চট্টগ্রামের মেজবানের ইতিহাস
১৫ নভেম্বর ২০২২ ১৭:০৩
চট্টগ্রাম সমিতি ঢাকার উদ্যেগে আগামী ২৬ নভেম্বর রাজধানীর বুকে বসবাসরত চাটগাঁবাসীদের মেজবান ও মিলনমেলাসহ বর্ণাঢ্য আয়োজন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মোহাম্মদপুর সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ মাঠে। চট্টগ্রামবাসীর পদচারণায় মুখরিত হবে মেজবান ও মিলন মেলা। মেজবান আগত অতিথিদের ভোজনরসদের পাশাপাশি থাকছে গুনীজনদের পদক ও সম্মাননা প্রদান, চট্টগ্রামে ঐতিহ্যবাহী বলীখেলা, দেশের প্রথিতযশা শিল্পীদের সঙ্গীতানুষ্ঠানসহ থাকছে আরও নানা আয়োজন। এবার জানা যাক মেজবানের ইতিকথা:
মেজবান শব্দটি ফারসি। এর অর্থ আপ্যায়ক, অতিথি সৎকারক, আতিথেয়তা, মেহমানদারি বা বিশেষ ভোজের ব্যবস্থা করাকে মেজবান বা মেজবানি বলা হয়। চাটগাঁইয়াদের বহুল জনপ্রিয় ও পরিচিত বিশেষ ভোজনের নাম মেজবান। প্রতিবেশী সমাজের লোকজন ও অতিথি আপ্যায়নকেও মেজবান বলে। মেজবান শব্দটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মেজ্জান হিসেবে প্রচলিত। সহজ কথায় মেহমানদারি বা অতিথিদের জন্য বিশেষ ভোজের ব্যবস্থা করাই হচ্ছে মেজ্জান। চট্টগ্রামে সাধারণত কোনো আচার-অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে মেজবানের আয়োজন করা হয়। যেমন মৃত ব্যক্তির কুলখানি, চেহলাম এবং বার্ষিকী উপলক্ষে ভোজ। এছাড়া আকিকা, খৎনা, গায়ে হলুদ, কিংবা নতুন কোনো ব্যবসা আরম্ভ এবং নতুন বাড়িতে প্রবেশ করলেও কেউ কেউ মেজবানের আয়োজন করে থাকেন।
সমগ্র বাংলাদেশে মেজবানের মাংস দিয়ে আতিথেয়তা চট্টগ্রামের মানুষের সুনাম সর্বজনবিদিত। অন্যান্য জেলার লোকজন যারা একবার মেজবান খেয়েছেন তারা মেজবানের স্বাদ খুব করে মনে রাখেন। অনেকে বলে ‘চাটগাঁইয়া মেজ্জাইন্যা খানা খাইলে বুঝিবা; ন খাইলে পস্তাইবা’। চট্টগ্রামের মানুষ প্রয়াত আত্মীয়স্বজনদের আত্মার শান্তিকামনায় মেজবানের আয়োজন করলেও যোগাযোগ ও অন্যন্যা সুযোগ সুবিধার কথা ভেবে শুষ্ক মৌসুমে বেশির ভাগ মেজবানের আয়োজন করা হয়। বিশেষ করে নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে বেশি মেজবানের আয়োজন হয়। চট্টগ্রামের এই আদি সংস্কৃতি সাম্প্রতিককালে গ্রাম ছাড়িয়ে শহর এলাকাও ছড়িয়ে পড়েছে। বলা যায় চট্টগ্রামবাসীর রক্তের সাথে মিশে আছে মেজবান সংস্কৃতি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পৌঁছে গেছে মেজবানি গোশতের সুঘ্রাণ। বিশেষ করে বিদেশে বসবাসরত চট্টগ্রামের বাসিন্দারাও আজকাল নিজ নিজ অবস্থানস্থলে মেজবানের আয়োজন করেন। মেজবান শব্দটা এখন আমাদেরই বলা যায়। এটা আমাদের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
চট্টগ্রামের মেজবানের উৎপত্তির ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানতে পারি চৌধুরী, খান, মিয়া, ভুঁইয়া বংশের বিশেষ করে বনেদি পরিবারের লোকজন মেজবানের আয়োজন করতেন। তখনকার দিনে নাকি মেজবানের খাবার তালিকায় থাকত নলা বা নেহারির ঝোল বা কাঁজি বা সুরগা, মাশকলাইয়ের ডাল, ভুনা ডাল, লাউ দিয়ে বুটের ডাল, গরু-মহিষ বা ছাগলের ঝাল মাংস। বুটের ডাল বা ছোলার ডাল রান্না করা হয় চর্বি ও হাড় মাংস দিয়ে। অনেকে আবার মাছের আইটেম করতেন। মেজবানি মাংস রান্না করা হয় বাহারি রকমের মসলা দিয়ে। মাংস রান্না হওয়ার সময় মসলাপাতির ঘ্রাণ পেয়ে আশপাশের লোকজন জেনে যায় অমুক বাড়িতে মেজবানের আয়োজন চলছে।
তখনকার দিনে মেজবানী মাংস রান্না হত পিতল, তামার তৈরি বড় বড় পাত্রে। বালতি/মাটির মালশা ভর্তি করে, ডাব্ব মালা (শুকনা নারিকেলের মালা ও বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরী চামচ বিশেষ মাটির সানকি বা কলার পাতায় করে ছনা বুটের ডাল বা নলার হাজি গরুর মাংস পরিবেশ হতো মেহমানরা লাইন করে সারিবদ্ধভাবে বসে এক সাথে মেজবান বিলাস করত। মেজবানে আগত অতিথিরা তৃপ্তিসহকারে খেয়ে দোয়া করতে করতে মেজবান বাড়ি ত্যাগ করতেন। সে সময়ে মেজবানের দাওয়াতে ছিল ভিন্ন রকমের আমেজ। সামাজিক সভার মাধ্যমে, শুক্রবার জুমা মসজিদে বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিংবা মাইকে ঘোষণা দিয়ে মেজবানের দাওয়াত পৌছানো হতো।
কালের বিবর্তনে দাওয়াত প্রক্রিয়ায়ও এসেছে পরিবর্তন । বর্তমান সময়ে দাওযাত কার্ড, মোবাইলের ক্ষুদে বার্তা ইত্যাদির মাধ্যমে মেজবানের দাওয়াত দেয়া হয়ে থাকে।
মেজবানের ইতিহাস জানতে গিয়ে জানা যায়, ১৪শ শতকের পূর্বে চট্টগ্রাম অঞ্চল ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ অধ্যুষিত আরাকান রাজ্যে। বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্যের শুরু হয় সে সময় থেকে। বাংলার সুলতানী আমল থেকেই পর্তুগিজ ছাড়াও আরব কিংবা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু মুসলিম মনীষী এ অঞ্চলে আসতে থাকেন। প্রাচ্যের সৌন্দর্যরাণী চট্টগ্রামে পীর আউলিয়া দরবেশ বিশেষ করে হযরত বায়েজিদ বোস্তামি, বদর শাহ (রাঃ) এদের পাশাপাশি বার আউলিয়া চট্টগ্রামে এসে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। ধর্মপ্রচারকরা পরিবর্তিত নব্য মুসলমানদের নতুন খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে পরিচিত করাতে মেজবান বা গরুর মাংসের মাধ্যমে ভোজের ব্যবস্থা করে সেই সময় থেকে। ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি নব্য মুসলমানদের সবার সঙ্গে পরিচিত করা ও সামাজিক সংহতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে মেজবানের আয়োজন করা হতো।
পনেরশ ও ষোলশ’(১৫০০-১৬০০) শতাব্দীর প্রাচীন পুঁথি সাহিত্যে ‘মেজোয়ানি’ ও ‘ মেজমান’ দুটি শব্দ পাওয়া যায়। মেজোয়ানি অর্থ আপ্যায়নকারী ও মেজমান অর্থ আপ্যায়ন। ১৫০০ শতকের কবি বিজয় গুপ্তের পদ্মপুরাণ কাব্যগ্রন্থে একটি পঙক্তি আছে, ‘কাজীর মেজমান হইলে আগে করে আনে।’ আরেক কবি শাহ বারিদ খানের রচনায় ‘মেজোয়ানি’ শব্দটা পাওয়া যায়। আবার ১৬০০ শতাব্দীর সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ কাব্যগ্রন্থে একটি লাইন রয়েছে, ‘ভালারূপ করিলা বিভার মেজোয়ানি।’ যা বোঝানো হয়েছে ভোজ অর্থে।
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝিতে ত্রিপুরা চাকলা রওশানাবাদ ইসলামাবাদ (বর্তমান চট্টগ্রাম) উত্তর অঞ্চলের শাসক শমসের গাজী তাঁর মা কৈয়ারা বেগমের নামে একটি বড় দিঘি খনন করেন। দিঘি খনন শেষ হলে মাটিয়ালদের (মাটি খননকারী শ্রমিক) খুশি করার জন্য নিজামপুর এলাকার বড় বড় পুকুর থেকে মাছ তুলে বিশেষ ভোজের আয়োজন করেন। গাজীয়ালের জীবনী থেকে আরও জানা যায় যে, কৈয়ারা বেগমের নামে দিঘি খনন করতে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক ৩ মাস ধরে কাজ করেন। এই ১০ হাজার শ্রমিক ছাড়াও গ্রামের অনেক লোককে তিনি পুকুরের মাছ দিয়ে ভোজন করান। এ নিয়ে সেসময় শমসের গাজীর সাথে ইসলামাবাদের নওয়াবী শাসনকর্তার বিরোধ সৃষ্টি হয়। সে বিরোধের জের ধরে শত্রুতা এমনকি যুদ্ধও শুরু হয়। সে সময় যুদ্ধে শমসের গাজী মিরশ্বরাই-র নিজামপুর থেকে কুমিড়া পর্যন্ত দখল করে নেন।
মেজবানের আগের রাতে, যে বাড়িতে মেজবানের আয়োজন হবে সে বাড়িতে আবার সমাজের মান্য গন্য লোকদের নিয়ে শলা পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয়। অনেকে এটাকে আগদতী অনুষ্ঠান বা পান সলাৎ (শলা পরামর্শ সভা) বলে থাকে। পান সলাতে নাস্তার পাশাপাশি পান সুপারি পরিবেশন করা হতো। আগদতি সভায় মেজবানের প্রকৃতি অতিথির সংখ্যা, বাবুর্চি নির্বাচন, খাবারের পদ ও পরিমানসহ পরিবেশনের নানাদিক আলোচনা করে সিন্ধান্ত নেয়া হতো।
রাজধানীতে চট্টগ্রাম সমিতির মেজবান হলো সবচেয়ে বড় আয়োজন। এই মেজবানে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার লোকের জন্য ভোজের আয়োজন করা হয়। মেজবানী অনুষ্ঠানস্থল চাটগাঁইয়াবাসীর মিলন মেলায় পরিণত হয়। এতে ৩০-৩৫টি বিশালাকারের গরু, ৪০টিরও বেশি খাসি এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছ-মুরগী রান্না করা হয়।
মেজবানের আয়োজন খুব ঘটা করে হয়। বড় মেজবান সকাল থেকে শুরু করে দুপুর তিনটা পর্যন্ত চলে। আগের দিন সন্ধ্যায় বা রাতে গরু বা মহিষ জবাই করে সারারাত চলে রন্ধন কাজ। মেজবান বাড়িতে ধুপ ধাপ মাংস কাটার শব্দ হামান দিস্তার টুং টাং মসল্লাপাতি গুড়ো করার শব্দ, শিল পাটায় মসল্লা পেঁয়াজ পিষার শব্দ এবং সু ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে আসত। লাকড়ি ভাঙার টুস টাস শব্দ আগুনের কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়া এক ধরনের উৎসবের আমেজ তৈরি করত।
মেজবানী বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের পাশাপাশি সমাজের সকল শ্রেনির লোকের সমাগম হতো। আগের দিনে সামিয়ানা টাঙিয়ে, মাটিতে চাটাই বিছিয়ে বাড়ির উঠোনে অতিথিদের ভোজন পর্ব চলত। কালের বিবর্তনে এখন মেজবান অনেকখানি বদলে গেছে। আজকাল বেশিরভাগ মেজবানী আয়োজন করা হয় কমিনিউটি সেন্টারে।
মেজবানে এখন আর মাটির সানকি কিংবা নারিকেলে মালার বাটি কিংবা মাটির তৈরি পাত্র দেখা মিলে না। চট্টগ্রামের মেজবানের মাংসের রেসিপি দিয়ে এখন চট্টগ্রাম, ঢাকা ও খুলনা এবং সিলেটে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে মেজবানের মাংস পাওয়া যায়। চট্টগ্রামের নিজস্ব সাংস্কৃতি মেজবান আজ বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বে বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা, কাতার, দুবাই, সওদিআরবসহ যেখানে প্রবাসী চাটগাঁইয়ারা মেজবানের আয়োজন করে থাকে। বলা যায় “মেজবান” শব্দটি আঁরার ।
সারাবাংলা/এজেডএস