Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যেভাবে দুর্গা পূজা বাঙালি হিন্দুর প্রধান উৎসব হলো

জুয়েল সরকার
৪ অক্টোবর ২০২২ ২০:৪৬

দুর্গা পূজার সূচনা হয়েছিল বহু প্রাচীনকালেই। ইতিহাসবিদ বা সমাজবিজ্ঞানী ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীতে দূর্গোৎসবের উদ্ভবের ইতিহাস ও আনুষঙ্গিক ঘটনাপঞ্জি নির্ভরযোগ্য দলিলপত্র ঘেঁটে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হননি। ফলে কখন, কীভাবে দূর্গোৎসব শুরু হলে—তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে পূরাণ, মহাভারত, রামায়ন, ধর্মীয় কাব্য, নানা ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও সূত্র থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।

বিজ্ঞাপন

দুর্গার পূজা শুরুর যথার্থ নথি না পাওয়া গেলেও, বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার পরিচয় আছে। অনেকেরই মতে, সম্ভবত মোঘল আমল থেকেই ধনী পরিবারগুলিতে দুর্গা পূজা করা হত। ইতিহাস বলছে দেবীর পূজা সম্ভবত ১৫০০ শতকের শেষ দিকে প্রথম শুরু হয়। সম্ভবত দিনাজপুর, মালদার জমিদার স্বপ্নাদেশের পর প্রথম পারিবারিক দুর্গা পূজা শুরু করেছিলেন। এরপরে রাজশাহীর রাজা এবং বিভিন্ন গ্রামের হিন্দু রাজারা প্রতিবছর এই পূজা আরম্ভ করেন। আবার কলকাতায় ১৬১০ সালে বারিশার রায়চৌধুরী পরিবার প্রথম দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিল বলে জানা যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর রাজা নবকৃষ্ণদেব লর্ড ক্লাইভের সম্মানে কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গা পূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন এবং তার জন্য বিদেশ থেকে নিকি বাঈ নামে এক নর্তকীকে আনিয়েছিলেন। ব্রিটিশ বাংলায় এই পূজা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায় এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দুর্গাপূজা স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে জাগ্রত হয়।

বিজ্ঞাপন

প্রথম দিকে এই পূজা ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। এ দুঃখ থেকে বারো বন্ধু বা ইয়ার মিলে একটি পূজার আয়োজন করে। সেটাই পরে বারোয়ারি পূজা হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। ১৯১০ সালে কলকাতায় প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বারোয়ারি পূজার শুরু হয়। সনাতন ধর্মসভা, বাগবাজারে সার্বজনীন একটি দুর্গোৎসবের সূচনা করেন যা সম্ভব হয়েছিল জনসাধারণের সহযোগিতার সাহায্যে। মা দুর্গা ধনীর ঘর থেকে সাধারণের ঘরে আসতে শুরু করেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয় বাঙালির কল্পনা। শরতে দেবী স্বামীর গৃহ থেকে আসেন বাপের বাড়ি বেড়াতে। সঙ্গে তার ৪ সন্তান। কিন্তু এই চার সন্তানের উপস্থিতি পুরোনো কোনো দুর্গামূর্তিতে পাওয়া যায় না। এ একান্তই বাঙালি উচ্চ কল্পনাশক্তির বহিঃপ্রকাশ। যুদ্ধংদেহী দেবীকে গেরস্ত বাড়ির মেয়ে বানিয়ে হয়তো বাঙালি দেবীর যুদ্ধংদেহী রূপকে ভুলে থাকতে চায়। তাই তাকে একটি পরবর্তিত কাঠামো দেয়া হয়। দেবী দুর্গার আদিরূপের আরাধনা বোধহয় বাঙালি করে না। করে নিজস্ব সৃজিত এক নির্মিতির। তারপর থেকে গোটা বাংলায় দুর্গা পূজার প্রবল প্রচার হয় এবং বর্তমানে এটি বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

তবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবার কাছে দুর্গা পূজা প্রধান ধর্মীয় উৎসব নয়। মূলত বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষাভাষী হিন্দুদের মধ্যেই এটি সবচেয়ে বেশি আনুষ্ঠানিকতা এবং আড়ম্বরের সাথে পালিত হয়। এছাড়া হিন্দুপ্রধান দেশ নেপালেও এটিই সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। কিন্তু দুর্গা পূজা কীভাবে হয়ে উঠলো বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান?

সংস্কৃত ভাষায় রচিত বাল্মীকির মূল রামায়ণে দুর্গা পূজার কোন উল্লেখ ছিল না। কিন্তু রামায়ণ যখন বাংলা ভাষায় অনুদিত হলো মূলত তখন থেকেই দেবী হিসেবে দুর্গার মহাত্ম্য বাংলাভাষী হিন্দুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কবি কৃত্তিবাস ওঝা যখন রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করেন, তখন লোকায়ত গল্পে যেখানে দুর্গার কাহিনী প্রচলিত ছিল, সেটি অন্তর্ভুক্ত করেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এটি মূল রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়। কৃত্তিবাস ওঝা সংস্কৃত রামায়ণ বাংলা করার সময় মূল রামায়ণের বাইরের তৎলালীন সমাজে প্রচলিত বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ, অনেক মিথ, গল্প বাংলা রামায়ণে ইচ্ছাকৃতভাবে (নাকি গৌড়ের রাজা বা অন্য কারো অনুরোধে!) ঢুকিয়ে বাংলা রামায়ণ আরো অধিক সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, তিনি সংস্কৃত রামায়ণ উপাখ্যানের এমনভাবে বঙ্গীকরণ বা বাংগালিকরন করেন, যা পড়লে মনে হবে, রামায়নের ঘটনা তৎকালীন সমাজের আদি কাহিনী।

এই ভাবেই দুর্গা প্রধানতম দেবী হিসেবে আবির্ভূত হন বাঙ্গালী হিন্দুদের কাছে। কিন্তু এরপরও প্রধান ধর্মীয় উৎসব হয়ে উঠতে দুর্গা পূজার সময় লেগেছে আরো কয়েক’শ বছর। মূলত ব্রিটিশ শাসনের সময় হিন্দু এলিট ও জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দুর্গা পূজা। তখনকার সময়ে হিন্দুদের মধ্যে যে শ্রেনীভাগ ছিল, সেটা নিয়ে তখন অনেক সামাজিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তখন বাংলার এলিট শ্রেণী দেখলো যে এমন একটা শক্তির দরকার, যাকে সবাই মেনে নেবে। সে সময় দুর্গার পূজা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর একটা কারণও ছিল, দুর্গার মাতৃরূপ। সে সময়ে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথার প্রচলন ছিলো। তাই দেবীর মাতৃরূপ দ্রুতই গ্রহণযোগ্যতা পায়।

হিন্দু পুরান অনুসারে দেবী দুর্গার শরৎকালে পূজা অকালবোধন। অর্থাৎ অকালে আমন্ত্রণ জানিয়ে পূজা। বসন্তকালে দেবী পূজার বিধান থাকলেও রাজা রামচন্দ্র সীতাকে লঙ্কাপতি রাবণের হাত থেকে উদ্ধারের জন্য শরৎকালে দেবীকে জাগ্রত করেন। তাই সেই থেকেই শরৎকালে দেবীর পুজো অকালবোধন নামে পরিচিত। তবে বাংলাতে শরৎকালে পূজার নজির বেশিদিনের নয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ন বা নদীয়ার ভবানন্দ মজুমদার বাংলায় প্রথম শারদীয়া বা শরৎ দুর্গা পূজা আয়োজন করেন। দুর্গা পূজার সময় হিসেবে শরৎকালকে বেছে নেবার কারণ ছিল, যেহেতু এটা কিছুটা অঞ্চলভিত্তিক পূজা ছিল, ঐ সময়টাতে বৃষ্টি তেমন হয় না। তাছাড়া এটা নবান্নের সময়, এ সময় ধান ও অন্যান্য শস্য উঠত, মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকত। ফলে মানুষ আনন্দ করতে পারতো।

সূত্র:

  • ১.বাংলাদেশ ও পাক ভারতের ইতিহাস, জে.এম. বেলাল হোসেন সরকার, আনোয়ারুল হক মজুমদার, আবদুল আউয়াল
  • ২. ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, মুনতাসীর মামুন
  • ৩. ঢাকেশ্বরী মন্দির, উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ
  • ৪. প্রবন্ধ শব্দাঞ্জলিতে দুর্গাপূজা, হরিপদ ভৌমিক, নতুন বাংলার মুখ পত্রিকা
  • ৫. দৈনিক যুগান্তর, ১৯৭০ সালের ১০ মে দ্রঃ
  • ৬. রামায়ণ কৃত্তিবাস বিরচিত, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ও ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখিত ভূমিকা সম্বলিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৫৭ সংস্করণ

সারাবাংলা/এসবিডিই

টপ নিউজ দুর্গা পূজা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর