Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মুক্তিসংগ্রামে চিরভাস্বর বেগম সাজেদা চৌধুরী

রাতিন রহমান
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২০:১০

বেগম সাজেদা চৌধুরী। সংসদের উপনেতা, ফরিদপুর-২(নগরকান্দা, সালথা ও সদরপুরের কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন) আসনের সংসদ সদস্য, সাবেক বন ও পরিবেশ মন্ত্রী, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক, আওয়ামীলীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য- অজস্র পরিচয়ের আড়ালে এই মহিয়সীর যে অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় ও ভূমিকাটা আড়ালেই থেকে যায়, সেগুলো হচ্ছে তিনি ছিলেন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত ৭ জন নারী সংসদ সদস্যের একজন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ছিলেন মুজিবনগর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মী, তার পেশাভিত্তিক ক্রমিক নং ছিলো ১৮২২, পদবী ছিলো ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা্ এবং দায়িত্বস্থল ছিলো আগরতলা মহিলা শরণার্থী শিবির। মুক্তিযুদ্ধের পর ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হওয়া বীরাঙ্গনা নারী মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নারীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠিত হয়। সেখানে পরিচালকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সাজেদা।

বিজ্ঞাপন

বাঙ্গালীর স্বাধিকার ও মুক্তিসংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সাজেদা চৌধুরী তারুণ্যের শুরু থেকেই সক্রিয়ভাবে নিবেদিত ছিলেন আন্দোলনে, মিছিলে, প্রতিবাদে। ১৯৩৫ সালের ৮ মে ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার চন্দ্রপাড়া গ্রামে জমগ্রহণ করা সাজেদা চৌধুরীর দাদা সৈয়দ সাজ্জাদ জাফর ছিলেন কংগ্রেসের কর্মী,যুক্ত ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনে, জেল খেটেছেন মহাত্মা গান্ধীর সাথে। উত্তরাধিকার সূত্রে দাদার কাছ থেকে বিপ্লবী মানসিকতা পেয়েছিলেন সাজেদা, তরুণ বয়স থেকেই বিভিন্ন সামাজিক ও নারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন তিনি। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন সাজেদা, ছিলেন অল পাকিস্তান উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (আপওয়া) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদিকা ও পরে সহসভাপতি। তার রাজনৈতিক জীবনে অন্যতম বড় মোড় আসে ১৯৬৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা আবদুল আজিজকে মুসলিম লীগের সন্ত্রাসীরা মেরে ফেলে, কিন্তু সাজেদা তার আরো ১৫-২০ জন নারীকে নিয়ে সরকারী বাধা উপেক্ষা করে মিছিল নিয়ে লালদিঘি ময়দানে গিয়ে বক্তব্য দেন।তৎকালীন চট্টগ্রামে নারীদের রাজনীতি করার ব্যাপারটাই যেখানে বেশ অপরিচিত, সেখানে প্রথাভেঙ্গে সাজেদা চৌধুরীর প্রকাশ্য জনসভায় এই বক্তৃতা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সেটাই ছিল তার জীবনে প্রথম রাজনৈতিক সমাবেশে বক্তব্য। এরপরে কিভাবে তিনি ছয় দফার পথ ধরে স্বাধিকারের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে গেলেন, সেটা বলেছেন এক সাক্ষাৎকারেঃ

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে চট্টগ্রামে আসেন। ওই সময় মহিলাদের সংগঠিত করে লালদীঘির ময়দানের সমাবেশে অংশগ্রহণ করি। বঙ্গবন্ধু আমার সাংগঠনিক দক্ষতায় খুশি হয়ে ঢাকায় চলে আসার জন্য বলেন। ১৯৬৬ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পরিবার-পরিজনসহ ঢাকায় চলে আসি। ইতিমধ্যে ছয় দফা ঘোষিত হয়েছে। সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে মিছিল হয়। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আরো বেগবান হয়। নিয়মিতভাবে আওয়ামী লীগ অফিসে বসার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে নারীদের জন্য একটা কক্ষ বরাদ্দের আবেদন জানাই। অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু নিজের বসার ভালো কক্ষটি নারীদের জন্য দিয়ে অন্য একটি কক্ষে চলে যান। ১৯৬৯ সালে ফুলার রোডে আওয়ামী লীগের একটি সভায় মহিলা আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আমি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার পাশাপাশি একাত্তরের উত্তাল সময়ে সাজেদা চৌধুরীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে তার বাসা মরিচা হাউসের সামনে মিসেস টি এন রশিদের পরিচালনায় প্রায় ২০০ নারী প্রশিক্ষণ নেয়। ১৯৭১ সালের ৩ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ শেষে ২৩ মার্চ মরিচা হাউস থেকে মার্চপাস্ট করে তারা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তাঁর হাতে মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেয়।২৫ শে মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর সাজেদা চৌধুরী প্রচন্ড প্রতিকূলতার মধ্যে দুই সন্তানকে নিয়ে নড়াইল থেকে পায়ে হেঁটে বিপদসংকুলতার মধ্যে ভারতে যান তিনি। টানা সাত দিন হেঁটে সন্তানদের নিয়ে হাঁটতে হয় তাকে। সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,

নারীদের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে মুজিবনগর সরকার একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমার ওপর। এটি মূলত ছিল নারী শরনার্থী শিবির। জুন মাসের প্রথম দিকে মুজিবনগর সরকার এবং ভারত সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতায় কলকাতার পদ্মপুকুর এলাকার গোবরায় এ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করি। প্রশিক্ষক-প্রশিক্ষণার্থী সংগ্রহ, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ সব আয়োজন সমাপ্ত করে শুরু হয় নারীদের নার্সিং, ফার্স্ট এইড, মোটিভেশন ও সামরিক প্রশিক্ষণ। ১৬ জন করে কয়েকটি দলকে প্রশিক্ষণ শেষে বিভিন্ন ফ্রন্টে ও হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করার জন্য পাঠানো হয়।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান বইতে এএসএম সামছুল আরেফিন লিখেছেন ১০ মে ১৯৭১ আগরতলা সোনামুড়া বনবিভাগের বিশ্রামাগারে ক্যাপ্টেন আখতার আহমেদের তত্ত্বাবধানে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ হাসপাতাল স্থাপন করা হয়। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম আনুষ্ঠানিক চিকিৎসা ও সেবাকেন্দ্র। ২৭ জুলাই এটি আগরতলার দারোগা বাগিচায় স্থানান্তর করা হয়। আগস্ট মাসে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই হাসপাতালটিকে পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। ২৬ আগস্ট ১৯৭১ সালে হাবুল ব্যানার্জীর বাগানে এটি নতুন করে সাজানো হয়।

বেগম সাজেদা চৌধুরী

বেগম সাজেদা চৌধুরী

বাংলাদেশ হাসপাতাল এর পরিকল্পনা, পরিচালনা ও তত্বাবধানে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য দপ্তর ও ভারতীয় রেডক্রস এবং বেগম সাজেদা চৌধুরী ও বেগম রাফিয়া আক্তার ডলির প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে পরিচালিত নার্সিং শিবিরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১৬ জন সেবিকা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। এখানে যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য ডাক্তার সিতারা বেগমের সঙ্গে সাঈদা কামাল ও সুলতানা কামাল চিকিৎসা সহকারী হিসেবে বীর প্রতীক উপাধী পান।

একাত্তরের পরে স্বাধীন বাংলাদেশে সাজেদা চৌধুরীর কার্যপরিধি আরো বিস্তৃত হয়। একাত্তরের নয় মাস জুড়ে লাখো নারীদের উপর দুঃসহ দুঃস্বপ্ন নেমে আসে, লাখো নারী পাকিস্তানী নরপিশাচদের পাশবিক নির্যাতনে নিষ্পেষিত হন। ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হওয়া বীরাঙ্গনা নারী মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নারীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠিত হয়। সেখানে পরিচালক হিসেবে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত এই নারীদের আপ্রাণ সহযোগিতায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন সাজেদা চৌধুরী।

As the scope of the problem became ever more apparent and relief funds poured in from the largest UN-led relief operation ever organised up to then, the new government of Sheikh Mujibur Rahman, urged on by Ministers Budrunnessa Ahmad and Nurjahan Murshed,- set up a government structure to address not only the plight of raped women, but also that of the numerous women left destitute without family support — in a society where independent women were practically unknown.

The Bangladesh Women’s Rehabilitation Board (subsequently to become the Women’s Rehabilitation and Welfare Foundation) was formed on February 18, 1972 as a semi-autonomous organisation affiliated with the Ministry of Social Welfare. The 13-member governing board was headed by Justice K.M. Sobhan, a sitting Supreme Court judge, and consisted of prominent women political leaders and war widows.-

The board members were: Justice K.M. Sobhan, Budrunnessa Ahmad, Nurjahan Murshed, Sajeda Chowdhury, Momtaz Begum, Rafia Akhtar Dolly, Nilima Ibrahim, Sufia Kamal, Jahanara Rabbi, Lily Chowdhury, Basanti Guhathakurta, Mushfequa Mahmud and Abdul Awal (executive director), Bangaldesh Observer, “High Powered Body to Rehabilitate Women Victims,” February 24, 1972,.

স্বাধীনতা, স্বাধিকার ও মুক্তিযুদ্ধসহ সার্বিক মুক্তিসংগ্রামে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা এই সাজেদা চৌধুরীকে নিয়েও স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক দালাল অপশক্তি জঘন্য প্রপাগান্ডা ছড়ায় ২০১১-২০১২ সালের দিকে। যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তান সরকারের প্রপাগান্ডা ম্যাকানিজমের মধ্যে অন্যতম ছিল জামাতের পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামসহ অন্য পত্রিকাগুলো তখন প্রায়ই সংবাদ প্রকাশ করতো- আওয়ামী লীগের কোন কোন শীর্ষ নেতা ‘পক্ষ’ বদল করার জন্য গোপনে যোগাযোগ করছে। তো, ঐ সময় ছড়ানো গুজবের একটি ছিলো ‘সাজেদা চৌধুরীও পক্ষ বদলের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন, তিনিও নাকি রাজাকার!’

সেই গুজব আবার নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশে ছড়ায় জামাতী প্রপাগান্ডা সেল, উদ্দেশ্যে একটাই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ করা। অদ্ভুত হলেও সত্য, সাজেদা চৌধুরী একাত্তরের নয় মাস মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে ঠিক কোথায় কিভাবে কর্মরত ছিলেন, সেটার ডকুমেন্টেড ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও জামাতের এই নোংরা মিথ্যাচার বেশ সাড়া ফেলেছিল! গুজবপ্রিয়তা যে আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য।

এক সফল জীবন শেষে সাজেদা চৌধুরীর প্রয়াণ আমাদের ব্যাথিত করে। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে, মুক্তিসংগ্রামে ও জাতির সকল সংকটে অবিস্মরণীয় সব ভূমিকায়, স্মৃতিতে, শ্রদ্ধায়!

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

ফিচার বেগম সাজেদা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিসংগ্রামে চিরভাস্বর বেগম সাজেদা চৌধুরী রাতিন রহমান

বিজ্ঞাপন

ফের দাপট দেখালেন সাকিব
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০৪

আরো

সম্পর্কিত খবর