ফরাসি বিপ্লব ও সুইস গার্ডের বিশ্বস্ততা
১১ আগস্ট ২০২২ ১৬:৪৭
প্রাচীনকাল থেকে ইউরোপে বিশ্বস্ততা আর আনুগত্যের প্রতীক হয়ে আছে সুইস সৈন্যরা। এরা ভাড়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সেনাবাহিনীতে কাজ করত। প্রাচীন রোমান পণ্ডিত ট্যাসিটাস লিখে গেছেন, হেলভেশিয়ানরা (সুইস) যোদ্ধা জাতি। তাদের সৈন্যদের বীরত্বের জন্য তারা বিখ্যাত। ফ্রান্স ও স্পেনের রাজদরবারে তাদের বিশেষ চাহিদা ছিল। তাদের নিয়ে বিশেষ সৈন্যবাহিনী গঠিত হত। ফরাসী বিপ্লবের সময় তাদের আত্মত্যাগ ইতিহাসে অম্লান হয়ে আছে।
১৭৯২ সাল, প্যারিস। তিন বছর ধরে রাজার বিরুদ্ধে ক্ষোভ চরম আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে ১৭৮৯-তে বাস্তিল দুর্গের পতনের মাধ্যমে জনগণ বুঝতে পেরে যায় রাজার আসলে প্রতিরোধের ক্ষমতা শেষ পর্যায়।
ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, বেকারত্বর; পাশাপাশি অভিজাতদের বিলাসবহুল জীবনযাপন, ফ্রান্সের নাগরিকদের রাজা ষোড়শ লুইয়ের বিরুদ্ধে খ্যাপিয়ে তুলেছিল। এর প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমে আসে জনগণ। ফ্রান্সের রানী মারি অ্যান্টোয়েনেটের প্রতিও জনসাধারণের ধারণা তেমন ভালো ছিল না। এমন একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে রানী রুটির দাম বেড়ে গেছে বলে কেক খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ষোড়শ লুইয়ের ফ্রান্সের রাজা হওয়ার কথা ছিল না। রাজ্য পরিচালনার জন্য তার ভাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, লুই রাজা হয়ে যান। তার উপর লুইয়ের স্ত্রী আন্তোনাইট ফরাসি ছিলেন না, অস্ট্রিয়। এটাও ফরাসিরা ভালো ভাবে নেয় নি। তাদের বিবাহ এবং ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনেক গসিপ ছিল। যুদ্ধ এবং উপনিবেশ সম্প্রসারণে রাজা তখন প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। এসব করতে গিয়ে ষোড়শ লুই আর্থিক টানাপোড়নের মধ্যে পড়ে যান। পরিস্থিতি সামাল দিতে কয়েকদিন পর পর অর্থমন্ত্রী পাল্টাতেন। Chateau de Versailles, রাজার রাজকীয় প্রাসাদ, সেখানে নিয়মিত জমকালো পার্টির আয়োজন হত। অথচ সাধারণ মানুষ এক টুকরো রুটি পেতে না দিন শেষে।
যত সময় যাচ্ছে ততই শোরগোল বাড়ছে। প্রাসাদের বাইরে ভিড় বাড়ছে। “ভিভ লা ফ্রান্স” স্লোগান প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সারা প্যারিস জুড়ে। জনগণের ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে গেলে তারা Chateau de Versailles এর দিকে অগ্রসর হয়। তারা প্রাসাদে হামলা চালায়। রাজপরিবারকে জিম্মি করে প্যারিস শহরের মধ্যে তুইলেরিস প্রাসাদে নিয়ে যায়। নতুন সরকার গঠিত হয়। নতুন সরকার ব্রিটেনের মতো সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়।
রাজপরিবার বুঝেছিল তাদের জীবন বিপন্ন। তারা অস্ট্রিয়ায় পালানোর পরিকল্পনা করে। রাজপরিবারের সদস্যরা সাধারণের পোশাক পরে একটি গাড়িতে প্যারিস ত্যাগ করেন। রাজপরিবার পালানোর খবর জানাজানি হলে তাদেরকে ধরার জন্য সতর্কতা জারি করা হয়। একজন পোস্টমাস্টার সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে ভারেনেসে তাদের দেখে ফেলে। তার দেওয়া তথ্যে রাজপরিবার ধরা পড়ে। রাজপরিবার প্যারিসে ফিরে আসে। বেশ রূঢ়ভাবে তাদের প্যারিসে বরণ করা হয়।
রাজার উপর ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ এবং নতুন সরকার রাজার পক্ষে রয়েছে এমন গুজবে, ফ্রান্সের নাগরিকরা তুইলেরি প্রাসাদের চারপাশে জড়ো হতে শুরু করে। রাজপরিবারের পালানোর চেষ্টাও তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এদিকে লুইকে বাঁচাতে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে প্রুশিয়া ও অস্ট্রিয়া। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অনদেশের হস্তক্ষেপ জনগণকে আরো খ্যাপিয়ে তোলে। রাজা, সরকার ও জনগণের সমন্বয়ে গঠিত সাধারণ পরিষদ কোনো সিদ্ধান্তে আসতে ব্যর্থ হয়। সাধারণ পরিষদকে জনগণ রাজার দালাল বলে শ্লোগান দিতে থাকে।
১৭৯২ সালের ১০ শে আগস্ট। হাজার হাজার মানুষ তুইলেরি প্রাসাদের সামনে জড়ো হয়। রাজাকে পদত্যাগ করতে বলে। তাকে রক্ষা করার জন্য রাজার মাত্র ১০০০ জন সুইস ভাড়াটে প্রহরী ছিল। সঙ্গে ন্যাশনাল গার্ডের ৩০০০ সৈনিক। এরমধ্যে একটি শস্যবাহী গাড়ি রক্ষা করার জন্য ৩০০ জন সুইসকে পাঠনো হয়।
প্রতিরক্ষার নেতৃত্বে ছিলেন দক্ষ কমান্ডার মারকুইস ডি মান্দাত। তিনি একটি নির্বাহী আদেশে প্রাসাদের বাইরে এসে তিনি জনতার হাতে নিহত হোন। তারপর থেকে প্রাসাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। প্যারিসের মেয়র এবং অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা তখন রক্তপাত এড়াতে জনগণকে প্রতিরোধ না করতে রাজি করান। রাজা প্রাসাদ ছেড়ে চলে যান। সঙ্গে তিনি নিয়ে ন্যাশনাল গার্ডের বিশাল বহর। সুইসদের প্রাসাদের ভেতরে অবস্থানের নির্দেশ দিয়ে যান।
বিদ্রোহী জনতা তারপর হুড়মুড় করে প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে পড়ে। কয়েকজন বিদ্রোহী নেতা গ্র্যান্ড সিঁড়ি ওঠার সময় জার্মান ভাষায় চিৎকার করে সুইসদের বলেন, ‘জাতির কাছে আত্মসমর্পণ!’
‘আমরা নিজেদের অসম্মানিত করতে পারি না!’ সুইস কমান্ডার পাল্টা উত্তর দেন, ‘আমরা সুইস, সুইসরা তাদের অস্ত্র দিয়ে নয় বরং তাদের জীবন দিয়ে বিভক্ত হয়। আমরা মনে করি যে আমাদের এমন অপমান করার যোগ্যতা তোমাদের নেই’।
সুইসরা তখন প্রাসাদের জানালায় এবং সিঁড়িতে একটি ব্যারিকেডের পিছনে অবস্থান নেয়। হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়। জনতা পিছু হটে। কিছুক্ষণ পর জনতা ফিরে আসে কামান নিয়ে। সুইসরা দ্রুত পাল্টা আক্রমণ করে কামানগুলো দখল করে নেয়। এরপর ধাক্কাধাক্কি করে সুইরা মূল প্রবেশপথের দখল পুনরুদ্ধার করে। সুইসদের সাফল্য জনতাকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। ন্যাশনাল গার্ড সৈন্যরা তখন বিদ্রোহীদের সাহায্য করে সুইসদের প্রাসাদের অভ্যন্তরে ঠেলে দেয়।
রক্তপাতের কথা জানতে পেরে ষোড়শ লুই সুইস গার্ডের কাছে অবিলম্বে পশ্চাদপসরণ করার জন্য একটি আদেশ পাঠান। কিন্তু এটি খুব দেরিতে পৌঁছেছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই নিহত হন, বাকি যারা বেঁচে ছিলেন তারা হয় বন্দী অবস্থায় সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বিদ্রোহে মারা যান। সুইস গার্ডরা কখনই তাদের অবস্থান ছেড়ে যায়নি। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত রাজাকে পাহারা দেয়।
সুইস গার্ডের একজন অফিসার কার্ল ফিফার, যিনি ফরাসি বিপ্লবের সময় তার নিজ শহর লুসার্নে ছুটিতে ছিলেন। তিনি ফরাসী বিপ্লবে নিহত সুইস ভাড়াটে সৈন্যদের জন্য একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণে উদ্যোগ নেন। তার চেষ্টায় ১৮২১ সালে লুসার্নে ‘সিংহের স্মৃতিস্তম্ভ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। স্মৃতিস্তম্ভে দেখা যায় একটি সিংহটি বর্শার ঘায়ে আহত হয়ে বসে আছে। ফরাসি রাজতন্ত্র এবং সুইস রাষ্ট্রের পতাকার উপর সিংহ রয়েছে। স্মৃতিসৌধে ফরাসি বিপ্লবে নিহত সুইস গার্ডের পুরুষদের তালিকাও রয়েছে।
সামরিক প্রযুক্তির অগ্রগতি ও সুইসদের স্থায়ী সেনাবাহিনী না রাখার সিদ্ধান্ত, সুইস ভাড়াটে সৈন্যদের চাহিদা দিন দিন কমে আসে। সুইস গার্ড এখন ভ্যাটিকানে পোপকে নিরাপত্তা প্রদান করে।
লুই আনুষ্ঠানিকভাবে ৩ দিন পরে গ্রেপ্তার হন। তাকে প্যারিসে পাঠানো হয়। ২১শে সেপ্টেম্বর, জাতীয় পরিষদ রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। লুইয়ের বিচারকার্য শুরু হয়। ২১ জানুয়ারি ১৭৯৩-এ তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
সারাবাংলা/এজেডএস