শুধু বুকটা হু হু করে ওঠে আমার। জানতে ইচ্ছা করে মা-বাবার পরিচয়।’
সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গণহত্যার স্মৃতি সংরক্ষণে মাত্র ৯৩০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে ছোট্ট একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে আসা মানুষের বসারও কোনো জায়গাও নেই। শুধু একটি বোর্ডে গণহত্যার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখা রয়েছে। বাউন্ডারি ওয়ালের অবস্থাও নাজুক। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন তত্ত্বাবধায়ক থাকলেও তাকে ভাতা দেওয়া হয় মাত্র তিন হাজার টাকা।
‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরে’র সাধারণ সম্পাদক ডা. শেখ বাহারুল আলম ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৪৬ বছর পরও চুকনগর গণহত্যা স্মৃতিস্তম্ভটি পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। এটি আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।
খুলনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সরদার মাহাবুবার রহমান জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে বধ্যভূমি এলাকায় ভাস্কর্য, উদ্যান, লাইব্রেরি, অডিটোরিয়াম ও জাদুঘর নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু তাদের সেই দাবি উপেক্ষিত হচ্ছে।
শুধু সুন্দরী নন, সেদিন পিতা-মাতা হারানো এমন অসংখ্য মানুষ হয়তো আজো জানেন না তাদের পরিচয়, সন্তানহারা অসংখ্য মা-বাবা আজও খুঁজে ফেরেন তাদের বুকের মানিককে। যারা নিহত হয়েছেন, তারা তো চলে গেছেন হিসাবের ঊর্ধ্বে। কিন্তু বেঁচে থাকা দুর্ভাগা মানুষগুলো আজও সঙ্গে করে বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই বীভৎস, ভয়াবহ স্মৃতি— যেদিন মানুষের রক্তে উৎকট উল্লাস করেছিল একপাল নরপিশাচ!
কী করেছি আমরা শহিদদের স্মৃতিটুকু বাঁচিয়ে রাখতে? তাদের সীমাহীন আত্মত্যাগ আর হাহাকারের বেদনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানোর ব্যবস্থা করতে? এই হাজারও মানুষ, তাদের অজুত-নিযুত হাসিকান্নার গল্পসমেত মিশে গেছেন এই মাটিতে। তাদের ত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে এই দেশ, স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে আমাদের মাথা উঁচু করে চলা! শ্রদ্ধা আর নতশিরে যেখানে তাদের সর্বোচ্চ সম্মান আর মর্যাদায় স্থান দেওয়ার কথা ছিল আমাদের সমাজে, মানসিকতায়, ভালোবাসায়; সেখানে তাদের কি আদৌ একবার হলেও স্মরণ করার প্রয়োজনবোধ করি আমরা?
লেখক: অ্যাক্টিভিস্ট
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা:
১। ‘চুকনগর গণহত্যা’ – মুনতাসীর মামুন
২। ভদ্রা নদীর পানির রঙ বদলে দেওয়া চুকনগর গণহত্যা – বিডিনিউজ২৪ ডটকম
৩। ‘৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ’ – ডা. এম এ হাসান
৪। Chuknagar: Remembering Massacre of 10000 Civilians – Daily Sun
৫। হাসান আহমেদ ও সাখাওয়াত হোসেন
সারাবাংলা/এসবিডিই/টিআর