সাপে কামড়ালে কী করবেন?
২২ জুন ২০২২ ১৭:০৩
বর্ষা শুরু হতেই এ বছর দেশের অনেক জেলায় শুরু হয়েছে বন্যা। বিশেষ করে সুনামগঞ্জ ও সিলেটের অবস্থা তো ভয়াবহ। এই দুটি জেলা এখনও প্লাবিত। পানিবন্দি মানুষগুলো আতঙ্কে-শংকায় দিন কাটাচ্ছেন। ধীরে ধীরে পানি নামলেও বন্যা এখন চোখ রাঙাচ্ছে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোতে। বন্যায় জনজীবন পড়েছে বিপর্যয়ের মুখে।
বর্ষায়-বন্যায় মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন পশুপাখি, প্রাণীও হয়েছে বাস্তুহারা। অন্যান্য প্রাণীর পাশাপাশি সাপদেরও বাসস্থান সংকট দেখা দেয় এই সময়ে। তাদের থাকার জায়গা গর্তগুলো পানিতে ভরে যায়। গবেষকদের মতে, বর্ষায় সাপ ডাঙ্গায় বা শুকনো জায়গায় বসবাস করে অথবা করতে চায়। এ সময় চারদিকে পানি থাকায় বিষধর সাপও শুষ্ক ও উঁচুস্থানের সন্ধানে মানুষের ঘরে ঢুকে পড়ে। শুধু মানুষের বসবাসের ঘরই নয় রাস্তা, জমির আইল, কবরস্থান, কাঠের স্তুপ, খড়ের গাদা থেকে শুরু করে ঘরের খাটের তলায়, আলনার নীচে যেকোনো জায়গাতেই সাপ আসতে পারে। আর এই অবস্থানের সময়ে সাপে-মানুষে দেখা হলে সাপ ভয় পেয়ে মানুষকে কামড় দেয়। সাপে কাটার ঘটনা গ্রামাঞ্চলে বা কৃষিসংশ্লিষ্ট এলাকায় বেশি হয়। প্রতি বছর বন্যার সময় সাপে কামড়ানো প্রাদুর্ভাব হিসেবে দেখা দেয়। বর্ষায় সকাল ও সন্ধ্যায় সাপে কামড়ানোর ঘটনা বেশি ঘটে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২০ সালের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছর অন্তত পাঁচ লাখ আশি হাজার মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। আর সাপের কামড়ে অন্তত ছয় হাজার মানুষ মারা যান। প্রতিবছর বন্যার সময় অর্থাৎ মে, জুন এবং জুলাই -এই তিন মাস সাপের কামড় এবং তার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে।
বাংলাদেশে মোটামুটি ৮০টি প্রজাতির সাপ রয়েছে। এদের অধিকাংশই নির্বিষ। আর সাত থেকে আট প্রজাতির অত্যন্ত বিষধর। এই সাপগুলোর কামড়েই মানুষ বেশি মারা যায়। তবে বাংলাদেশে যতজন সাপের কামড়ে মারা যায়, তার চারগুণ মানুষের নানা রকম অঙ্গহানি ঘটে, কেউ শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে যান, কেউ দীর্ঘদিন আতঙ্কে ভোগেন।
বাংলাদেশে একটা প্রচলিত ভুল ধারণা আছে সাপে কাটলেই মানুষের মৃত্যু হবে। কিন্তু ৮০ শতাংশ সাপের কামড়ের ক্ষেত্রেই দেখা যায় সাপ থাকে নির্বিষ। সাপের কামড়ের পর প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত যত দ্রুত সম্ভব সাপে কামড়ানোর ওষুধ বা অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা। তাহলেই কেবল মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। আর এই অ্যান্টিভেনম পাবেন সরকারি হাসপাতালগুলোতে। এই অ্যান্টিভেনম জেলা শহর, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সদর হাসপাতালে থাকে। বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রয়োজন এবং চাহিদা অনুযায়ী উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়। সাপের কামড়ে আক্রান্ত হওয়ার পর কিছু পদক্ষেপ নিলে রোগীর জীবন বাঁচানো সহজ হয়। আর কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে সাপের কামড় এড়ানো যায়। সারাবাংলার সঙ্গে সেই বিষয়গুলো নিয়েই কথা বলেছেন বিআরবি হাসপাতালের চিকিৎসক শাহনাজ পারভীন।
সাপে কামড়ালে করণীয়
সাপে কামড়ালে প্রথমেই রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে। রোগীকে অভয় দিয়ে শান্ত রাখতে হবে। একদমই আতঙ্কিত হতে দেওয়া যাবে না। কারণ সাপের কামড়ে যত মানুষ মারা যায় তার চাইতে বেশি মানুষ মারা যান কামড় খেয়ে আতঙ্কিত হওয়ার ফলে। সাপের কামড়ের পর আতঙ্কে ডায়াবেটিক রোগীদের ব্লাড লেভেল বেড়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় রোগীকে কিছু খেতে বা পান করতে দেওয়া যাবে না। যেখানে সাপটি কামড় দিয়েছে সেই স্থানটি যতটুকু সম্ভব নড়াচড়া না করানো যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। পানিতে সাপ দেখে ভয় পাবেন না, যদি পানিতে থাকা অবস্থায় কাউকে সাপে কামড় দেয় তবে ভয় পাওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। কারণ আপনি ধারণা করে নিতে পারেন যে পানিতে সাপটি যখন কামড় দিয়েছে তখন তার বিষ শরীরে প্রবেশের আগেই পানিতে মিশে গেছে।
সাপে কামড়ানো জায়গা তৎক্ষণাৎ পরিষ্কার ব্যান্ডেজ বা সুতির কাপড় দিয়ে ঢেকে দিন, যাতে ধুলোবালি না লাগে। হাতের কোনো অংশে সাপে কাটলে সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ি, ব্রেসলেট, আংটি ইত্যাদি খুলে ফেলুন। কাপড় ঢিলেঢালা করে দিন। আক্রান্ত ব্যক্তিকে শুইয়ে দিন। সাপে কামড়ানো ব্যক্তিকে কখনোই কাত করে শোয়ানো যাবে না। সব সময় সোজা করে শোয়াবেন। তার বুকের নিচে কিছু একটা দিয়ে বুকটা উঁচু করে রাখুন কিংবা রোগীকে এমনভাবে শোওয়ান যেন কামড়ের স্থান হৃদযন্ত্র বরাবর কিছুটা নিচের দিকে থাকে। অর্থাৎ রোগীর আক্রান্ত স্থানকে হার্ট লেভেলের নিচে রাখতে হবে।
কামড় দেখে বুঝতে হবে যে এটি বিষাক্ত সাপে কামড়েছে নাকি বিষহীন সাপে কামড়েছে। তারপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। বিষাক্ত সাপের কামড়ে দুটি দাঁত বসে গিয়ে ক্ষত তৈরি হয়। বিষহীন সাপের কামড়ে অনেকগুলো দাঁতের আঁচড় পড়তে পারে। বিষাক্ত সাপের কামড়ে ক্ষতস্থান জ্বালাপোড়া করে। সম্ভব হলে সাপটি দেখতে কেমন তা লক্ষ্য করুন। সাপের বর্ণনা পরবর্তীতে চিকিৎসা পরিকল্পনায় সাহায্য করতে পারে। বিষহীন সাপে কামড়ালে অতিরিক্ত ভয় বা চিন্তার তেমন প্রয়োজন নেই। তবুও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কামড় দেখে সনাক্ত করতে ক্ষতস্থান রক্তাক্ত থাকলে আগে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
কোনো অবস্থাতেই বিষ চুষে বের করার চেষ্টা করা ঠিক নয়। সাপে কামড়ানোর জায়গায় কোনো ধরনের ওষুধ বা কেমিক্যাল ব্যবহার করা ঠিক নয়। বরং আপনি জায়গাটিকে সাবান বা আয়োডিন দিয়ে পরিষ্কার করতে পারেন। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় সাপ যেখানে কামড় দিয়েছে সেখানে কেটে রক্ত বের করার চেষ্টা করা হয়। এতে লাভ কিছুই তো হবে না বরং আশপাশের রক্ত সংবহনতন্ত্র বা স্নায়ুতন্ত্র কেটে যেতে পারে।
সাপ যদি হাতে বা পায়ে কামড় দেয় তাহলে বাঁধন দিতে হবে। বাঁধনটি যেন খুব বেশি শক্ত না হয়। বাঁধনটি এমনভাবে দিতে হবে যেন একটা আঙুল ওই বাঁধনের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। দংশিত স্থানের কিছুটা ওপরে দড়ি বা হাতের কাছে যা পান, তা দিয়েই বেঁধে ফেলুন। তবে গামছা, মাফলার, ওড়না এমন কাপড় দিয়ে বাধা উচিত। মনে রাখবেন বাঁধনটা যেন অস্থিসন্ধিতে যেমন কনুই, কবজি বা গোড়ালি এবং গলা বা মাথায় না হয়। যদি বাঁধনটি শক্ত হয়, তাহলে ঢিলা করে দেবেন, তবে কখনোই তা খুলে ফেলবেন না। যে দড়ি বা কাপড় দিয়ে বাঁধবেন তা যেন চওড়ায় দেড় ইঞ্চি হয়, কখনো তা যেন সরু সুতোর মতো বা রাবার ব্যান্ডের মতো না হয়। বাঁধনটি দেয়ার উদ্দেশ্য হলো রক্ত চলাচল বন্ধ রাখা। তবে বাঁধনটি একটানা ২০ মিনিটের বেশি রাখবেন না। প্রতি ১০ মিনিট অন্তর তা আলগা করে দিতে হবে। সাপে কাটা জায়গায় শক্ত করে বাঁধলে রক্ত জমে গিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তি পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন।
বিষাক্ত সাপে কাটলে বাঁচার পথ একটাই। দ্রুত হাসপাতাল যাওয়া। দংশনের পর আত্মীয়ের পরামর্শ, ওঝা-ঝাড়ফুঁকের নামে এক সেকেন্ড সময় নষ্ট না করে সোজা রোগীকে নিয়ে বড় সরকারি হাসপাতালে যান। বাংলাদেশে রাসেল ভাইপার বাদে সব সাপেরই বিষের অ্যান্টিভেনম আছে। চিকিৎসা শেষে ২৪ ঘন্টার মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। আর যদি বুঝতে পারেন সাপটা বিষধর নয়, তাহলে কী করবেন? তবুও হাসপাতালে যাবেন। ভর্তি হয়ে প্রয়োজনে বিছানায় ২৪ ঘন্টা বসে থাকবেন। তবুও হাসপাতালে যাবেন। অধিকাংশ সাপই নির্বিষ। সাপ মারবেন না। সাপ বাস্তুতন্ত্রের অংশ। ঘরে সাপ পাওয়া গেলে সাপের উদ্ধারকারী বা বন বিভাগে জানাতে পারেন। ওঝাদের জানিয়ে সাপটি মেরে পরিবেশ থেকে এসব সাপ বিলুপ্ত করবেন না।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি