বঙ্গবন্ধুর ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ সন্ধান
১২ অক্টোবর ২০২২ ১১:৪১
বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার যে ধারণা দিয়েছিলেন, তা পশ্চিমা বিশ্বের ধর্মনিরপেক্ষতার ধরণ থেকে আলাদা ছিল। সেক্যুলারিজম বলতে বঙ্গবন্ধু বুঝিয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িকতা। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়; বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা মানে সমাজে শান্তি বজায় রেখে সবার নিজ নিজ ধর্ম পালন করা, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা, ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করা।
এ কারণেই নোবেলজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম স্পষ্ট সমর্থক, যেখান থেকে বিশ্ব শিখতে পারে। বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের সকল দেশ বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও দর্শন থেকে দিকনির্দেশনা এবং অনুপ্রেরণা নিতে পারে।’ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের সাউথ এশিয়া সেন্টার আয়োজিত এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় এসব কথা বলেছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর দর্শন সম্পর্কে বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ এবং দার্শনিক আরও বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে মানুষের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকবে না, তা বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন না। বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার যে ধারণা দিয়েছিলেন তা ধর্মনিরপেক্ষতার পশ্চিমা সংস্করণ থেকে আলাদা ছিল।’
এদিকে, শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠ করে আমরা অবগত হয়েছি যে, সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন সাচ্চা মুসলমান। কিন্তু অন্য সব ধর্মের প্রতিও তার শ্রদ্ধা ছিল। এ কারণেই একজন যথার্থ বাঙালি ও একজন মুসলমান হওয়ার পথে কোনো দিন তিনি কোনো আত্মদ্বন্দ্বে ভোগেননি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনি ভাষণে ভোটারদের সামনে ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ‘সমতার’ ধারণা তুলে ধরতে দ্বিধা করেননি বঙ্গবন্ধু। সমতাবাদী এই নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগের সেক্যুলার অবস্থান ভোটে জিতে আসতেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
এই নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে শাসনতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য অংশে ইসলাম ও সংখ্যালঘু সম্পর্কে বলা হয়-
ক. জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রিয় ধর্ম হলো ইসলাম। আওয়ামী লীগ এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, শাসনতন্ত্রে সুস্পষ্ট গ্যারান্টি থাকবে যে পবিত্র কোরআন ও সুন্নায় সন্নিবেশিত ইসলামের নির্দেশাবলির পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন বা বলবৎ করা চলবে না। শাসনতন্ত্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পবিত্রতা রক্ষার গ্যারান্টি সন্নিবেশিত হবে। সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য পর্যাপ্ত বিধিব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
খ. সংখ্যালঘুরা আইনের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ সমান অধিকার ভোগ করবে। নিজেদের ধর্ম পালন ও প্রচার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা এবং নিজ নিজ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের ব্যাপারে সংখ্যালঘুদের অধিকার শাসনতান্ত্রিকভাবে রক্ষা করা হবে। স্বীয় ধর্ম ছাড়া অন্য যেকোনো ধর্ম প্রচারের জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তিকে কর দিতে বাধ্য করা হবে না। নিজ ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হলে কোনো ব্যক্তিকে ধর্ম সম্পর্কীয় কোনো নির্দেশ গ্রহণ অথবা কোনো ধর্মীয় উপাসনা বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে জোর করা হবে না। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার এই আদর্শ বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের অন্যতম মৌল স্তম্ভ।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল শোষণহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ভাষণে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা (পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছিল জাতীয়তাবাদ)। ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি ছিল অনিবার্য। ভারতবর্ষের দাঙ্গার অভিজ্ঞতা ছিল বঙ্গবন্ধু। ধর্মের নামে হানাহানির ঘটনা দেখেছেন তিনি। পাকিস্তানি শাসনামলে ধর্মকে সামনে রেখেই পাকিস্তানিরা বাঙালিকে শাসন ও শোষণ করেছে। এ জন্য সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করলেও বঙ্গবন্ধু ধর্মান্ধতাকে ঘৃণা করতেন। ধর্মকে মেনে নিয়ে উদারনৈতিক চিন্তাধারায় অভ্যস্ত হয়েছিলেন তিনি। সব ধর্মের সহাবস্থান এবং বদ্ধ চিন্তার মুক্তিতেই ধর্মনিরপেক্ষতা পূর্ণতা পায়।
১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতে তিনি বলেন, ‘আর হবে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে; মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে; খ্রিস্টান, বৌদ্ধ- যে যার ধর্ম পালন করবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে বাংলার বুকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে, তাহলে বাংলার মানুষ যে তাকে প্রত্যাঘাত করবে, এ আমি বিশ্বাস করি।’
ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসার এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে পাকিস্তান আমলে ইসলামবিরোধী বহু কাজ হয়েছে। রেসের নামে জুয়াখেলা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ছিল, আপনারা আলেম সমাজ কোনোদিন এর প্রতিবাদ করেননি। ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সাহায্যে প্রকাশ্যে জুয়াখেলা চলত, এগুলো বন্ধ করার কোনো আন্দোলন আপনারা করেননি; কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করবার কথা বারবার বলেছেন। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় জুয়া ও মদকে যে হারাম ঘোষণা করতে হয়, সেটা আপনারা জানতেন; কিন্তু আপনারা এগুলোর বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। আমি ক্ষমতায় এসে প্রথমেই ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দিয়েছি, পুলিশকে তৎপর হতে বলেছি শহরের আনাচে-কানাচে থেকে জুয়াড়িদের আড্ডা ভেঙে দিতে। আমি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলি, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্ম বিরোধিতা নয়। আমি মুসলমান, আমি ইসলামকে ভালোবাসি। আপনারা আমাকে সাহায্য করুন, দেখবেন, এ দেশে ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড কখনোই হবে না।’
বঙ্গবন্ধু মূলত ইসলামের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বিধানে অন্য সব ধর্মের সহাবস্থান নিশ্চিত করেছিলেন। প্রথাবদ্ধ, ধর্মশাসিত সংস্কারাচ্ছন্ন জীবন তিনি পছন্দ করেননি। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার জন্য ধর্মের অপব্যবহার রোধ করে প্রগতির পথে অগ্রসর হওয়ার পক্ষে ছিল তার নীতি-আদর্শ। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্র বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত রূপটিকে ধরতে চেয়েছেন তিনি।
১৯৭৫ সালে ধর্ম নিরপেক্ষতার স্বরূপ বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি সংসদে বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি- ধর্মের নামে জুয়াচুরি, শোষণ, অত্যাচার, খুন- এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না।’
ধর্মের দোহাই দিয়ে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তরুণ শেখ মুজিব প্রত্যক্ষ করেছেন পাকিস্তানিদের ভণ্ডামি, সামরিক একনায়কদের খামখেয়ালিপনা, শোষণের শিকার জনতার মুখে স্থায়ী দুঃখের ছাপ। একারণে ধর্মের অপব্যবহার রোধে রাজনীতি থেকে একে আলাদা করে রাখার ব্যাপারে সবসময় কথা বলতেন তিনি। এরপর, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ঘোষিত ইশতেহারে এবং প্রতিটি জনসভায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্প্রীতির রাষ্ট্র গড়ার কথা বলেছেন। বাঙালির হাজার বছরের সম্প্রীতির বন্ধনকে ধর্মের অপব্যবহারের মাধ্যমে কেউ যেন বিভক্ত করতে না পারে, সব ধর্মের লোক মিলে যেন একটা শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলে, সেটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর দর্শন।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি