Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইদে মিলাদুন্নবী— ইতিহাস, প্রচলন ও বিতর্ক

এ জেড এম আব্দুস সবুর
৯ অক্টোবর ২০২২ ১৭:২১

ইদে মিলাদুন্নবী হচ্ছে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ উৎসবমুখর দিন। সারা বিশ্বের বহু মুসলিম অত্যন্ত জাঁকজমক, ভক্তি ও মর্যাদার সাথে আরবী বৎসরের ৩য় মাস রবিউল আউআল মাসের ১২ তারিখে এই ইদে মিলাদুন্নবী বা নবীর জন্মের ইদ পালন করেন। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিমই এই ‘ইদের’ উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাসের সাথে পরিচিত নন। যে সকল ব্যক্তিত্ব এই উৎসব মুসলিম উম্মার মধ্যে প্রচলন করেছিলেন তাদের পরিচয়ও আমাদের অধিকাংশের অজানা রয়েছে। নবীজির জীবদ্দশায় এ ধরনের উৎসবের আয়োজন করা না হলেও তার মৃত্যুর কয়েকশ বছর পর প্রথমবারের মতো উদযাপন করা হয় ইদে মিলাদুন্নবী। ইসলামি পণ্ডিতদের মাঝে অনেক বিতর্ক থাকলেও কালক্রমে এই উৎসবটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

বিজ্ঞাপন

ইদে মিলাদুন্নবীর ইতিহাস

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর প্রথম যুগে সাহাবি, তাবেয়ি ও তাবে তাবেয়িদের মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিন পালন বা উদযাপন করার প্রচলন ছিল না। মুহাদ্দিস, ফিকহ ও ঐতিহাসিকদের গবেষণায় এই মত দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) জন্মদিন পালন বা রবিউল আউয়াল মাসে ইদে মিলাদুন্নবী পালনের বৈধতা ও অবৈধতা নিয়ে আলেম সমাজে অনেক মতবিরোধ রয়েছে। তবে মিলাদুন্নবী উদযাপনের পক্ষের ও বিপক্ষের সব আলেম ও গবেষক একমত যে, ইসলামের প্রথম শতাব্দীগুলোতে ইদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করার কোনো প্রচলন ছিল না।

নবম হিজরি শতকের অন্যতম আলেম ও ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে হাজর আল-আসকালানি (মৃত্যু ১৪৪৯ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন, ‘মাওলিদ (ইদে মিলাদুন্নবী) পালন মূলত বিদ’আত। ইসলামের সম্মানিত প্রথম তিন শতাব্দীর সালফে সালেহিনদের মধ্যে কোনো একজনও এই কাজ করেননি।’

হিজরি নবম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে প্রখ্যাত মুদাদ্দিস ও ঐতিহাসিক আল্লামা আবুল খাইর মুহাম্মাদ ইবন আব্দুর রহমান আস-সাখাবি (মৃত্যু: ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন, ‘ইসলামের সম্মানিত প্রথম তিন যুগের সালফে সালেহিনদের (সাহাবি, তাবেয়ি ও তাবে-তাবেয়ি) মধ্যে কোনো একজনকেও মাওলিদ পালনের কোনো ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায় না। মাওলিদ পালন বা উদযাপন পরবর্তী যুগে উদ্ভাবিত হয়েছে। এরপর থেকে সব দেশের ও সব বড় বড় শহরের মুসলিমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম দিন ও মাস পালন করে আসছেন। এ উপলক্ষে তারা অত্যন্ত সুন্দর জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবময় খানাপিনার মাহফিলের আয়োজন করেন। এ মাসের রাতগুলোতে তারা নানা রকমের দান সদকা করেন, আনন্দ প্রকাশ করেন এবং জনকল্যাণমূলক কর্ম বেশি করে করেন। এ সময় তারা নবীজীর জন্মকাহিনী পাঠ করতে মনোনিবেশ করেন।’

বিজ্ঞাপন

লাহোরের প্রখ্যাত আলেম সাইয়েদ দিলদার আলি (মৃত্যু ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ) মিলাদের সপক্ষে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘মিলাদের কোনো সূত্র প্রথম তিন যুগের সালফে সালেহিন থেকে বর্ণিত হয়নি। বরং তাদের যুগের পর এর উদ্ভাবন হয়েছে।’

আলেমদের এই ঐকমত্যের সূত্র হলো দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে সংকলিত অর্ধশতাধিক সনদভিত্তিক হাদিসের গ্রন্থ। এসব গ্রন্থে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্ম, আচার-আচরণ, কথা, অনুমোদন, আকৃতি, প্রকৃতি ইত্যাদি সংকলিত হয়েছে। সংকলিত হয়েছে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়িদের মতামত ও কর্ম। সেসব গ্রন্থের একটি হাদিসেও দেখা যায় না যে, রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় বা তার মৃত্যুর পর কোনো সাহাবি সামাজিকভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে তার জন্ম উদযাপন, জন্মদিন নিয়ে আলোচনা বা জন্ম উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন বা অনির্দিষ্টভাবে বৎসরের কোনো সময়ে কোনো অনুষ্ঠান করেছেন।

একমাত্র রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন তাদের আলোচনা, সব চিন্তা-চেতনার প্রাণ, সব কর্মকাণ্ডের মূল। তারা নবীজির জীবনের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনা আলোচনা করে তার ভালোবাসায় চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছেন। তার আকৃতি, প্রকৃতি ও পোশাক-আশাকের কথা বর্ণনা করে জীবন অতিবাহিত করেছেন। কিন্তু তারা কখনো তার জন্মদিন পালন করেননি। এমনকি তার জন্ম মুহূর্তের ঘটনাবলি আলোচনার জন্যও তারা কখনো বসেননি বা জন্ম উপলক্ষে কোনো দান সদকা কিংবা আনন্দ উৎসবের আয়োজন করেননি। তাদের পর তাবেয়ি ও তাবে তাবেয়িদের অবস্থাও একই ছিল।

বস্তুত, কারও জন্ম বা মৃত্যুদিন পালন করার বিষয়টি আরবের মানুষের কাছে একেবারেই অজ্ঞাত ছিল। জন্মদিন পালন অনারবীয় সংস্কৃতির অংশ। এর মধ্যে পারস্যের মাজুস (অগ্নি উপাসক) ও বাইজেন্টাইন খ্রিস্টানদের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল জন্ম কিংবা মৃত্যুদিন পালন করার মতো বিষয়গুলো। হিজরি তৃতীয় শতাব্দী থেকে মুসলিম সাম্রাজ্যে অনারব পারসিয়ান ও তুর্কি মুসলিমদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে মুসলিম সাম্রাজ্যে নতুন নতুন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতির প্রচলন ঘটে। এসব রীতিনীতির মধ্যে ইদে মিলাদুন্নবী ছিল অন্যতম।

ইদে মিলাদুন্নবীর প্রচলন

ইতিহাসের আলোকে জানা যায়, দুই ইদের বাইরে কোনো দিবসকে প্রথমবারের মতো উদযাপন শুরু হয় চতুর্থ হিজরি শতাব্দীর মাঝামাঝিতে শিয়াদের উদ্যোগে। সর্বপ্রথম ৩৫২ হিজরিতে (৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ) বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফার প্রধান প্রশাসক ও রাষ্ট্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক বনি বুয়াইহির শিয়া শাসক মুইজ্জোদ্দৌলা ১০ মহররম আশুরাকে শোক দিবস এবং জিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখকে গাদিরে খুম উৎসব দিবস হিসেবে পালন করার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে এই দুই দিবস সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালন করা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় শুধু শিয়ারাই এই দিবস পালন করলেও ধীরে ধীরে তা সামাজিক রূপ লাভ করে। কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার ফলে তৎকালীন আহলুস সুন্নাত ওয়াল জাম’আতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এতে কোনো বাধা প্রদান করতে পারেননি। পরে যতদিন শিয়াদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল ততদিন এই দুই দিবস নিয়মিত উদযাপন করা হয়, যদিও তা মাঝেমাঝে শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে ভয়ংকর সংঘাত ও গৃহযুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ইদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করার ক্ষেত্রেও শিয়ারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। উবাইদ বংশের রায়েযি ইসমাঈলি শিয়ারা ফাতেমি বংশের নামে আফ্রিকার উত্তরাংশে রাজত্ব স্থাপন করেছিলেন। ৩৫৮ হিজরিতে তারা মিসর দখল করে ফাতেমি রাজত্বের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এবং পরবর্তী দুই শতাব্দী কাল ধরে মিসরে তাদের কর্তৃত্ব বজায় থাকে।

৫৬৭ হিজরিতে গাজী সালাউদ্দিন আইয়ুবির মিসর দখলের মধ্য দিয়ে ফাতেমি রাজত্বের পতন ঘটে। তবে, দুই শতাব্দীর শাসনামলে ফাতেমি রাজবংশের ইসমাঈলি শিয়া শাসকরা দুই ইদ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি দিবস পালন করতেন। এসব উৎসবের বেশিরভাগই ছিল জন্মদিন। তারা অত্যন্ত আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে পাঁচটি জন্মদিন পালন করতেন। এই জন্মদিনগুলো হলো-রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিন, আলী (রা.)-এর জন্মদিন, ফাতেমা (রা.)-এর জন্মদিন, হাসান (রা.)-এর জন্মদিন এবং হুসাইন (রা.)-এর জন্মদিন। এছাড়াও তারা তাদের জীবিত খলিফার জন্মদিন পালন করতেন। সে সময় মিসরের খ্রিস্টানরা ‘মিলাদ’ নামে ইসা (আ.)-এর জন্মদিন (বড়দিন) উদযাপন করতেন।

আহমদ ইবন আলি আল-কাশান্দি লিখেছেন, ‘রবিউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখে ফাতেমি শিয়া শাসক মিলাদুন্নবী উদযাপন করতেন। এ উপলক্ষে বিপুল পরিমাণ উন্নত মানের মিষ্টান্ন তৈরি করা হতো। এই মিষ্টান্ন ৩০০ পিতলের খাঞ্চায় ভরা হতো। মিলাদের রাতে এই মিষ্টান্ন সব তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলদের মধ্যে বিতরণ করা হতো। যেমন, প্রধান বিচারক, প্রধান শিয়া মত প্রচারক, দরবারের কারিরা, বিভিন্ন মসজিদের খতিব ও প্রধানরা ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে মিষ্টান্ন বিতরণ করা হতো।

ইদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে খলিফা প্রাসাদের সামনের ব্যালকনিতে বসতেন এবং বিচারপতি বিভিন্ন ও কর্মকর্তাদের নিয়ে আজহার মসজিদে গমন করতেন। তিনি সেখানে এক খতম কুরআন তেলাওয়াত পরিমাণ সময় বসতেন। মসজিদ ও প্রাসাদের মধ্যবর্তী স্থানে অভ্যাগত পদস্থ মেহমানরা বসে খলিফাকে সালাম প্রদানের জন্য অপেক্ষা করতেন। এসময় ব্যালকনির জানালা খুলে হাত নেড়ে খলিফা তাদের সালাম গ্রহণ করতেন। এরপর কারিরা কুরআন তেলাওয়াত করতেন এবং বক্তারা বক্তব্য প্রদান করতেন। বক্তৃতা শেষ হলে খলিফার সহচররা হাত নেড়ে সমবেতদের বিদায়ী সালাম জানাতেন। খিড়কি বন্ধ করা হতো এবং উপস্থিত সবাই একে একে বাড়ি ফিরে যেতেন। এভাবে তারা আলি (রা.)-এর জন্মদিনও পালন করতেন।

আহম্মদ ইবন আলি আল-মাকরিযি (৮৪৫ হিজরি) এসব উৎসবের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘এসব জন্মদিনের উৎসব ছিল তাদের খুবই বড় এবং মর্যাদাময় উৎসবের মুহূর্ত। এসময় মানুষরা সোনা ও রুপা দিয়ে স্মারক তৈরি করতেন। বিভিন্ন ধরনের খাবার, মিষ্টান্ন তৈরি করে প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করা হতো।’

হিজরি চতুর্থ শতাব্দী থেকে ইদে মিলাদুন্নবী উদযাপন শুরু হলেও তা কেবল মিসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বলা যায়, কায়রোর এই উৎসব ইসলামি বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েনি। ধারণা করা হয়, ফাতেমি রাজবংশের ইসমাঈলীয় শিয়াদের প্রতি সাধারণ মুসলিম সমাজের প্রকট ঘৃণার ফলেই তাদের উৎসবসমূহ অন্যান্য সুন্নি এলাকায় জনপ্রিয়তা পায়নি।

ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, হিজরি ৬ষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে মিসর, সিরিয়া এবং ইরাকের কিছু কিছু মানুষ রবিউল আউয়াল মাসের ৮ কিংবা ১২ তারিখে আনন্দ উৎসবের সঙ্গে ইদে মিলাদুন্নবী উদযাপন শুরু করেন।

তবে, যিনি ইদে মিলাদুন্নবীর প্রবর্তক হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ তিনি হলেন, ইরাক অঞ্চলের ইরবিল প্রদেশের শাসক আবু সাইদ কুকুবুরি (মৃত্যু: ৬৩০ হিজরি)। তিনিই প্রথম সুন্নিসহ বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইদে মিলাদুন্নবীর প্রবর্তন করেন। সিরাতুন্নবী গবেষক ও ঐতিহাসিকরা তাকেই মিলাদুন্নবীর প্রকৃত উদ্ভাবক বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ তিনিই প্রথম এই উৎসবকে বৃহৎ আকারে উদযাপন শুরু করেন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই উৎসবের প্রচলন করেন।

আল্লামা মুহাম্মদ ইবন ইউসুফ সালেহি শামি তার বিখ্যাত সিরাতুন্নবী গ্রন্থে বলেন, ‘সর্বপ্রথম যে বাদশা ইদে মিলাদুন্নবীর প্রচলন করেন তিনি হলেন ইরবিলের শাসক আবু সাইদ কুকুবুরি।’

কুকুবরি ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত। তার নামটিও তুর্কি। তুর্কি ভাষায় কুকুবুরি শব্দটির অর্থ নীল নেকড়ে। তার পিতা আলি ইবন বাকতাকিন ছিলেন ইরবিলের শাসক। তিনি অত্যন্ত সাহসী এবং বীর যোদ্ধা ছিলেন। ক্রুসেড যোদ্ধাদের কাছ থেকে অনেক এলাকা জয় করে তিনি তার সাম্রাজ্যে অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন। ধার্মিক হিসেবেও তিনি সুখ্যাত ছিলেন। ৫৪৯ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন তার পুত্র কুকুবুরি। পুত্রের যখন ১৪ বছর বয়স তখন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১৪ বছর বয়সে কুকুবুরি ইরবিলের শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি অল্প বয়স্ক হওয়ার কারণে তার অভিভাবক হিসেবে নিযুক্ত হন আতাবিক মুজাহিদ উদ্দিন কায়মায। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কুকুবুরির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং শাসন ক্ষমতা চালানোর অযোগ্য ঘোষণা করে কুকুবুরিকে ক্ষমতাচ্যুত করে কুকুবুরির ভাই ইউসুফকে ক্ষমতায় বসান। এ অবস্থায় কুকুবুরি ইরবিল ত্যাগ করে ইরাকের মাওসিল অঞ্চলের শাসক সাইফুদ্দিন গাজী ইবন মওদুদের কাছে গমন করেন। মওদুদ কুকুবুরিকে মাওসিল অঞ্চলের হাররান প্রদেশের শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। কিছুদিন হাররানে অবস্থানের পর কুকুবুরি সেই যুগের প্রসিদ্ধ বীর, মিসর ও সিরিয়ার শাসক গাজী সালাউদ্দিন আল-আইয়ুবির দরবারে যোগ দেন। তিনি সালাউদ্দিনের সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ্রগহণ করেন। সালাউদ্দিন কুকুবুরির বীরত্ব এবং কর্তব্যনিষ্ঠায় এতই মুগ্ধ হন যে, নিজের বোন রাবীয় খাতুনের সঙ্গে তার বিয়ে দেন এবং তাকে হাররান ও রুহা অঞ্চলের শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। ৫৮৩ হিজরিতে হিত্তিনের যুদ্ধে ক্রুসেড বাহনীকে সালাউদ্দিন শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধেও কুকুবুরি অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেন। এই সময়ই ইরবিলের ক্ষমতায় থাকা তার ভাই ইউসুফ মৃত্যুবরণ করলে সালাউদ্দিন তাকে পুনরায় ইরবিলের শাসন ক্ষমতা প্রদান করেন। ছোট রাজ্যের রাজা হলেও কুকুবুরি ছিলেন তখনকার সময়ে সবচেয়ে বেশি ধার্মিক, সবচেয়ে বেশি দানশীল এবং মানবসেবী। প্রতি বছর ইদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে তিনি যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতেন তা মানুষের মুখে প্রবাদের মতো উচ্চারিত হতো। শাসনকার্য পরিচালনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি আলেমদের কাছ থেকে জ্ঞানলাভ করতেন। কর্মময় জীবনের অবসান ঘটিয়ে ৮২ বছর বয়সে কুকুবুরি ৬৩০ হিজরির ৪ রমজান (১২৩৩ সালের ১৩ জুন) মৃত্যুবরণ করেন। ৫৮৩ থেকে ৬৩০ হিজরি সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৫ বছরের শাসনামলের কোন সময়টিতে তিনি ইদে মিলাদুন্নবীর প্রচলন করেছিলেন তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে, প্রখ্যাত বাঙালি আলেমে দীন মাওলানা মুহাম্মদ বেশারতুল্লাহ মেদিনীপুরী উল্লেখ করেছেন, ৬০৪ হিজরি থেকে কুকুবুরি ইদে মিলাদুন্নবী উদযাপন শুরু করেছিলেন।

ইদে মিলাদুন্নবী প্রচলনের ক্ষেত্রে আরও একজনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি হলেন, মিলাদুন্নবীর ওপর সর্বপ্রথম গ্রন্থ প্রণেতা আল্লামা আবুল খাত্তাব ওমর আবনে হাসান ইবনে দেহিয়া আল কালবি (মৃত্যু: ৬৩৩ হিজরি)। ইদে মিলাদুন্নবী বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করার জন্য কুকুবুরি তাকে ১ হাজার স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করেছিলেন। ৯০ বছরের দীর্ঘ জীবনে তিনি ইসলামি বিশ্বের সর্বত্র ভ্রমণ করেন এবং ইদে মিলাদুন্নবী নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি করেন।

ইদে মিলাদুন্নবীর পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক

কোনো কোনো আলেম হিজরি সপ্তম শতাব্দী অর্থাৎ চালু হওয়ার পর থেকেই ইদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের বিরোধিতা করেছেন এই যুক্তিতে যে, সাহাবিরা, তাবিয়িরা তাদের প্রচণ্ড নবীপ্রেম সত্ত্বেও কখনো তাদের আনন্দ এভাবে উৎসব বা উদযাপনের মাধ্যমে প্রকাশ করেননি। তাই পরবর্তী যুগের মুসলমানদের জন্যও তা শরিয়ত-সংগত হবে না। পরবর্তী যুগের মুসলমানদের উচিত প্রথম যুগের মুসলমানদের মতো সার্বক্ষণিক সুন্নত পালন, সিরাত আলোচনা, দরুদ সালাম ও ক্বলবি ভালোবাসার মাধ্যমে মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানানো, অমুসলিমদের অনুকরণে জন্মদিন পালনের মাধ্যমে নয়।

তাদের যুক্তি হলো-এসব অনুষ্ঠানের প্রসার সাহাবিদের ভালোবাসা, ভক্তি ও আনন্দ প্রকাশের পদ্ধতিকে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসিকতা সৃষ্টি করবে। কারণ যারা এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভালোবাসা ও আনন্দ প্রকাশ করবেন, তাদের মনে হতে থাকবে যে, সাহাবিদের মতো নীরব, অনানুষ্ঠানিক, সার্বক্ষণিক ভালোবাসা ও ভক্তি প্রকাশ পদ্ধতির চেয়ে তাদের পদ্ধতিটাই উত্তম।

সেই যুগের এসব নিষেধকারীদের মধ্যে রয়েছেন সপ্তম-অষ্টম হিজরি শতাব্দীর অন্যতম আলেম আল্লামা তাজুদ্দিন উমর ইবনু আলি আল-ফাকেহানি, আল্লামা আবু আব্দুল্লাহ মুহম্মদ ইবনু মুহম্মদ ইবনুল হাজ্ব, অষ্টম হিজরি শতকের প্রখ্যাত আলেম আবু ইসহাক ইব্রাহিম ইবনু মূসা ইবনু মুহাম্মাদ আশ-শাতিবি (মৃত্যু ৭৯০ হি.)-সহ বেশ কিছু উলামায়ে কেরাম।

অন্যদিকে ইদে মিলাদুন্নবী (স) উদযাপনের পক্ষাবলম্বীরা তাদের মতের সপক্ষে দলিল হিসেবে সুরা আলে ইমরানের ৮১নং আয়াতটি উল্লেখ করেন। এ আয়াতে আল্লাহ্তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘হে প্রিয় রাসুল! আপনি স্মরণ করুন ওইদিনের ঘটনা যখন আল্লাহপাক আম্বিয়ায়ে কিরামদের কাছে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে, তোমাদের কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি, অতঃপর তোমাদের কাছে যা আছে তার প্রত্যয়নকারীরূপে যখন একজন রাসুল আসবেন তখন তোমরা অবশ্যই তার প্রতি ইমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে।’

দলিল হিসেবে তারা সুরা ইউনুসের ৫৭ ও ৫৮নং আয়াতটিও উল্লেখ করেন। এ আয়াতে কারিমায় আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানবকুল! তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং অন্তরসমূহের বিশুদ্ধতা, হেদায়েত এবং রহমত ইমানদারদের জন্য। হে নবী আপনি বলুন, আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তার দয়াপ্রাপ্তিতে তারা যেন আনন্দ প্রকাশ করে। এটা তাদের সব ধনদৌলত সঞ্চয় করা অপেক্ষা শ্রেয়।’

পরিশেষে বলা যায়, ইদে মিলাদুন্নবী উদযাপন নিয়ে এখনো বিতর্ক থাকলেও তা মুসলিমদের মধ্যে কালক্রমে উৎসবে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে এ দিনটি কালক্রমে উৎসবে রূপ নিয়ে প্রতিবছর সাড়ম্বরে পালিত হয় এবং বাংলাদেশসহ কতিপয় মুসলিম দেশে এ দিনটি সরকারি ছুটির দিন।

লেখক: আইনজীবী

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

ইদে মিলাদুন্নবী— ইতিহাস প্রচলন ও বিতর্ক এ জেড এম আব্দুস সবুর ধর্ম ও জীবন ফিচার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর