পুরান ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য
১০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৬:৩১
বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা। এটি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত থাকলেও এখন স্থানান্তর করা হয়েছে। তৎকালীন সময়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম, ব্যবসা বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরান ঢাকায় ছিল। আর সদরঘাট ছিল এর প্রধান কেন্দ্র। এখানে নদীপথে লঞ্চ, স্টিমার, নৌকা চলাচল করে। ফলে খুব সহজে মানুষ পুরান ঢাকা থেকে দক্ষিণ অঞ্চলের বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাট এবং চাঁদপুরে যাতায়াত করতো। এ দেশের জনসংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। আর গ্রামে মানুষের পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নেই। কাজের সন্ধানে তারা গ্রাম ছেড়ে রাজধানী ঢাকায় আসছে। এতে অপর্যাপ্ত জায়গায় অতিরিক্ত জনসংখ্যা বাস করছে। রাস্তাঘাটে তীব্র ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে মানুষ প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। কিন্তু নদীপথে এমন ট্রাফিক জ্যামের মুখোমুখি হতে হয় না। বাংলাদেশের প্রথম ফুট ওভার ব্রিজ বাংলা বাজার মোড়ে অবস্থিত। এটি ব্রিটিশ সময়ে তৈরি করা হয়েছিল।
ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে বুড়িগঙ্গা নদী। এই নদী এখন মরা নদী। এর পানি খুবই কালো। এতে কোনো মাছ নেই। কিন্তু বাণিজ্যিক সম্ভাবনায় খুব এগিয়ে আছে। আর শ্যামবাজার ও ফরাশগঞ্জ এর মধ্যে অন্যতম। এখানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবসা গড়ে উঠেছে। শ্যামবাজারে সাশ্রয়ী মূল্যে সবজি, মসলা, তরকারি, ফল ইত্যাদি পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সব কিছু বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে শ্যামবাজারে আসে। নদীর উত্তর তীরে গড়ে ওঠা ফরাসি বণিকদের স্মৃতিবিজড়িত এলাকাটির নাম ফরাশগঞ্জ। ১৭৫০ সালের দিকে ফরাসিরা বাংলায় আসে। তারা এসে ফরাসগঞ্জ ভ্রমণ করে এবং তাদের খুব পছন্দ হয় ব্যবসা করার জন্য। তৎকালীন সময়ে ব্যবসায়ীরা বণিক নামে পরিচিত ছিল ছিল। ফরাসি বণিকরা প্রতিষ্ঠিত করে সেখানে একটি ছোট্ট ‘গঞ্জ’। যেহেতু তাদের জাতীয়তা ছিল ফরাসি। ফলে সেই গঞ্জটি, ফরাশগঞ্জ নামে পরিচিতি লাভ করে। এখানেই তারা বাণিজ্যিক কুঠিও স্থাপন করে। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ফরাসিরা তাদের কুঠি, ব্যবসা বেঁচে দিয়ে অন্যত্র চলে যায়। ফরাসিরা চলে গেলেও ফরাশগঞ্জ টিকে গেছে কালের ক্রমে। তখন পুরান ঢাকার স্থানীয় মানুষেরা এখানে ব্যবসা বাণিজ্য করা শুরু করে। ফলে অনেক সবজি, পান সুপারি, মসলা, চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুনের আড়ৎ গড়ে তোলে।
পুরান ঢাকার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বাহন হলো রিকশা। এই প্রাচীন শহরটির যাতায়াতের পথগুলো অত্যন্ত সরু হওয়াতে রিকশা এখানকার প্রধান বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পণ্য পরিবহনের জন্য মানুষ টানা চাকা গাড়ীও রয়েছে প্রচুর। এতে ভারী মালামাল এখন পর্যন্ত বহন করে। তবে পুরান ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ি অধিক জনপ্রিয়। এটি স্থানীয় মানুষের কাছে টমটম নামে পরিচিত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই ঘোড়ার গাড়ি। অনেক মানুষ ঘোড়ার গাড়িতে চড়ার জন্য পুরান ঢাকায় আসে। প্রাচীন কালে যখন যন্ত্রচালিত বাহন ছিল না, তখন মানুষ পশুচালিত গাড়িতে করে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করতো। শুধু তাই নয়, জমিদার ও নবাবের বাহন ছিল এটি। কিন্তু এটি বর্তমানে শুধু পুরান ঢাকাতে পাওয়া যায়। প্রাচীন রাজধানী শহর পুরান ঢাকার সদরঘাট থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত যায়। কিন্তু ভাড়া একটু বেশি লাগে। জনপ্রতি ৩০ টাকা করে ভাড়া লাগে। এতে প্রায় ১০-১২ জন যাত্রী বসতে পারে। আর এই গাড়িতে চড়ার আনন্দ আলাদা। যেখানে মানুষ বাস, রিকশা, সিএনজি তে করে যাতায়াত করছে, আর ঘোড়ার গাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন। এতে চড়ে আশেপাশের সব দেখা যায়। উন্মুক্ত গাড়িতে বসে খোলা আকাশের নিচে টগবগিয়ে এগিয়ে যায়। তবে রূপকথার গল্পেও অনেক শুনলেও বাস্তবে দেখা যাবে পুরান ঢাকায়। যেমন পঙ্ক্ষিরাজ ঘোড়া, রাজপুত্রের টগবগিয়ে চলা ঘোড়া। এছাড়া যান্ত্রিক বাহনগুলোর মধ্যে বাস, টেম্পো, সি.এন.জি. চালিত অটোরিকশা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
পুরান ঢাকার অধিকাংশ স্থানীয় অধিবাসী আদি ঢাকাইয়া। এই অঞ্চলের মানুষজন কিছুটা পৃথক ধরণের ভাষায় কথা বলে। যাকে ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা বলা হয়। এই ভাষাতেও অনেক আরবি, ফার্সি এবং হিন্দি-উর্দু শব্দের ব্যবহার বেশি। আদি ঢাকাইয়া’রা সুব্বাসিতে ও কথা বলে থাকে। ঢাকাইয়া লোকেরা বুদ্ধিমান ও চতুর, কিন্তু ব্যবহারে অত্যন্ত অমায়িক হয়ে থাকেন। অতিথিদের আপ্যায়নে পুরান ঢাকার লোকেরা দেশে সর্বশ্রেষ্ঠ। ঢাকাইয়া পরিবারে ও মহল্লায় বয়স্ক ব্যক্তিদের অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখানো হয়। এখানকার সংখ্যাগুরু লোকের ধর্ম ইসলাম। তারা ঢাকা’র অন্য অঞ্চলের মানুষের তুলনায় অধিকতর ধর্মসচেতন। আর ঢাকাকে ‘মসজিদের নগরী’ বলা হয়ে থাকে। নারিন্দার বিনত বিবির মসজিদ সবচেয়ে প্রাচীন।
পুরান ঢাকার মানুষ খেতে খুব পছন্দ করে। আর সারা বাংলাদেশে পুরান ঢাকার খাবার খুবই বিখ্যাত। এখানকার উল্লেখযোগ্য খাবারগুলো হলো- টিক্কা, জালি কাবাব, কাঠি কাবাব, শামী কাবাব, বটি কাবাব, নার্গিস কাবাব, শিক কাবাব, দই বড়া, মুরগী মুসল্লম, পায়া, কাচ্চি বিরিয়ানি, পাক্কি বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও, নান রুটি, বাকরখানি, নিহারী, বোরহানী, লাবাং ইত্যাদি। এছাড়া অন্যান্য মসলাদার খাবার ঢাকাইয়াদের বিশেষ পছন্দনীয়। নান্নার বিরিয়ানী, হাজীর বিরিয়ানী আল রাজ্জাক রেস্টুরেন্ট, রয়েল রেস্টুরেন্ট, আমানিয়া হোটেল ইত্যাদি এখানকার সুপরিচিত খাদ্যসামগ্রী বিক্রেতা। তবে নাজিরা বাজারের হাজী বিরিয়ানি খেতে দূর প্রান্তের মানুষ ছুটে আসে পুরান ঢাকায়। এছাড়া বিভিন্ন নাটক, সিনেমায় হাজী বিরিয়ানির কথা জানা যায়। নাটকের মধ্যে আরো একবার, টেডি মুস্তফা, বাকরখানি, রাজনীতি, লেখকের মৃত্যু, নীল ও অথৈ এর গদ্য পদ্য, ভালবাসার ভোর, চম্পা হাউজ, পুরান ঢাকার পোলা, পুরান ঢাকার ফুল ভাই, ঢাকা টু সদরঘাট, মুন্না কাচ্চি, কিং অফ সূত্রাপুর, ঢাকাইয়া জামাই উল্লেখযোগ্য। আর অনেক জায়গায় টিকে আছে বাকরখানির ব্যবসা। এটা শুধু পুরান ঢাকাতে পাওয়া যায়। শাঁখারী বাজারের মিষ্টি স্থানীয় মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়। আগুন পান এখন দেখা যায়।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যে পুরান ঢাকা যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি তারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। এখানের উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারী শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুল এন্ড কলেজ, ইন্সটিটিউট অব লেদার টেকনোলজি, পোগোজ স্কুল, তিব্বিয়া হাবিবিয়া ইউনানী মেডিকেল কলেজ, আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ইত্যাদি। কিন্তু ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল ছিল ঢাকার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
পুরান ঢাকায় অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এই দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ পিপাসু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রতি বছর অনেক বিদেশি পর্যটক আসে ভ্রমণ করতে। দর্শনীয় স্থানের মধ্যে ঢাকা কেন্দ্র, নর্থব্রুক হল, বিউটি বোর্ডিং, লালবাগের কেল্লা, ঢাকেশ্বরী মন্দির, তারা মসজিদ, হোসেনী দালান, আহসান মঞ্জিল, শাঁখারিবাজার, বড় কাটারা, ছোট কাটারা, বাহাদুর শাহ পার্ক, বুড়িগঙ্গা ইকো পার্ক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সদরঘাট, বেগমবাজার মসজিদ, খান মুহাম্মাদ মসজিদ, বিনত বিবির মসজিদ, রূপলাল হাউজ, আর্মেনীয় গির্জা, চকবাজার শাহী মসজিদ, শায়েস্তা খান জামে মসজিদ, লালকুঠি।
মাসের প্রথম দিনটি পুরান ঢাকার আকাশ থাকে ঘুড়িওয়ালাদের দখলে। অর্থাৎ সেখানে শোভা পায় নানা রং আর বাহারি ঘুড়িদের সাম্যবাদ। অনুষ্ঠিত হয় সাকরাইন উৎসব। একে ঘুড়ি উৎসব বা পৌষ সংক্রান্তিও বলা হয়। আগে এ উৎসবটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে পুরান ঢাকায় সাড়ম্বরে পালিত হয় এ দিনটি। উৎসবে অংশ নেন সব বয়সী মানুষ। তাই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে পুরান ঢাকা সবচেয়ে সেরা।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ইতিহাস-ঐতিহ্য পুরান ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য ফিচার মোঃ আবদুল্লাহ আলমামুন