Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিরে, বুঝিনি তুই এতো ভালোবাসিস’

রহমান মুস্তাফিজ
২৪ অক্টোবর ২০২২ ১৪:৫৫

১৯৯৬ সালে মান্না দে ঢাকা এসেছিলেন ভারত-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক চুক্তি বিনিময়ের অংশ হিসেবে। সাথে ছিলেন শীলা ভার্মা (শীলা’র পূর্ব পুরুষও যথারীতি এপাড় থেকে ওপাড়ে যাওয়া)। তখন আমি বার্তা সংস্থা ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ (ইউএনবি)-এর সদ্য চালু হওয়া বাংলা সার্ভিসে প্রথম রিপোর্টার হিসেব যোগ দিয়েছি। আমার নিউজ এডিটর ১৫ দিন আগেই বলে রাখলেন মান্না দে-র সাক্ষাতকার লাগবে। সে সময়ে ভারতীয় হাই কমিশনের ফিন্যান্স মিনিস্টার মিজ মানজু আর প্রেসের দায়িত্বে থাকা রঞ্জন মন্ডলের সাথে দারুণ সখ্যতা। সেই সুবাদে তাদের সাথে কথা না বলেই অফিসে বলে দিলাম সময় মতো সাক্ষাকতার দেয়া যাবে, চিন্তার কিছু নেই।

বিজ্ঞাপন

প্রথম অনুষ্ঠান হলো ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তনে। মান্না দে একটানা ৫/৬টা গান গাইলেন একাই। শীলা ভার্মা-কে মাইক্রোফোন দিয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিতে গ্রীণ রুমে আসার আগে গাইলেন জনপ্রিয় ‘কফি হাউজের আড্ডা’ গানটি।

তিনি গ্রীন রুমে ঢুকতেই সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ইজি চেয়ারে বসার আগেই প্রশ্ন: নিজের এখনকার কণ্ঠ সম্পর্কে আপনার কোন ধারনা আছে? এমন হেড়ে গলায় গান করেন কেন?

মান্না দে বললেন, আপনি সাংবাদিক? জানেন না কি ভাবে প্রশ্ন করতে হয়? আপনাদের ম্যানার শেখানো হয় না?

উত্তরে বললাম, এসব অবান্তর কথা বাদ দিয়ে বলুন আপনি কফি হাউজের গানটা এমন ভাঙা কণ্ঠে কেন গাইলেন? আপনার লাখ লাখ ভক্ত এ গানের কারণে। ক্যাসেটে তারা আপনার যে কণ্ঠ শোনেন তার কিছুই আজ আর নেই। তারা হতাশ।

এরপর মান্না দে আয়োজকদের ডেকে বললেন আমাকে মিলনায়তন থেকে বের করে দেয়া না হলে তিনি আর গাইবেন না। আমি তাকে আরো ২/৩ মিনিট উত্যক্ত করে চলে এলাম।

পরদিন সকাল ৯টার দিকে ঘুম ভাঙলো রঞ্জন মন্ডলের ফোনে। জানালেন ১১টার সময় মান্না দে বেইলী রোড যাবেন শপিং-এ। আমি তৈরি হয়ে হাজির বেইলি রোডে। টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরে তিনি ঢুকলেন যখন তখন তার মাথায় বিখ্যাত টুপিটা নেই। সেলসম্যানের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, আপনি মাথায় টুপি পরেননি বলে কী মনে করেছেন কেউ আপনাকে মান্না দে বলে চিনতে পারবেন না?

আমার কথায় সেলসম্যানদের ভীড় জমে গেল। আস্তে আস্তে আশপাশের দোকান থেকে শুরু করে পথচারিদের ভিড় জমে গেল। তার আর শপিং করা হলো না। তিনি রেগে গেলেন। আবারও বেশ বকাঝকা করলেন। এর ফাঁকে তাকে রাগাতে আরো কিছু কথা বললাম। তিনিও ক্ষেপে সমানে পাল্টা কথা বলতে লাগলেন।

বিজ্ঞাপন

সেদিন বিকালেই গেলেন বঙ্গ বাজারে। বেইলি রোডের ঘটনার পুনরাবৃত্তি সেখানেও। শপিং করা হলো না তার।

পরদিন সকালে তার হোটেলে হাজির হলাম। হোটেল পূর্বানী’র সিকিউরিটি সমস্যা করলো না রঞ্জন মন্ডলের বদন্যতায়। বলে রাখা ভালো, আমার সে সময়কার কাজের স্টাইলটা রঞ্জন মন্ডল বেশ উপভোগ করতেন বলে তার সাহায্যের হাত সব সময়ই বাড়ানো থাকতো আমার দিকে। হোটেলে বিনা অনুমতিতেই তার রুমে যেয়ে প্রথমেই প্রশ্ন, আপনার মতো একজন ব্যক্তিত্বের এমন অভদ্র আচরণ মানুষকে ব্যথিত করে, এটা আপনি বোঝেন, নাকি সে বোধটুকুও আপনার নেই? আক্ষরিক অর্থেই তিনি আমাকে ধাক্কিয়ে রুম থেকে বের করে দিলেন। রুম থেকে বের করতে করতে বললেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তার আবেগের কথা। সেই বাংলাদেশের একজন ‘অসভ্য সাংবাদিক’র কাছ থেকে তিনি বাকি কয়েকটা দিন রেহাই চান।

রাতে রওনা হলাম চট্টগ্রামে। পরদিন মান্না দে’র অনুষ্ঠান সেখানে। সকালে আমাকে হোটেল আগ্রাবাদের লবিতে দেখে নিজেই এগিয়ে এলেন। স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নিলেন ম্যানার শেখানোর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত সাংবাদিকরা তার সাথে কেমন ব্যবহার করেছেন সেগুলো জানালেন। সবশেষে হুমকি দিলেন, তাকে যদি আবার বিরক্ত করার চেষ্টা করি তাহলে আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন।

এদিকে মান্না দে’র সাক্ষাতকারের কপি হাতে না পেয়ে বিরক্ত বার্তা সম্পাদক। শিফট ইনচার্জ শান্তণু চৌধুরী বার্তা সম্পাদক জহুরুল ইসলাম টুকু ভাইকে বুঝিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করছেন। সে সময় কালচারাল বিটে আর যারা কাজ করতেন (ইত্তেফাকে রেজানুর রহমান, জনকণ্ঠে আশীষউর রহমান শুভ, সংবাদে মাহবুব মতিন, আজকের কাগজে নৃপেণ সরকার, দিনকালে মাহমুদা চৌধুরী… নেতিবাচক শব্দে হলেও পজেটিভ অর্থে বলা যায় আমাদের এ কয়জনের সিন্ডিকেটটা বেশ জোরালো ছিল) তারা কেউ না পারলেও আমি ঠিকই সাক্ষাতকার নিতে পারবো বলে শান্তণু দা বিশ্বাস করতেন।

ঢাকায় ফেরার পরদিন আমি সাক্ষাতকারটা (ন্যারেশন আকারে ছিল) কম্পোজে দিলাম। পরদিন বেশ কয়েকটি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাতেই বক্স আকারে ছাপলো সেটি। সেদিন বিকেলেই মান্না দে দিল্লী রওনা হবেন।

সকাল ৭টা কি সাড়ে ৭টার দিকে রঞ্জন মণ্ডল ফোন করলেন। বললেন, এক্ষুনি পূর্বানীতে যান, মান্না জী আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

আধঘন্টার মধ্যে হাজির হলাম হোটেলে। রুমের দরজায় নক করতেই বেরিয়ে এলেন মান্না দে। দু’চোখ জুড়ে টলমল করছে পানি। জড়িয়ে ধরলেন বুকে। সরাসরি তুই করে বললেন- তোর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছিরে, তখন বুঝিনি তুই আমাকে এতো ভালোবাসিস। এরপর অনেক কথা। এক সাথে নাস্তা খাওয়া। গল্প করতে করতেই বললেন, সবাই প্রশংসা করে সাক্ষাতকার ছাপায়, কেউ নিন্দে করে। এর আগে কেউ আসল মান্না দে-কে খোঁজার চেষ্টা করেনি।

ফেরার আগে আমি তার সাথে উল্টো পাল্টা প্রশ্ন আর বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাইলাম। মাথায় ঘাড়ে গাট্টা মেরে বললেন, এমন অসভ্যতা তার সাথে আগে কেউ করেনি, আবার এমন সাক্ষাতকার দেয়ার অভিজ্ঞতাও তার হয়নি কখনও। তিনি আমার কাছ থেকে এমন অসভ্যতা বারবার আশা করেন। দিল্লী গিয়ে চমৎকার একটা ধুতি পাঠিয়েছিলেন মান্না দে, আমার জীবনের সেরা উপহারগুলোর একটি সেই ধুতি।

* * *
মান্না দে ছিল তার পোষাকি নাম। প্রকৃত নাম প্রবোধ চন্দ্র দে। ১৯১৯ সালের পয়লা মে তিনি জন্মগ্রহণ করেন কোলকাতায়। প্রায় ৪ হাজার গানে কণ্ঠ দেন তিনি। বাংলা, হিন্দি, অহমিয়া, মারাঠি ও গুজরাটিসহ প্রায় ২৪টি ভাষায় তিনি গান গেয়েছেন।

ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী (১৯৭১), পদ্মবিভূষণ (২০০৫) ও দাদাসাহেব ফালকে (২০০৭) সম্মাননায় ভূষিত করে। ২০১১ সালে পশ্চিম বাংলা সরকার রাজ্যের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান বঙ্গবিভূষণ প্রদান করে।

২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি যাত্রা করেন অনন্তলোকে। তার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

চীরঞ্জীব মান্না দে- লাল সালাম।

লেখক: সাংবাদিক, গবেষক ও নির্মাতা

সারাবাংলা/এএসজি

মান্না দে রহমান মুস্তাফিজ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর