অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, ক্র্যাক প্লাটুনের বীরেরা
৩০ আগস্ট ২০২২ ১৮:০১
একাত্তরে পুরো সময়টা জুড়ে যেমন রয়েছে বেদনাবিধুর যন্ত্রণার উপাখ্যান, তেমনি আছে দুঃসাহসিক বীরত্বগাঁথা। ঢাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য রাজধানী শহর এবং কৌশলগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এখানে পাকিস্তানি সেনারা ছিল খুবই তৎপর, তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল নিশ্ছিদ্র। কিন্তু সেই গিজগিজে পাকিস্তানি সেনায় ভরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্পটেই ‘হিট এন্ড রান’ কৌশলে উপুর্যপরি হামলা চালিয়েছিল আরবান গেরিলাদের দল। কি অচিন্তনীয় সাহস তারা দেখিয়েছিল, ঝুঁকি তারা নিয়েছিলেন, তা আজও অনেকের ভাবনার অতীত।
দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফের নির্দেশে গেরিলা ওয়ারফেয়ারের কিংবদন্তী মেজর এটিএম হায়দার ১৭ জন তরুণকে গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। তার নির্দেশনা ছিলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিদেশী সাংবাদিক ও অতিথিরা থাকাকালীন ঢাকা শহরের পরিস্থিতি যে শান্ত নয় এবং এখানে যুদ্ধ চলছে তা বোঝানোর জন্য শহরের আশে-পাশে কিছু গ্রেনেড ও গুলি ছুড়তে হবে। কিন্তু দুঃসাহসী এই তরুণেরা ঢাকায় এসে ৯ জুন তারিখে সরাসরি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড হামলা করে। সন্ধ্যায় বিবিসির খবর থেকে খালেদ মোশাররফ এই অপারেশনের কথা জানতে পেরে বলেন, ‘দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল! বললাম, ঢাকার বাইরে বিস্ফোরণ ঘটাতে আর ওরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এসেছে।’ তিনিই প্রথম এই দলটিকে ‘ক্র্যাক’ আখ্যা দেন; যা থেকে পরবর্তীতে মুক্তিসেনাদের এই প্লাটুনটি ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ নামে পরিচিত হয়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে একাত্তরের জুন থেকে আগস্ট এই তিন মাস রীতিমত দিশেহারা করে তোলে এই ব্রেইভহার্টের দল। বাধ্য হয়েই কাপুরুষ পাকিস্তানিরা বেছে নেয় ষড়যন্ত্র আর কূটকৌশল, কাজে লাগায় তাদের পালিত নরপিশাচ জল্লাদ আলবদর ও রাজাকারদের, আগস্টের ২৯ থেকে ৩১ এই তিনদিন ধরে একের পর এক গেরিলাদের ‘হাইড আউট’ প্রকাশ হয়ে যায় ও ‘কিংস পিনেরা’ ধরা পড়ে। যে আরবান গেরিলারা ধরা পড়েন, তাদের ৭ জনকে আর কখনই খুঁজে পাওয়া যায়নি। জানা যায় অবর্ণনীয় অত্যাচার শেষে নির্মমভাবে তাদের হত্যা করেছে আলবদর ও পাকিস্তানি সেনারা। জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং সেক্রেটারি জেনারেল আলবদর বাহিনীর অন্যতম প্রধান সংগঠক আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধসমূহের মধ্যে পঞ্চম অপরাধ ছিল আরবান গেরিলাদের এই সদস্যের হত্যায় সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন।
যুদ্ধ চলাকালে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহিরউদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে আটক করে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে রাখা হয়। ৩০ আগস্ট রাত ৮টার দিকে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি মুজাহিদ ও সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সেখানে গিয়ে এক সেনা কর্মকর্তাকে পরামর্শ দেন, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। এ সিদ্ধান্তের পর সহযোগীদের নিয়ে মুজাহিদ আর্মি ক্যাম্পে আটকদের অমানুষিক নির্যাতনের পর জালাল ছাড়া বাকিদের হত্যা করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন ১৯৭৩ এর ৪(১) এবং ৪(২) ধারায় যা মানবতাবিরোধী অপরাধ। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের দুজনকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়।
সেদিন থেকে নিখোঁজ ৭ বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা জানাব আজ। যারা ছিলেন আমাদের স্বাধীনতার অগ্রসারথী, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী।
মোহাম্মদ আবু বকর
৯ই জুলাই, ১৯৭১ ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টালে ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্র্ষ গেরিলারা প্রথম অপারেশন চালিয়েছিল। বিখ্যাত সে অপারেশনের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ১১ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় হোটেল ইন্টারকনে চালানো একটি মারাত্মক বিস্ফোরণের গল্প। যার নেপথ্যে মূল নায়ক ছিলো ১৮ বছর বয়সী একটি ছেলে, ক্র্যাকপ্লাটুনের সর্বকনিষ্ঠ গেরিলা, মোহাম্মদ আবু বকর। ঢাকা ইন্টারকনে তার সেই দুঃসাহসিক এ্যাকশনের খবর বিশ্ব গণমাধ্যমে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্থানি মিলিটারিদের। তথাকথিত পৃথিবীর সেরা আর্মির দাবিদার পাকিস্তারিদের দাম্ভিকতা পায়ের তলে পিষে সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থানে হামলা চালিয়ে স্বগৌরবে বের হয়ে এসেছিল বকর।
কেবল অপারেশনই নয়, পূর্ব পাকিস্তানের আইএসআইয়ের বাঙ্গালী প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন ইসলামকে শত্রুর চোখ ফাকি দিয়ে পরিবারসহ পৌঁছে দিয়েছিল ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ে। পাক ইন্টিলিজেন্সের এই গুরুত্বপুর্ন কর্মকর্তাকে সঙ্গত কারনেই কঠোর নজরদারীতে রাখতো পাঞ্জাবিরা, আর তাকেই ‘মাসুদ রানা’ স্টাইলে রেসকিউ করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে এসেছিল দুই অকুতোভয় ‘ক্র্যাক’ ফতেহ আলী চৌধুরী ও আবু বকর। এ রকম আরো অনেকগুলো অপারেশনে পাকিস্তানিদের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়ে বকর, বিশেষ করে ১১ই আগস্টের অপারেশনের পর পাক মিলিটারি পাগলা কুকুর হয়ে গিয়েছিল। সবশেষে এই দুঃসাহসী যুবককে ৩০ আগস্ট ভোরে গুলশান-২ এর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মিরা। নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এম.পি হোস্টেলের বদ্ধ কামরায় অন্য সহযোদ্ধাদের সাথে অমানুষিক নির্যাতন চলে এই গেরিলার উপর, সেদিনের পর বকরকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বকর আর আর ফিরে আসেনি, মিশে গেছে ৩০ লাখের রক্তের স্রোতে।
সৈয়দ হাফিজুর রহমান
সৈয়দ হাফিজুর রহমান বেহালা বাজাতেন, আলতাফ মাহমুদের সাথে তার পরিচয়টাও সেইসূত্রেই। ষাটের দশকের শুরুতে খুলনায় ‘ললিতকলা’ নামে একটা গানের স্কুল খুলেছিলেন হাফিজ। সেটি খুব একটা না জমায় জীবিকার তাগিদে গেলেন করাচী। সেখানে বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্যের সাথে কাজ করতে করতেই পরিচয় ঘটে দেবুর এক গুনী শিষ্যের সাথে, পূর্ব বাংলায় যার পরিচিতি জনে জনে জানে, সুরকার আলতাফ মাহমুদ। যার বিষাদমাখা সুরারোপে আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা একুশের গানটি অমরত্ব লাভ করেছে বাঙ্গালী মানসপটে। ঈশ্বর ওদের জন্মতিথি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে লিখলেও, সেদিনের সেই পরিচয়ক্ষণে নির্ধারিত করে দিয়েছিল ওদের অভিন্ন অন্তিমতিথি।
হাফিজকে আলতাফ মাহমুদের ছায়াসঙ্গী বলা হতো। একাত্তরের যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য নতুন গান প্রয়োজন। নতুন গান করার বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি একদিন হাফিজকে সাথে নিয়ে চলেন গেলেন গণসংগীত শিল্পী আব্দুল লতিফের বাসায়, তিন গানের জগতের মানুষ সুর-স্বর-স্বরলিপি সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধকে চাঙ্গা রাখতে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বৈঠক করলেন। কেবল সেখানেই নয়, বৈঠক চলতো ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের বাসাতেও, আব্দুল লতিফ সাহেব ও আলতাফ মাহমুদ দুজন মিলে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিতেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্যে গান লিখবার তাড়নায় ক্লান্তির কথা তাদের মাথায়ই আসতো না। বেহালার সাথে সাথে প্রয়োজনে গেরিলা অপারেশনেও সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন এই সাহসী যোদ্ধা। ৩০ অগাস্ট পাক সেনাদের হাতে তারা দুইজন একসাথে ধরা পড়েন। অস্ত্র আর মুক্তিবাহিনীর খোঁজ পেতে পাকিস্তানিরা এমনই অত্যাচার চালিয়েছিল যে হাফিজের চোখ কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তবুও তথ্য তো দূরে থাক, মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের বিষয়ে একটা টুঁ শব্দও করেননি এই অমিত সাহসী বীর! টর্চার সেলেই ৩১ আগস্ট রাতে মৃত্যুবরন করেন তিনি।
আলতাফ মাহমুদ
পাকিস্তান রাষ্ট্র হবার পর প্রথম আঘাতটা এসেছিল আমাদের ভাষার ওপর। ছোট্টবেলায় মায়ের মুখে শুনতে শুনতে যে মিষ্টিমধুর ভাষায় কথা বলতে শিখেছি আমরা, মাথামোটা পাকিস্তানিগুলো সেই বাংলা ভাষাকেই স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল, চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল উর্দু। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত অকাতরে রাজপথে ঢেলে রক্ষা করেছিল মায়ের ভাষার অধিকার, জন্মেছিল সেই বিখ্যাত চরণ, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ পরম যত্নে গভীর বিষাদমাখা সুরের বাঁধনে বেঁধেছিলেন যিনি কথাগুলোকে, সৃষ্টি হয়েছিল এক অমর সঙ্গীতের। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটায় খুব ভোরে উঠে প্রভাতফেরির সাথে হাঁটতে হাঁটতে শহীদমিনার যেতেন, ঠোঁটের হারমোনিকায় বাজতো সেই কালজয়ী সুর… তিনিই ছিলেন আলতাফ মাহমুদ।
মগবাজারে ৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের বাসায় থাকতেন আলতাফ মাহমুদ। দুই নম্বর সেক্টর গঠিত হলে তার বাসাটা পরিণত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম তীর্থে, অগণিত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া, তাদের থাকা-খাওয়া, তাদের মেলাঘরের ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া, আলতাফ মাহমুদ সবই করতেন। খালেদ মোশাররফের নির্দেশে শাহাদাৎ চৌধুরী প্রায়ই আসতেন তার কাছে, স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের গান রেকর্ড করে তার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন আলতাফ। একদিন ক্র্যাক প্লাটুনের কয়েকজন এসে বললেন, ঢাকায় প্রচুর পরিমানে আর্মস আনতে হবে, রাখার জায়গা নাই। তার বাসায় রাখতে হবে। আলতাফ বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না, তার বাসা পরিনত হল এক অস্ত্র-গোলাবারুদের বিশাল এক দুর্গে। এভাবে ঢাকা শহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আতংক হয়ে ওঠা ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম প্যাট্রোনাইজার হয়ে উঠলেন তিনি, জানতেন মাথার উপর মৃত্যু ঝুলছে! কিন্তু তিনি ভয় পাননি, ভয় শব্দটা তার অভিধানে ছিল না।
৩০শে আগস্ট ভোরে যখন পাকিস্তানি সেনারা বাড়িতে ঢুকে গেল, চিৎকার করে বলতে লাগল, মিউজিক ডিরেক্টর কৌন হ্যায়, তখনো তিনি ভয় পাননি। নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে শির উঁচু করে বেরিয়ে এলেন বীর, ভোরের পবিত্র আলোয় তাকে যেন অপার্থিব লাগছিল, বুকটা টান টান করে জবাব দিলেন, আমিই আলতাফ মাহমুদ, কি চাও তোমরা?
— হাতিয়ার কিধার হ্যায়?
আলতাফ বুঝে গেলেন, ওরা সব জেনেই এসেছে। তার মাথায় একটাই ভাবনা ঘুরতে লাগলো, যেভাবেই হোক ক্র্যাক প্লাটুনের যোদ্ধারা (যারা তার বাসায় তখন ছিল), তার পরিবার-পরিজন সবাইকে বাঁচাতে হবে। বললেন, এসো আমার সাথে। পাকিগুলো তার হাতে কোদাল তুলে দিল, মাটি খুঁড়তে বললো। একটু দেরি হয়েছিল হয়তো, একজন রাইফেলের বাট দিয়ে সাথে সাথে মুখে মারলো, আরেকজন বেয়োনেট চার্জ করলো। একটা দাঁত ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল, কপালের চামড়া ফালাফালা হয়ে কেটে ঝুলতে লাগলো চোখের উপর। সবাইকেই মারতে মারতে গাড়িতে তুলেছিল, ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে চালিয়েছিল অকথ্য নির্যাতন। পৈশাচিকতার সব সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল ওরা, কিন্তু ক্র্যাক প্লাটুনের অন্য সবার মত আলতাফ মাহমুদের মুখ থেকেও একটা শব্দ বের করতে পারেনি। আলতাফ মাহমুদ আর ফিরে আসেননি, উন্নত মম শিরের সেই অসামান্য বীরের আর কখনো দেখা হয়নি তার ছোট্ট শাওনের মুখটা!
বদিউল আলম
ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করা অসম্ভব মেধাবী ছাত্র বদিউল আলম একাত্তরে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। তবে সে পরিচয় ছাপিয়ে গিয়েছিল কুখ্যাত এনএসএফের গ্যাংস্টার হিসেবে তার দৌর্দন্ড প্রতাপে। ৬৯’এর গনঅভ্যুত্থান পাল্টে দিল সব, আরও অসংখ্য তরুন-যুবার মতো স্বাধীন বাংলাদেশের সযত্ন লালিত স্বপ্ন পাখা মেলতে থাকে বদির ভেতর। একাত্তরের ২৫শে মার্চের বিভীষিকার পর নিরীহ বাঙ্গালীর তাজা রক্তস্রোত পেরিয়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদানের নিয়োগপত্র হাতে এসেছিল ছেলেটার, ঘৃণাভরে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছিল, বুকে ভেতর বাজছে দামামা, যুদ্ধে যেতে হবে, ছিঁড়েখুঁড়ে আলাদা করে ফেলতে হবে পাকিস্তানি শুয়োরগুলোকে, চোখ দুটো তার জ্বলছিল, ভাটার গনগনে আগুনের মত। বাবা আবদুল বারী সাহেব টের পেয়েছিলেন সেটা, ছেলের মত নির্বিকারচিত্তে পাথরগলায় মা রওশন আরাকে বললেন, ‘তোমার তো ছয় ছেলে, একজনকে না হয় দেশের জন্য দিয়েই দিলে। ’…
ক্র্যাকডাউনের পর প্রথম যে চারজনের দলটা যুদ্ধ করতে ঢাকা ছাড়ে, তার মধ্যে বদি ছিল অন্যতম। মেলাঘরে মেজর ক্যাপ্টেন হায়দারের হাতে ট্রেইন্ড সবচেয়ে চৌকষ গেরিলাদের একজন বদি সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঢাকায় পাকিস্তানিদের নাভিশ্বাস তুলে ফেলে, অংশ নেয় ঢাকা শহর ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি দুর্ধর্র্ষ অপারেশনে। অপারেশনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো- ৮ আগস্ট ফার্মগেটে পাকবাহিনীর চেকপোস্ট অপারেশন, ১৪ আগস্ট গ্যাস বেলুনের মাধ্যমে ঢাকা শহরের আকাশে বাংলাদেশের অনেকগুলো পতাকা উড়ানো, ১৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে অপারেশন, ২৫ আগস্ট ধানমন্ডির ১৮ ও ২০ নম্বর রোডে অপারেশন। এসব অভিযান এখনও গল্পের মতো লোকের মুখে মুখে ফেরে। ২৫শে আগস্ট অপারেশন ‘ডেস্টিনেশন আননোন’ এর ধ্বংসযজ্ঞ এতটাই বেশি ছিল যে নপুংশক পাকিস্তানিরা পাগলা কুকুরের মতো আলবদর রাজাকারদের লেলিয়ে দেয় ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের খুঁজে বের করার জন্য। ২৯ আগস্ট ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপালের বাসা থেকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বদি ধরা পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং নেবার রুট আর অস্ত্রের চালানের রুটটা জানার জন্য ছেলেটার হাড়গুলো সব একটা একটা করে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, প্লায়ারর্স দিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল সবগুলো নখ, একটা শব্দও উচ্চারন করেনি ছেলেটা।
শেষ পর্যন্ত যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সুইচবোর্ডের সকেটের ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে শক খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল সে, পারেনি। এক পাকিস্তানি হাবিলদার পেটাতে পেটাতে তাকে সরিয়ে এনেছিল, ঝরঝর করে রক্ত ঝরতে থাকা মুখটা তুলে বলেছিল, পাশের সেলে ওর বন্ধুরা তথ্য দিচ্ছে, ওরা মুক্তি পেয়ে যাবে, সেও যদি তথ্যগুলো দেয়, তবে ছেড়ে দেওয়া হবে তাকে। ভাটার মত জ্বলছিল চোখদুটো, কণ্ঠে অসম্ভব গাম্ভীর্য এনে প্রায় আধমরা ছেলেটা পাথরকঠিন গলায় বললো, ‘আমি কিছুই বলব না, যা ইচ্ছা করতে পারো। ইউ ক্যান গো টু হেল…’
৩১শে আগস্টের পর বদির আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বদি আর কখনোই ফিরে আসেনি…
আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল
দুর্ধর্ষ মারকুটে ব্যাটসম্যান ছিল ছেলেটা, ব্যাট হাতে মাঠে নামার পর বোলারদের নাকের জল, চোখের জল এক হয়ে যেতো। আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে ওপেনিংয়ে নামত, ৪৫ ওভারের ম্যাচ। টর্নেডো বইয়ে দিত একেবারে, ধুমধাড়াক্কা মারের চোটে বিপক্ষ দল চোখে অন্ধকার দেখত, বলের লাইন-লেন্থ কোথায় উড়ে যেতো! স্লগ সুইপটা অসাধারন খেলত, বল জিনিসটা যে পেটানোর জন্য, এইটার সবচেয়ে বড় উদাহরন ছিল ওর ব্যাটিং। করাচির লিগের এক ম্যাচে একদিন ওর তুমুল মার দেখতে দেখতে এক পাঞ্জাবি কোচ সবিস্ময়ে বলে উঠলো, এই ছেলে এইখানে কেন? ওর তো ন্যাশনাল টিমের হয়ে ওপেনিং করার কথা!
কথাটা খুব সত্য ছিল, কিন্তু অবাস্তব সত্য। ছেলেটা বাঙ্গালী, আর পাকিস্তান নামক পোকায় কাটা রাষ্ট্রটায় বাঙ্গালীর অবস্থান ছিল কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট, গোলামেরও চেয়েও অধম। ছেলেটার স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া, ছেলেটা ন্যাশনাল টিমের হয়ে ওপেনিং করার স্বপ্ন দেখত। স্বাধীন বাংলাদেশ দলের ওপেনিং করবার স্বপ্ন…।
১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ জেলা ক্রীড়া ভবনের সামনে সদাহাস্যজ্জ্বোল মুশতাক ভাইয়ের দু’হাত উপরে তোলা মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখার পর ছেলেটার স্বপ্নটা একটা ধাক্কা খেলো। দেখলো আজাদ বয়েজ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা মুশতাক আহমেদের নিষ্প্রাণ ঝাঁজরা দেহটা পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। হাতদুটো উপরে তোলা। অজাতশত্রু মুশতাক ভাইয়ের কোনও ঘোরতর সমালোচকও এই অপবাদ দিতে পারবে না, তিনি কাউকে কোনোদিন একটা গালি দিয়েছেন। ক্রিকেট ছিল তার ধ্যান, একমাত্র সাধনা। বিনা অপরাধে এইভাবে মরতে হবে, মৃত্যুর আগমুহূর্তেও হয়তো এটা তার কল্পনাতে ছিল না। মুশতাক ভাইয়ের সেই দৃষ্টি ছেলেটার মাথায় গেঁথে গেল, ব্যাট ফেলে তুলে নিল স্টেনগান, পাকি শুয়োরগুলারে মারতে হবে, দেশটারে স্বাধীন করতে হবে…!
প্রথমে বাঁধা হয়ে এসেছিল স্নেহময়ী মা। ছোটবেলা থেকে যক্ষের ধনের মত আগলে রাখা মায়ের চোখকে ফাকি দিয়ে মে মাসের ৩১ তারিখ বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় ছেলেটা। প্রতিপক্ষের বোলারদের এতটুকু চড়াও হতে না দেওয়ার মানসিকতা যার, অ্যাটাক ইজ দা বেস্ট ডিফেন্স ছিল যার মুলমন্ত্র, সে কিভাবে দেশের এই দুঃসময়ে নিজেকে ঘরে আটকে রাখবে? তাই দেশমাতা সম্ভ্রম রক্ষায় বেরিয়ে গিয়েছিল ও, যাবার কদিন আগে মাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিল, ‘আমি যখন থাকবো না, এই ছবিটাতে তুমি আমাকে দেখতে পাবে। ’
দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফের নির্দেশে গেরিলা ওয়ারফেয়ারের কিংবদন্তী মেজর এটিএম হায়দার ১৭ জন তরুনকে গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে ঢাকায় অপারেশনে পাঠান। এরাই পরবর্তীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অকল্পনীয় ত্রাস ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ এ পরিণত হয়। ছেলেটা এই ১৭ জনেরই একজন ছিল। সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনের রেকি করতে গিয়ে রামপুরা বিলে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিবর্ষণে ডানহাতের তিনটা আঙ্গুল ভেঙ্গে গর্ত হয়ে গিয়েছিল ছেলেটার। হাতটাকে পচনের হাত থেকে বাঁচাতে আঙ্গুলগুলা কেটে ফেলতে হবে, হঠাৎ ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে আর্তি জানাল ছেলেটা, ‘দেশ স্বাধীন হইলে আমি ন্যাশনাল টিমের হইয়া ওপেনিংয়ে নামুম, ক্যাপ্টেন হমু। আঙ্গুল তিনটা রাইখেন স্যার, প্লিজ…!’
২৯’শে আগস্ট ছেলেটা মগবাজারে আজাদের বাসা আহতাবস্থায় আজাদ, বাদলসহ আরও কয়েকজনের সাথে ধরা পড়ে। ধরা পড়ার সময় ব্যান্ডেজে মোড়া ভাঙ্গা আঙ্গুল তিনটা খাবলে ধরে যখন মোচড় দিচ্ছিল পাকিস্তানি আর্মির ক্যাপ্টেন, তখনও স্বপ্নটা ছেলেটাকে ঘিরে ছিল। টর্চার সেলে আঙ্গুলগুলোর উপর হাতুড়ির বাড়ি পড়তো প্রতিদিন নিয়ম করে, প্লায়ার্স দিয়ে মুচড়ে ধরে জিজ্ঞেস করতো, ‘মুক্তিকা রুট কিধার হ্যায়, হাতিয়ার কাহা সে আ রাহা?’ অচিন্তনীয় যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকা ছেলেটাকে তখনও ওপেনিংয়ে নামার স্বপ্নটা ছেড়ে যায়নি। স্বপ্ন বোধহয় বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিল ছেলেটাকে…।
ক্রিকেটমাঠে জীবনের শেষ ইনিংসে ছেলেটা অপরাজিত ছিল, অপরাজিত ছিল তিনটা আঙ্গুল ভেঙ্গে যাওয়ার পরেও। ভাঙ্গা আঙ্গুল তিনটা বুটের নিচে পিষে ফেলার সময় অমানুষিক যন্ত্রণা হচ্ছিল, কিন্তু ছেলেটা হেরে যায়নি। ‘কাহা সে ট্রেনিং লেকে আতা তুম লোগনে? কিধার সে আর্মস আতা?’ প্রশ্নগুলো সহস্রবার করেছে পাকি হায়েনারা, উত্তর না পেয়ে আঙ্গুলের পর বেয়নেট দিয়ে একটু একটু করে ফালা ফালা করেছে ছেলেটার শরীরটা, ছেলেটা হেরে যায়নি। চিৎকার করেছে, যন্ত্রণায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, মা মা বলে ডেকেছে আকুতিভরে, তবুও একটা কথাও বলেনি সে। তার সহযোদ্ধাদের পরিচয়, অস্ত্রের চালান কিংবা ট্রেনিংয়ের রুট, কিছুই বলেনি। নিশ্চিত মৃত্যুর সামনেও অপরাজিত ছিল ছেলেটা, মাথা উঁচু করে, বুক ফুলিয়ে! হেরে যাওয়াটা যে তার অভিধানে ছিল না…।
ছেলেটা খুন করেছে হায়েনারা। স্বাধীন বাংলাদেশ দলের হয়ে ওপেনিং করার স্বপ্ন দেখা ছেলেটা আর কখনোই ফিরে আসেনি। ছেলেটার নাম ছিল জুয়েল, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল! নতুন প্রজন্মের একাংশের কাছে ‘উনিশশো কটকটি সালের ইতিহাস’ হয়ে যাওয়া যার ক্ষতবিক্ষত লাশের উপর তবুও দাড়িয়ে আছে একটা স্বাধীন দেশ, যার বুকের টকটকে রক্তস্রোত জমাট বেঁধে আছে একটা দেশের পতাকায়, সবুজ জমিনের ঠিক মাঝখানে। গর্বে; অসম্ভব গর্বে…!
শাফী ইমাম রুমী
‘আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকা পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাবো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে বিবেক চিরকালের মত অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইন্জিনিয়ার হবো, কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে কোনদিন ও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?’
“জননী জাহানারা ইমাম তার দুই চোখ জোরে বন্ধ করে বললেন, ‘না, তা চাই নে। ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধেই যা।’” জীবনের শেষমুহুর্ত পর্যন্ত আম্মা আফসোস করতেন, কেন তিনি কোরবানি শব্দটা ঊচ্চারন করেছিলেন সেদিন! হয়তো সে কারনেই আর তার আদরের ধন ফিরে এলো না। মায়ের মন, আহারে!
উপরের সংলাপগুলো কাল্পনিক নয়, কোন সংলাপ বুদবুদে ভাসা আবেগের আতিশয্য নয়, গল্প নয়, গল্পের মত সত্য, কোন এক অলৌকিক উপায়ে হয়ে যাওয়া আমাদের সবার গল্প।
ভাষা আন্দোলনের আগের বছরের ২৯ মার্চ ছেলেটির জন্ম। রুমী খুব সহজে পৃথিবীতে আসেনি। দীর্ঘ ১৪ ঘন্টা গর্ভধারিনী মা’কে কষ্ট দিয়ে নিজেও কষ্ট পেয়ে এক বৃহস্পতিবারের দুপুর সাড়ে বারোটায় পৃথিবীর আলো দেখেছিল। সে সময়ের উচ্চবিত্ত পরিবারের একজন বাঙালি সন্তানের মতোই ছিল সে। গড়নে সব সময় পাতলা; পোশাক, পরিচ্ছদে পরিপাটি, চেহারার আভিজাত্যবোধ কিন্তু নীতিনিষ্ঠ রুমী জীবনে সব ভালোকিছুর প্রতি আগ্রহী ছিল। ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড়ের পরেই রুমীর বাহ্যিক পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে রুমী ছুটে গিয়েছিল দেশের দিক থেকে দিগন্তে।
তারপর দেশে একাত্তর, এলো মার্চের সংগ্রাম। পহেলা মার্চ যখন ইয়াহিয়া অধিবেশন বানচাল করার ঘোষণা দিলেন, রেডিওতে সেই রুমীই ঢাকা স্টেডিয়ামে চলতে থাকা ক্রিকেট ম্যাচ বাদ দিয়ে চলে এসেছিল বটতলায়, পরবর্তী করনীয় কি হবে জানতে। আবার মুহুর্তেই বন্ধুর মোটরবাইকের পেছনে চড়ে গায়েব হয়ে গিয়েছিল আন্দোলনের ঢাকার খবর জানতে। খেতে ভালবাসতো যে ছেলেটি, সেদিন মায়ের হ্যামবার্গারের কথাও ভুলে গিয়েছিল সে দেশের জন্য। ৭মার্চের ভাষন শুনে বাড়ি ফিরে মাকে চোখ বড় বড় করে সে গল্প শুনিয়েছিল সে। তবে হতাশ গলায়। আশাহত রুমী যুদ্ধ চাইছিল।
‘আম্মা বুঝতে পারছ না, মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এটা ওদের সময় নেবার অযুহাত মাত্র। ওরা আমাদের স্বাধীনতা দিবে না। স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হবে সশস্ত্র সংগ্রাম করে।’ -কথাটা রুমী বলেছিলেন যুদ্ধ শুরু হবার আগে। চে গুভেরার ভক্ত আর মাও সে তুং নখদর্পনে নিয়ে ফেলা রুমী ঠিকই বুঝতে পেরেছিল কি হতে যাচ্ছে আর আমাদের কি করতে হবে।
বেঁচে থাকতে শেষ জন্মদিনটা ভালো কাটেনি রুমীর। যে পিতা নেপথ্যে থেকে পুত্রকে স্বাধীকার আন্দোলনের শরিক করলেন এবার তিনি বেড়িয়ে এলেন প্রকাশ্যে। স্ত্রীকে সাথে নিয়ে পুত্রের ২০তম জন্মদিনে তাকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন দেশের জন্য। জন্মদিনে রুমীকে তার বাবা শরীফ ইমাম ও মা জাহানারা ইমাম একটি চিঠি লিখেন,
“‘চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছি বিষাক্ত নিঃশ্বাস, শান্তির ললিতকনা শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস’। এই অশুভ সময়ে তোমার শুভ জন্মদিনে তাই চিরাচারিতভাবে বলবো না বড় হও, সফল হও, সুপ্রতিষ্ঠিত হও। তা উচ্চারণ করতে পারবো না। তার বদলে মাল্যধ্বণি উচ্চারণ করছি, ব্রজের মত হও, দীপ্ত শক্তিতে জেগে উঠো, দেশের অপমান দূর কর। দেশবাসীকে তার যোগ্য সম্মানের আসনে বসাবার দুরহ ব্রতে জীবন উৎসর্গ কর।
– ইতি তোমার আব্বু ও আম্মু”
১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল মাকে রাজি করিয়ে ২মে রুমী সীমান্ত অতিক্রমের প্রথম প্রয়াস চালান। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তাকে ফেরত আসতে হয় তবে দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় সফল হন। পড়েছিলেন কে ফোর্সের খালেদ মোশাররফের হাতে। খালেদ মোশাররফ ক্যাপ্টেন হায়দারের হাতে তুলে দেন রুমীদের। একজন রুমীর ‘বীর রুমী’ হয়ে ওঠার পেছনে ক্যাপ্টেন হায়দারের অবদান বোধহয় সবচেয়ে বেশী। ট্রেনিং শেষে রুমীর অবদান নতুন করে বলা হয়তো লাগে না, কারণ তারপরের তার জীবনের প্রতিটি পরিচ্ছেদ বাংলাদেশের সোনালী ইতিহাসের পাতায় পাতায় মহাকাব্যের অংশ হয়ে আছে।
মেলাঘর থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসার পর জুয়েল, বদি, আলম, মায়া, কাজী কামালদের সাথে রুমিও ঢাকায় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অপারেশনে যোগ দেয়। এর মধ্যে আগস্টের ২৫ তারিখে ধানমন্ডির বিভিন্ন রোডে মোবাইল টার্গেটে অপারেশন ‘ডেস্টিনেশন আননোনে’ রুমির অভাবিত বীরত্বগাঁথা তোলপাড় তোলে শহরজুড়ে। অপারেশন সেরে ফিরে আসার সময় স্রেফ রুমির প্রত্যুৎপন্নমতিতা এবং চোখের পলকে ফায়ারিংয়ে সেদিন উল্টে যায় পিছু ধাওয়া করে আসা পাকিস্তানি সেনাদের একটা জীপ। পাকিস্তানিরা সম্মুখীন হয় অচিন্তনীয় ক্ষতির। মার কাছে সে গল্প করতে গিয়ে রুমি বলেছিল,
‘আম্মা দেখো আমার ঘাড়ে, কাঁধে স্টেনগান থেকে আগুনের ফুলকি ছুটে কি রকম ফোসকা পড়ে গেছে। রাস্তায় মিলিটারী ধরলে এইটার জন্যই ফেঁসে যাব।’
কে-ই-বা জানত দু’দিনের মাথায় রুমির মুখের কথাটাই সত্য হয়ে যাবে। ২৯শে আগস্ট রাতে পাকিস্তানি সেনাদের সাঁড়াশি অভিযানে ধানমন্ডির কনিকা থেকে ধরা পড়ে রুমী। সাথে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বাবা শরীফ ইমাম, ভাই জামী, খালাতো ভাই মাসুমসহ কয়েকজনকে। ক্র্যাক প্লাটুনের বাকি সহযোদ্ধাদের সাথে অকথ্য নির্যাতন চলে তাদের উপর। উনিশ বছর বয়সী রুমি বাবা আর ভাইসহ সবাইকে বলে দিয়েছিল, কেউ যেন কোন কথা না বলে।
নিজের ঘাড়ে সকল দায় নিয়ে বাকি সবাইকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল ও। অকথ্য অবর্ননীয় নির্যাতনের মুখেও একটা তথ্যও দেয়নি, ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল, “You people are going to die. You can’t flee, you can’t leave-Nobody can save you. I can’t tell you this much.”
রুমীকে ছাড়িয়ে আনার জন্য অনেকেই রুমীর বাবাকে ইয়াহিয়ার নিঃশর্ত ক্ষমার সুযোগ নিতে বলেছিলেন। কিন্তু রুমীর ধমনীতে যে তার বাবার রক্ত। ছেলেকে আর কখনো ফিরে না পাবার নির্মম বাস্তবতা বুকে চেপে বাবা শরীফ ইমামও পাক হানাদার সরকারের কাছে মাথা নিচু করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। প্রাণভিক্ষা চাননি, চাননি এতটুকু করুণা।
এ এমন পিতার গল্প, যিনি শত অপমান বেত্রাঘাতেও টলেননি এতটুকু। এ এমন জননীর গল্প, যিনি কাহলিল জিবরানের ‘প্রফেট’ থেকে লাইন আউড়ে মনকে শক্ত করেছেন। পুরো পরিবার যেন ‘নীলকণ্ঠ’! পুরাণে এক দেবতা বিষ নিজের গলায় ধারণ করে বাঁচিয়েছিল বিশ্ব, নিজে হয়েছিল নীলকণ্ঠ। এই পরিবার, এই গল্প, এই পিতা-পুত্র-জননীরাও যেন তাই। আমাদের দুর্ভাগ্য দখলদার হানাদার হায়নাদের নষ্ট বীজ আজও বিষবৃক্ষ ছড়িয়ে আছে শ্যামল বাঙলায়; যার জন্য আমাদের জননীকে পেতে হয় রাষ্ট্রদ্রোহীর অভিধা। এরচেয়ে বড় জঘণ্য অনাচার আর কি হতে পারে!
ধরা পড়ার আগের কোলে মাথা রাখা রুমিকে মা বলেছিল, কত বয়স তোর। পৃথিবীর কিছুই তো দেখলি না, জীবনে কিছুই তো জানলি না। রুমী মুখ তুলে কেমন যেন এক রকম হাসি হাসল, মনে হল অনেক বেদনা সে হাসিতে। একটু চুপ থেকে বললো,
‘বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন একটা কথা আছে না আম্মা। হয়তো জীবনের পুরোটা তোমাদের মত জানি না, ভোগও করিনি কিন্তু জীবনের যত রস-মাধুর্য-তিক্ততা সব কিছুর স্বাদ আমি এরমধ্যেই পেয়েছি আম্মা। যদি চলেও যাই কোনও আক্ষেপ নিয়ে যাবো না।’
রুমি আর ফিরে আসেনি। কখনো না।
মাগফার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আজাদ
“চাচি, আল্লাহর কাছে শোকর করেন। আমি আছি বইলাই আজাদরে ছাইড়া দেওয়ার একটা সুযোগ আইছে। উনারে ক্যাপ্টেন সাব পাঠাইছে। কি কয় মন দিয়া শুনেন।’
সাদা শার্ট-কালো প্যান্ট পরা আর্মিছাটের কাটা চুলের মানুষটা সাফিয়া বেগমের দিকে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তার গলার স্বরটা ততোধিক ঠাণ্ডা শোনায়,
–আজাদের সাথে দেখা করতে চান?
–জি।
–ছেলেকে ছাড়ায়ে আনতে চান?
–জি!
–আজকে রাতে আজাদকে রমনা থানায় নিয়ে আসবে। দেখা করায়া দিব ওর সাথে। বুঝলেন?
–জি।
–তার সাথে দেখা করবেন। দেখা করে বলবেন, সে যেন সবার নাম বলে দেয়। অস্ত্র কোথায় রেখেছে, তা বলে দেয়।
–জি?
–সে যদি সব বলে দেয়, তাকে রাজসাক্ষী বানানো হবে। ছেলেরে যদি ফিরে পাইতে চান, তারে সব বলতে বলবেন।
আজাদের মা লোকটার পাথুরে মুখের দিকে তাকান। তার চোখে নিঃস্পন্দ শুন্য দৃষ্টি। গরাদের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা আজাদকে তার মা চিনতে পারেন না। প্রচণ্ড মারের চোটে চোখ-মুখ ফুলে গেছে, ঠোঁট কেটে ঝুলছে, ভুরুর কাছটা কেটে গভীর গর্ত হয়ে গেছে।
–মা, কি করব? এরা তো খুব মারে। স্বীকার করতে বলে সব। সবার নাম বলতে বলে।
–বাবা, তুমি কারোর নাম বলোনি তো?
–না মা, বলি নাই। কিন্তু ভয় লাগে, যদি আরও মারে, যদি বলে দেই…!
–বাবারে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য করো। কারো নাম বলো না।
–আচ্ছা মা। ভাত খেতে ইচ্ছে করে। দুইদিন ভাত খাই না। কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগে পাই নাই।
–আচ্ছা, কালকে যখন আসব, তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসবো।
সাফিয়া বেগমের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। গায়ে হাত তোলা তো দূরে থাক, ছেলের গায়ে একটা ফুলের টোকা লাগতে দেননি কোনোদিন। সেই ছেলেকে ওরা এভাবে মেরেছে। এভাবে…!
মুরগির মাংস, ভাত, আলুভর্তা আর বেগুনভাজি টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে পরদিন সারারাত রমনা থানায় দাড়িয়ে থাকেন সাফিয়া বেগম, কিন্তু আজাদকে আর দেখতে পাননি। তেজগাঁও থানা, এমপি হোস্টেল, ক্যান্টনমেন্ট- সব জায়গায় খুঁজলেন, হাতে তখন টিফিন ক্যারিয়ার ধরা, কিন্তু আজাদকে আর খুঁজে পেলেন না।
ক্র্যাক প্লাটুনের বাকি সদস্যদের মত আজাদকে আর কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
১৯৮৫ সালের ৩০শে আগস্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাফিয়া বেগম আর কখনো বিছানায় শোননি। শক্ত মেঝেতে মাথার নিচে একটা ইট দিয়ে ঘুমিয়েছেন। কারন নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরী সংলগ্ন এম.পি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে তার ছেলেকে তিনি মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন, কাঁটাছেঁড়া শরীরে কোনও রকমে পড়ে থাকা। আর একটাবারের জন্যও কোনোদিন ভাত মুখে তোলেননি সাফিয়া বেগম। বেঁচে থাকার জন্য রুটি খেয়েছেন, পানি দিয়ে ভিজিয়ে পাউরুটিও খেয়েছেন কখনও কখনও। কিন্তু ভাত না। তার আজাদ যে ভাত খেতে চেয়েও ভাত খেতে পায়নি…!
মাঝে মাঝে চারপাশে এতো এতো পাকিস্তানপ্রেমী দেখতে দেখতে লজ্জায় হতাশায় প্রচন্ড ক্ষোভে মাথায় আগুন ধরে যায়, দম বন্ধ হয়ে আসে। জুয়েল-আজাদ-বদি-রুমি-বকর-হাফিজ-আলতাফ মাহমুদদের কথা মনে পড়ে। অসামান্য বীরত্বে যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে গিয়ে নিখোঁজ এই দুর্ভাগা মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ একবার বুকে জড়িয়ে কৃতজ্ঞতাটুকুও জানাতে পারেনি, কারণ তাদের লাশটাও যে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই সন্তানেরা, এই পিতারা, এই আপনজনেরা হারিয়ে গেছেন নীরবে, তাদের স্বজনেরা বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিলেন স্রেফ অপেক্ষায়!
আচ্ছা, এই গেরিলাদের মতো হাজারো মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনেরা যারা আপনজনের লাশটাও খুঁজে পাননি, বুকে জড়িয়ে ধরে প্রাণভরে কাঁদবেন বলে! আজ ৫১ বছর পর এই প্রজন্মের সন্তানদের পাকিস্তানিদের সমর্থন করতে দেখলে, তাদের ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নিতে চাইতে দেখলে এই শহীদ স্বজনদের কেমন লাগে? কি অনুভূতি হয় তাদের? খুব জানতে ইচ্ছে করে।
তথ্য কৃতজ্ঞতা:
১। একাত্তরের দিনগুলি: জাহানারা ইমাম
২। ব্রেইভ অফ হার্ট: হাবিবুল আলম বীর প্রতীক
৩। সুরের বরপুত্র আলতাফ মাহমুদ: দিনু বিল্লাহ
৪। মা: আনিসুল হক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী-. ক্র্যাক প্লাটুনের বীরেরা ফিচার মুক্তিযুদ্ধ রাতিন রহমান