বঙ্গোপসাগরের আকৃতির কারণেই কি ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা?
২৪ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৪৪
বছরের পর বছর ধরে বঙ্গোপসাগরের সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ে ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমারসহ এ অঞ্চল প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে। একের পর এক ভয়ংকর সব ঘূর্ণিঝড়ের কারণেই একটি সাধারণ প্রশ্ন এমনিতেই মাথায় আসে— বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়গুলো কি অন্য অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে বেশি মারাত্মক? অথবা বঙ্গোপসাগরের আকৃতিই কি একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের কারণ?
আবহাওয়াবিদরা জানাচ্ছেন, বিশ্বের ইতিহাসে যে ১০টি ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী, তার আটটিরই উৎপত্তি বঙ্গোপসাগরে। যে ৩৬টি মারাত্মক ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের রেকর্ড রাখা সম্ভব হয়েছে, তার ২৬টিও এই অঞ্চলেরই। অথচ বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া মোট সাইক্লোনের মাত্র ৪ শতাংশের উৎপত্তি এখানে। আর এই অঞ্চলটি বিশ্বের মোট সমুদ্র অঞ্চলের মাত্র শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। শুধু তাই নয়, ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতার মতো ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে প্রতি পাঁচ জনের চার জনই এখানকার।
আরেকটি তথ্য বলছে, গত দুই শতাব্দীতে পৃথিবীর ট্রপিক্যাল সাইক্লোন সম্পর্কিত যত মৃত্যু ঘটেছে, তার ৪২ শতাংশ হয়েছে কেবল বাংলাদেশে। সংখ্যায় এর পরিমাণ প্রায় ২০ লাখ। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ যে সাইক্লোন, সেটিও বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলেই আঘাত হেনেছিল। ১৯৭০ সালের ভোলা সাইক্লোন নামে পরিচিত সেই ঘূর্ণিঝড়ে তিন লাখ থেকে পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
পরিবেশ বিপর্যয়সহ নানা কারণে সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে তীরবর্তী দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পৃথিবীতে প্রতিবছর গড়ে ৮০টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। এগুলোর বেশিরভাগ সমুদ্রেই বিলীন হয়। শক্তিশালী যে ঘূর্ণিঝড় উপকূল বা স্থলভাগে আঘাত হানে সেগুলোই ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাস বলছে, সমুদ্র তীরবর্তী বহু দেশ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়
ঘূর্ণিঝড় অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রে ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় হারিকেন, চীনে টাইফুন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাইক্লোন। ইতিহাসের সূত্র ধরে বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশেও বেশ বড় বড় বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এদেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রলয়ংকরী ৫টি ঘূর্ণিঝড়ের দেখা মিলেছে। এসব ঘূর্ণিঝড়ে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
এরমধ্যে ১৯৭০-এর হওয়া ভোলা সাইক্লোন ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। ভোলা সাইক্লোনকে বিশ্ব ইতিহাসের ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম বলা হয়। ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ২০৫ কিলোমিটার বেগে বয়ে যায় এই সাইক্লোন। সেই ঝড়ে প্রাণ হারান অন্তত ৫ লাখ মানুষ, যাদের মধ্যে ১ লাখই ছিল জেলে। বেশির ভাগই জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা যান।
এর আগে ১৮৭৬ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের বরিশালের বাকেরগঞ্জে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল। ভয়াবহ সেই ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল অন্তত ২ লাখ মানুষ। বাতাসের তীব্রতা ছিল ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার, আর সমুদ্রের পানি বয়ে যাচ্ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ২০ ফুট ওপর দিয়ে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। পরে অনাহার ও দুর্ভিক্ষে মারা যায় অসংখ্য মানুষ।
বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালের ২৯ নভেম্বরে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়টি ইতিহাসের অন্যতম বিধ্বংসী। এই ঝড়ের ফলে দেশে যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বন্যা হিসেবে পরিচিত। ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ৫ হাজার ৭০৮ জন মানুষ প্রাণ হারায়। ঝড়ে সেবার প্রায় ৭০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে যায়, যার পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার টন।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের চট্টগ্রাম উপকূলে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে ছোবল হেনেছিল এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। এর ফলে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়। ১ লাখ ৩৮ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল সেই ঘূর্ণিঝড়। সে সময়কার হিসাবে ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের সম্পদের ক্ষতির শিকার হয়েছিল বাংলাদেশ। বাস্তুহারা হয়ে পড়েন ১ কোটিরও বেশি মানুষ।
২০০৮ সালে মিয়ানমারে ঘূর্ণিঝড় নার্গিসের হানাতেও প্রাণ হারান ১ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি মানুষ। প্রায় ১২৯০ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে। প্রাণহানির দিক থেকে এই দুইটি ঘূর্ণিঝড়ই এই এলাকার সবচেয়ে ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়। আর নার্গিস বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছে।
সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণে এই অঞ্চলের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের নাম আম্পান। গত বছরের ২০ মে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানে এই সুপার সাইক্লোনটি। ১৯৯৯ সালের উড়িষ্যা ঘূর্ণিঝড়ের পর এটিই এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। এর আঘাতে ভারত ও বাংলাদেশে ১২৮ জন মারা যান। তবে এর প্রভাবে ১৩৭০ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে ২৬০ কিলোমিটার বেগের বাতাসের সঙ্গে ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস নিয়ে উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় সিডর। ক্যাটাগরি-৫ মাত্রার এই ঝড়ে কমপক্ষে ৩ হাজার ৪৪৭ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায় পরবর্তী সময়ে। তীব্র পানির চাপে পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদের বেড়িবাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ৭০ হাজার ঘরবাড়ি। পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয় ৩৭ হাজার একর জমির ফসল। রেড ক্রিসেন্টসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থাই এই ঘূর্ণিঝড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল। প্রায় ২৩১ কোটি মার্কিন ডলারের সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এই ঘূর্ণিঝড়ে।
প্রাণহানিও বেশি এই অঞ্চলে
আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষকদের তথ্য বলছে, বিশ্বের ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের ২৫ ভাগের মাত্র একভাগের উৎপত্তি বঙ্গোপসাগরীয় এই অঞ্চলে। কিন্তু এই এলাকার ঘূর্ণিঝড়গুলো ভয়াবহতার মাত্রায় অনেক এগিয়ে। প্রাণহানিও এই এলাকায় অনেক বেশি।
ভারতের ট্রপিক্যাল মেটেরোলজি ইনস্টিটিউটের জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. রক্সি ম্যাথিও কল বলেন, বিশ্বের ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়গুলোর মাত্র ৪ শতাংশের উৎপত্তি বঙ্গোপসাগরে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বিশ্বে যত মৃত্যু ঘটেছে, তার ৮০ শতাংশই হয়েছে এই অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়গুলোর কারণে। এখানে ভৌগলিক ও আর্থসামাজিক কারণগুলো অনেক বেশি ভূমিকা রাখলেও সমুদ্রের উষ্ণায়ন বিজ্ঞানীদের মধ্যে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
আকৃতির কারণেই কি বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ে এত মানুষের মৃত্যুর একটি কারণ হতে পারে এখানকার সাগরের ত্রিকোণাকার আকৃতি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই আকৃতি ফানেলের মতো কাজ করে এবং ঝড়কে অনেক বেশি স্ফীত করে তোলে। তার ওপর সাগরের অগভীর তলদেশের কারণে এর মাত্রা আরও তীব্র হয়। ফলে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলগুলো প্রায়ই ডুবে যায়। বেশিরভাগ ঝড়ের কারণে প্রবল বাতাস, ভারী বৃষ্টিপাত এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়। এসব কারণে এ অঞ্চলে অনেক বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোন ও ঝড় সৃষ্টির হারও বেশি। এর পেছনে দু’টি উল্লেখযোগ্য প্রভাবক হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা। এটি আবার বর্ষার আগে ও পরের জন্য বেশ অনুকূল। তবে বঙ্গোপসাগরের চারপাশে বাতাসের গতি খুব কম থাকার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে ২৮ থেকে ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়।
ঘূর্ণিঝড়ে বেশি মানুষের মৃত্যুর পেছনে আরেকটি কারণ হলো এ অঞ্চলের জনসংখ্যার ঘনত্ব। এখানে এর পরিমাণ অনেক বেশি। কৃষিকাজের কারণে এ অঞ্চলের অনেক মানুষ নিম্নাঞ্চলে বসবাস করে, যা ঘূর্ণিঝড়ের সময় তাদের অনেক বেশি ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। বিশেষ করে আগাম সতর্কবার্তা ও সুযোগ-সুবিধা অপর্যাপ্ত থাকলে এসব মানুষ একেবারে অরক্ষিত হয়ে পড়েন।
ঘূর্ণিঝড় বাড়াচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়নও
ভৌগলিক ও আবহাওয়া সংক্রান্ত কারণ ছাড়াও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়কে আরও বেশি তীব্র করতে সহায়তা করছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড় যা ‘মারাত্মক’ বা ‘তীব্র মারাত্মক’ হিসেবে উল্লেখ করা হতো, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এটি আরও বেশি তীব্র হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কথা বলা যেতে পারে। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এটি সুপার সাইক্লোনে পরিণত হয়, যা একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড় তৈরি করে। সমুদ্রপৃষ্ঠের রেকর্ড ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকেই এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ক্রান্তীয় অঞ্চলের কারণে পৃথিবীর বেশিরভাগ সামুদ্রিক বেসিনের চেয়ে এর তাপমাত্রা বেশি। এ বিষয়ে ড. কল বলেন, উচ্চ তাপমাত্রা ঘূর্ণিঝড় গঠনের জন্য বেশ অনুকূল। কারণ সমুদ্রের গরম পানি থেকেই ঘূর্ণিঝড় তাদের শক্তি সঞ্চয় করে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব বঙ্গোপসাগরেও পড়ছে। প্রতি শূন্য দশমিক ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস মানে হলো সাইক্লোন তৈরি হওয়ার জন্য অতিরিক্ত শক্তি যোগ হওয়া।
দুর্যোগ মোকাবিলায় এখন বাংলাদেশ ও ভারত আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রস্তুত। সাইক্লোন পূর্বাভাস, উপকূলবাসীর মধ্যে ঝুঁকি সচেতনতা এবং দুর্যোগ প্রস্তুতি ও দুর্যোগ পরবর্তী পদক্ষেপে অনেক বেশি উন্নতি হয়েছে। এরপরও বঙ্গোপসাগরে নতুন কোনো ঘূর্ণিঝড় মানেই ভারত-বাংলাদেশের উপকূলবর্তী মানুষের মনে অতীতের দুঃসহ স্মৃতি ফিরে আসা।
সূত্র: দ্য ওয়েদার চ্যানেল ও বিবিসি
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
আকৃতির কারণেই কি বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা? পাঁচমিশেল ফিচার