ঢাকায় হানাদারের বুকে আতঙ্ক জাগানো দুর্ধর্ষ এক যোদ্ধার গল্প
৩০ আগস্ট ২০২২ ১৯:৪৬
ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করা অসম্ভব মেধাবী ছাত্র বদিউল আলম একাত্তরে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। তবে সে পরিচয় ছাপিয়ে গিয়েছিল কুখ্যাত এনএসএফের গ্যাংস্টার হিসেবে তার দৌর্দন্ড প্রতাপে। ৬৯’এর গনঅভ্যুত্থান পাল্টে দিল সব, আরও অসংখ্য তরুন-যুবার মতো স্বাধীন বাংলাদেশের সযত্ন লালিত স্বপ্ন পাখা মেলতে থাকে বদির ভেতর। একাত্তরের ২৫শে মার্চের বিভীষিকার পর নিরীহ বাঙ্গালীর তাজা রক্তস্রোত পেরিয়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদানের নিয়োগপত্র হাতে এসেছিল ছেলেটার, ঘৃণাভরে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছিল, বুকে ভেতর বাজছে দামামা, যুদ্ধে যেতে হবে, ছিঁড়েখুঁড়ে আলাদা করে ফেলতে হবে পাকিস্তানি শুয়োরগুলোকে, চোখ দুটো তার জ্বলছিল, ভাটার গনগনে আগুনের মত। বাবা আবদুল বারী সাহেব টের পেয়েছিলেন সেটা, ছেলের মত নির্বিকারচিত্তে পাথরগলায় মা রওশন আরাকে বললেন, ‘তোমার তো ছয় ছেলে, একজনকে না হয় দেশের জন্য দিয়েই দিলে। ’…
ক্র্যাকডাউনের পর প্রথম যে চারজনের দলটা যুদ্ধ করতে ঢাকা ছাড়ে, তার মধ্যে বদি ছিল অন্যতম। মেলাঘরে মেজর ক্যাপ্টেন হায়দারের হাতে ট্রেইন্ড সবচেয়ে চৌকষ গেরিলাদের একজন বদি সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঢাকায় পাকিস্তানিদের নাভিশ্বাস তুলে ফেলে, অংশ নেয় ঢাকা শহর ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি দুর্ধর্র্ষ অপারেশনে। অপারেশনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো- ৮ আগস্ট ফার্মগেটে পাকবাহিনীর চেকপোস্ট অপারেশন, ১৪ আগস্ট গ্যাস বেলুনের মাধ্যমে ঢাকা শহরের আকাশে বাংলাদেশের অনেকগুলো পতাকা উড়ানো, ১৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে অপারেশন, ২৫ আগস্ট ধানমন্ডির ১৮ ও ২০ নম্বর রোডে অপারেশন। এসব অভিযান এখনও গল্পের মতো লোকের মুখে মুখে ফেরে। ২৫শে আগস্ট অপারেশন ‘ডেস্টিনেশন আননোন’ এর ধ্বংসযজ্ঞ এতটাই বেশি ছিল যে নপুংশক পাকিস্তানিরা পাগলা কুকুরের মতো আলবদর রাজাকারদের লেলিয়ে দেয় ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের খুঁজে বের করার জন্য। ২৯ আগস্ট ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপালের বাসা থেকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বদি ধরা পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং নেবার রুট আর অস্ত্রের চালানের রুটটা জানার জন্য ছেলেটার হাড়গুলো সব একটা একটা করে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, প্লায়ারর্স দিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল সবগুলো নখ, একটা শব্দও উচ্চারন করেনি ছেলেটা।
শেষ পর্যন্ত যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সুইচবোর্ডের সকেটের ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে শক খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল সে, পারেনি। এক পাকিস্তানি হাবিলদার পেটাতে পেটাতে তাকে সরিয়ে এনেছিল, ঝরঝর করে রক্ত ঝরতে থাকা মুখটা তুলে বলেছিল, পাশের সেলে ওর বন্ধুরা তথ্য দিচ্ছে, ওরা মুক্তি পেয়ে যাবে, সেও যদি তথ্যগুলো দেয়, তবে ছেড়ে দেওয়া হবে তাকে। ভাটার মত জ্বলছিল চোখদুটো, কণ্ঠে অসম্ভব গাম্ভীর্য এনে প্রায় আধমরা ছেলেটা পাথরকঠিন গলায় বললো, ‘আমি কিছুই বলব না, যা ইচ্ছা করতে পারো। ইউ ক্যান গো টু হেল…’
৩১শে আগস্টের পর বদির আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বদি আর কখনোই ফিরে আসেনি…
তথ্য কৃতজ্ঞতা:
১। ব্রেইভ অফ হার্ট: হাবিবুল আলম বীর প্রতীক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ঢাকায় হানাদারের বুকে আতঙ্ক জাগানো দুর্ধর্ষ এক যোদ্ধার গল্প ফিচার বদিউল আলম মুক্তিযুদ্ধ রাতিন রহমান