বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল যে ছবি
১২ আগস্ট ২০২২ ১৪:৫৭
১৪ অক্টোবর ১৯৬২। মার্কিন গোয়েন্দা বিমানের তোলা একটা ছবি, সারা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। পৃথিবী আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সারা বিশ্বের মানুষ রুদ্ধশ্বাসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। কী এমন হয়েছিল তখন, আসুন জেনে নেই।
১৯৫৯ সালে ফিদেল কাস্ত্রো একটি বামপন্থী বিপ্লবের মাধ্যমে কিউবার রাষ্ট্রপতি ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে ক্ষমতাচ্যুত একটি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করে। কাস্ত্রো দ্রুত কিউবায় অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে দেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্বের দৃঢ় সম্পর্ক ছিন্ন করে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা প্রতি বিপ্লব ঘটানোর একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
বিপ্লবের পর কিউবা থেকে পালিয়ে আসাদের নিয়ে একটি প্রশিক্ষিত দল গঠন করে সিআইএ। নাম দেয়া হয় ব্রিগেড ২৫০৬। এতে ১৫১১ জন সদস্য ছিলেন। ব্রিগেডের সদস্যরা মার্কিন বিমান বাহিনীর সহায়তায় ১৭ এপ্রিল, ১৯৬১-তে পিগ উপসাগরে অবতরণ করে। কাস্ত্রোর সরাসরি নেতৃত্বে কিউবান সশস্ত্র বাহিনী ২ দিনের যুদ্ধে এদের পরাজিত করে।
ক্যাস্ট্রো শাসনকে উৎখাত করার ব্যর্থ মার্কিন প্রচেষ্টার পরে কেনেডি প্রশাসন অপারেশন মঙ্গুজ নামে আরেকটি পরিকল্পনা করতে থাকে। এরই মধ্যে জুলাই ১৯৬২-তে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভ কিউবার প্রধানমন্ত্রী ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে সোভিয়েত পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের জন্য একটি গোপন চুক্তি করেন। কিউবা ভবিষ্যৎ আক্রমণের প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে সেখানে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসানো হবে। গ্রীষ্মের শেষের দিকে বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র সাইট নির্মাণ শুরু হয়।
কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা বিমানের নিয়মিত নজরদারিতে সোভিয়েত কার্যক্রমের প্রমাণ মেলে। সোভিয়েত IL-28 বোমারু বিমান দেখা যায় কিউবায়। ১৪ অক্টোবর একটি মার্কিন U-2 বিমান বেশ কয়েকটি ছবি তুলে নিয়ে আসে। এতে কিউবায় নির্মাণাধীন মাঝারি-পাল্লার এবং মধ্য-পাল্লার ব্যালিস্টিক পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসানোর (MRBMs এবং IRBMs) স্থানগুলি স্পষ্টভাবে দেখা যায়। পরের দিন ছবিগুলো হোয়াইট হাউসে উপস্থাপন করা হয়।
কেনেডি তার উপদেষ্টাদের ডেকে পাঠান করণীয় নির্ধারণ করার জন্য। কিছু উপদেষ্টা মিসাইলগুলি ধ্বংস করার জন্য একটি বিমান হামলার পরামর্শ দেন। তারপর কিউবায় মার্কিন আক্রমণ। অন্যরা কিউবা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে কঠোর সতর্কবার্তা জানাতে বলে। প্রেসিডেন্ট একটি মধ্যম পথ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ২২শে অক্টোবর, তিনি কিউবার নৌবাহিনীকে “কোয়ারেন্টাইন” বা “সংগনিরোধ” করার আদেশ দেন। ‘অবরোধ’ না ব্যবহার করে ‘কোয়ারেন্টাইন’ ব্যবহার করার একটাই কারণ ছিল আমেরিকা মহাদেশের অন্যান্য দেশের সমর্থন পাওয়া।
সেই দিনই, কেনেডি ক্রুশ্চেভের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে ঘোষণা করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় আক্রমণাত্মক অস্ত্র সরবরাহের অনুমতি দেবে না। দাবি করেন নির্মাণাধীন ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলি ভেঙে ফেলার এবং সমস্ত আক্রমণাত্মক অস্ত্র সোভিয়েত ইউনিয়নে ফেরতে নেওয়ার। শুরু হয় হোয়াইট হাউস এবং ক্রেমলিন ঠাণ্ডা লড়াই।
রাষ্ট্রপতি সেই সন্ধ্যায় জাতীয় টেলিভিশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, ‘পশ্চিম গোলার্ধের যে কোনও জাতির বিরুদ্ধে কিউবা থেকে যে কোনও পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করা হলে তা সোভিয়েতের আক্রমণ হিসাবে বিবেচনা করা হবে।’
২৪ অক্টোবর, ক্রুশ্চেভ কেনেডির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া বলেন মাকি ‘অবরোধ’ একটি ‘আগ্রাসন’। কিউবার জন্য আবদ্ধ সোভিয়েত জাহাজগুলিকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে। তা সত্ত্বেও, ২৪ এবং ২৫ অক্টোবরের মধ্যে, কিছু জাহাজ কোয়ারেন্টাইন লাইন থেকে ফিরে গেছে। অন্য জাহাজগুলোকে মার্কিন নৌবাহিনীর থামিয়ে দেয়। সেসবে অবশ্য কোনো আক্রমণাত্মক অস্ত্র ছিল না, তাই তাদের এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ইতিমধ্যে, কিউবার উপর মার্কিন পুনরুদ্ধার ফ্লাইটগুলি ইঙ্গিত দেয় যে সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র সাইটগুলি কার্যক্ষম প্রস্তুতির কাছাকাছি ছিল৷ সঙ্কটের কোনো আপাত সমাপ্তি দেখতে না পাওয়া মার্কিন বাহিনীকে DEFCON 2 (অর্থাৎ স্ট্র্যাটেজিক এয়ার কমান্ডের সাথে জড়িত যুদ্ধ আসন্ন)-এ রাখা হয়েছিল। ২৬ অক্টোবর কেনেডি তার উপদেষ্টাদের বলেন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি কিউবায় আক্রমণ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে। এ ছাড়া সেখান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র সরানো যাবে না।
সেদিন বিকেলেই সংকট নাটকীয় মোড় নেয়। এবিসি নিউজের প্রতিবেদক জন স্কালি হোয়াইট হাউসে রিপোর্ট করেন একজন সোভিয়েত এজেন্ট তার সাথে যোগাযোগ করেছেন। তারা একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে চায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কিউবাতে আর আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেয় সোভিয়েতরা কিউবা থেকে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে ফেলবে। যখন হোয়াইট হাউসের কর্মীরা এই ‘ব্যাক চ্যানেল’ অফারটির বৈধতা মূল্যায়ন করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন, ঠিক তখন সন্ধ্যাবেলায় ক্রুশ্চেভ কেনেডিকে একটি বার্তা পাঠান। এটি একটি দীর্ঘ আবেগী চিঠি। পৃথিবীকে পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে ঠেলে না দিতে অনুরোধ জানিয়ে একটা সমঝোতার প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটি জন স্কালির দেওয়া প্রস্তাবের অনুরূপ।
পরের দিন, ক্রুশ্চেভ আরেকটি বার্তায় প্রস্তাবিত চুক্তিতে তুরস্ক থেকে মার্কিন জুপিটার ক্ষেপণাস্ত্র অপসারণের শর্ত জুড়িয়ে দেন। সেই দিনই কিউবার উপর দিয়ে যাওয়া একটি মার্কিন U-2 রিকনেসান্স জেট গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। সেই রাতে, কেনেডি সোভিয়েত নেতার কাছে তার বার্তায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কিউবা থেকে সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র অপসারণের পদক্ষেপের প্রস্তাব দেন এবং নিশ্চিত করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় আক্রমণ করবে না।
সোভিয়েতরা কিউবা থেকে তাদের IL-28 বোমারু বিমান সরিয়ে নিলে ২০ নভেম্বর, ১৯৬২-তে যুক্তরাষ্ট্র তার নৌ কোয়ারেন্টাইন শেষ করে। ইউএস জুপিটার মিসাইল ১৯৬৩ সালের এপ্রিলে তুরস্ক থেকে সরানো হয়। এভাবে সম্ভাব্য একটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেঁচে যায় বিশ্ব।
সারাবাংলা/এজেডএস