লে. আশফির লাশের পকেটে ছিল দুটো পুরি আর একটুকরো হালুয়া
২০ নভেম্বর ২০২২ ১২:১১
‘পাঞ্জাবিগুলা এইভাবে মানুষ মারল? বিনা কারণে, বিনা অপরাধে এতগুলা মানুষ এইভাবে মারা গেল? নো, আই কান্ট টেক ইট এনিমোর, লেটস ফাইট ব্যাক।’ যুদ্ধে যেতে উন্মুখ হয়ে আছে ফতেহ আলীও, কিন্তু কীভাবে কোথায় যাবে। পরিচিত কেউ যাচ্ছে কিনা- জিজ্ঞাসা করছিল সে। চিবিয়ে চিবিয়ে আশফি বলল, ‘বদি, বাদল, বকুল, বাচ্চু সবাই বের হয়ে যাইতেছে যুদ্ধে, আর তুই অখনো বইসা বইসা *** ফালাইতাছস? আরে শালা, বাইর না হইলে ক্যামনে বুঝবি কই যাইতে অইব? আগে বাইর হ।’ আশফির চোখ দিয়ে রীতিমতো আগুন ঝরছে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ঠিক এভাবেই বন্ধু, সহযোদ্ধা ক্র্যাকপ্লাটুনের গেরিলা ফতেহ আলী চৌধুরীকে কথার ধাক্কা দিয়েছিলেন আশফাকুস সামাদ আশফি। আশফির কথায় বোধহয় বারুদ মেশানো ছিল। তাই কয়েকদিন পরেই ফতেহ, মায়া (মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীর বিক্রম), গাজী (গাজী গোলাম দস্তগীর, বীর উত্তম), সিরাজসহ ছয়-সাতজন গেরিলা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিলেন। ওদিকে ২৭ মার্চ ঢাকায় কারফিউ ওঠার পর সকালেই বের হয়ে গিয়েছিলেন আশফাকুস সামাদ আশফি, বদিউল আলম, শহিদুল্লাহ খান বাদল আর মাসুদ। ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাম্পের খবর পেয়ে তারা আগরতলা হয়ে চলে যায় মতিনগর। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ওয়ার কোর্সে যোগ দেওয়া আশফি ছিল প্রথম ট্রেইনড ব্যাচের একজন মুক্তিযোদ্ধা! ট্রেনিং শেষ করার পর লেফট্যানেন্ট হিসেবে পদোন্নতি পায় আশফি। তাকে পাঠানো হয় সেক্টর ৬-এর সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে! কে ছিলেন এই লে. আশফি?
শহীদ লেফট্যানেন্ট আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ বীরউত্তম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর ৬-এর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার ডাকনাম ছিল নিশরাত। বাসায় সবাই ডাকতো তানি নামে। কিন্তু কাছের বন্ধুদের কাছে সেই নিশরাতই পরিচিত ছিল আশফি নামে। তার জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার সতেরো দরিয়া গ্রামে। আশফির বাবার নাম আ ম আজিমুস সামাদ এবং মায়ের নাম সাদেকা সামাদ। আবু মঈন আশফাকুস সামাদ ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে পড়তেন। থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রশিক্ষণ শেষে ৯ অক্টোবর কমিশন লাভ করে পোস্টিং পান ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগন্জ সাব-সেক্টরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী আশফি ভারতের মুর্তিতে ট্রেনিং নিতে যাওয়ার পর তাকে সবাই সামাদ নামেই চেনে। সহযোদ্ধা খোন্দকার নুরন্নবীকে প্রায়ই হাসতে হাসতে আশফি বলত, ‘কবে যেন খরচা হয়ে যাই ভাই!’ নুরুন্নবী অবাক হতেন। পাকিস্তানিদের প্রবল আক্রমণের মুখে দেশের ভেতর টিকতে পারছে না মুক্তিযোদ্ধারা। তাই দুই বছরের আর্মি ট্রেনিং নিতে হচ্ছে মাত্র তিন মাসে। পরিশ্রমটাও তিনগুণের বেশি। নুরুন্নবী ভাবেন ট্রেনিংয়ের প্রচণ্ড কষ্টেই সম্ভবত আশফির এই মতিবিভ্রম!
কিন্তু আশফির সেই হাসতে হাসতে বলা কথাটা যে মোটেও মতিবিভ্রম ছিল না, সেটা প্রমাণিত হয় ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর। প্রতিদিনই মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে অসীম সাহস নিয়ে একের পর এক অভিযান চালিয়ে যাওয়া লেফট্যানেন্ট আশফি ও লেফট্যানেন্ট আব্দুল্লাহর দুটো দল রায়গঞ্জের (কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার অন্তর্গত) দখল নিতে এগিয়ে যাচ্ছিল মধ্যরাতে। অগ্রাভিযান (Advance to Contact) যখন ভুরুঙ্গামারী থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে রায়গঞ্জে ‘ফুলকুমার’ নদীর ব্রিজের ওপর পৌঁছে, তখন হঠাৎ করেই তাদের পাকিস্তানিদের ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি শক্তিশালী দলের মুখোমুখি হতে হয়। পাকিস্তানীদের আচমকা গুলিবর্ষণে জিপে থাকা বিএসএফ-এর মেজর জেমস ও দুই সৈনিক নিহত হন। রাতের অন্ধকারে আশফি তখন ছেলেদের ডিপ্লয়মেন্টে ব্যস্ত।
এই ঘটনার বিবরণ আছে সহযোদ্ধা মুসা সাদিকের লেখায়। তিনি লিখেছেন- ‘লে. সামাদ আর লে. আবদুল্লাহ ২৫ মাইল রেঞ্জের ওয়্যারলেস হাতে দুই গ্রুপ কমান্ডো নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি দখলের জন্য। সবার হাতে একটা করে স্টেন আর কিছু গ্রেনেড। রায়গঞ্জে অবস্থিত ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে লক্ষ্য করে দুই গ্রুপ দুই দিক থেকে যাত্রা করে। জাঙ্গল সু পায়ে, চাদর গায়ে জড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাত নয়টার দিকে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়েন। সোয়া এক ঘণ্টা যাত্রার পর রায়গঞ্জ ব্রিজের কাছে পৌঁছে লে. সামাদ হঠাৎই দেখতে পান তার গ্রুপের সবাই ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ট্র্যাপে পড়ে গেছেন। তিনি বুঝলেন ভুল রেকি হয়েছে। রায়গঞ্জ ব্রিজের নিচে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এলএমজি বাঙ্কার রয়েছে এ খবর তিনি পাননি। সংকেত দিয়ে তিনি সবাইকে শুয়ে পড়তে বললেন।
শুরু হয়ে গেল ক্রস ফায়ারিং। সেইসঙ্গে পাকিস্তানি সেনারা তাদের ওপর আর্টিলারি ও ৩ ইঞ্চি মর্টার চালাতে লাগল। বীর সামাদ বললেন, ‘কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না। মরলে সবাই মরব। বাঁচলে একসঙ্গেই বাঁচব।’ শুরু হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-মৃত্যুর লড়াই। অনেক শক্তিশালী ও দক্ষ এবং ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ২৫ পাঞ্জাব বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে বাংলার তরুণ বীররা ফুলের মতো ঝরে পড়তে লাগল। কিন্তু কেউ সামাদের আদেশ অমান্য করেনি। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে থেকে মুহুর্মুহু মর্টার শেল ও বুলেটের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা কেউ এতটুকু দমেনি। নিজের শেষ বুলেটটি শত্রুর প্রতি নিক্ষেপ করে নিজে শহীদ হয়েছেন। আমাদের ১৫ থেকে ২০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেদিন ২৫ পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে যে অসম সাহস ও বীরত্ব নিয়ে লড়াই করেছে, পৃথিবীর যেকোনো বীরত্বব্যঞ্জক লড়াইয়ের সঙ্গে তার তুলনা হতে পারে।’
হ্যাঁ, সিনেমার কল্পকাহিনীতে এমন দুঃসাহসী অভিযান হয়তো অনেকবারই দেখেছি আমরা। কিন্তু ২০ নভেম্বর দিবাগত মধ্যরাতে আশফির নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মৃত্যুমুখেও লড়ে গিয়েছিলেন অসামান্য দৃঢ়তায়! একটি মাইন বিস্ফোরণের শব্দে পাকিস্তানীরা সজাগ হয়ে গিয়েছিল, শুরু হয়েছিল আশফির দলের ওপর তীব্র মেশিনগান ফায়ার ও গোলাবর্ষণ। কতটা অকুতোভয় দুঃসাহসী কমান্ডার হলে তখন সে বলতে পারে ‘কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না। মরলে সবাই মরব। বাঁচলে একসঙ্গেই বাঁচব।’ আমরা কি এখন এই সময়ে বসে কল্পনাও করতে পারি সেই বীরত্বটুকু?
ওদিকে সময়ের সাথে বাড়তে থাকে পাকিস্তানিদের আক্রমণের তীব্রতা, সেইসঙ্গে বাড়ে আহতদের পাল্লাও। আশফাকুস সামাদ নির্দেশ দেন তার দলকে পিছু হঠবার। কিন্তু নিজে পড়ে রইলেন সামনে, একটি বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে হালকা মেশিনগান নিয়ে কাভারিং ফায়ারের লক্ষ্যে। এরই মধ্যে তিনি ওয়্যারলেসের মাধ্যমে আর্টিলারি সহযোগিতাও চান মিত্রবাহিনীর কাছে। সামাদের কাভারিং ফায়ারে তার দল নিরাপদে পিছিয়ে গেলেও তিনি পড়ে থাকেন পাকিস্তানিদের সামনে। একের পর এক আক্রমণ আসতে থাকে তার দিকে। এভাবেই একা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল বিক্রমে লড়ে গেলেন বিশ মিনিট। প্রচণ্ড গোলাগুলির এক পর্যায়ে হঠাৎ একটি গুলি আশফির হেলমেটের মধ্য দিয়ে ঢুকে মাথা ভেদ করে গলা দিয়ে পেটে গিয়ে নাড়িভুড়িতে আটকে যায়। এরপর সে মাটিতে পড়ে যায়। মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরেও বেঁচে ছিলেন আশফি। চিৎকার করতে থাকেন পানি, পানি বলে। তার রানার মাহাবুব হোসেন প্রিয় স্যারের দিকে পানির একটি পাত্র নিয়ে যেতে চাইলে গুলি লাগে তার পায়েও। আশফির আর পানি পান করা হয় না। মৃত্যুর আগে এভাবেই পানি না পেয়ে স্বাধীনতার চেতনায় তৃষ্ণার্ত সামাদ পানির তৃষ্ণা নিয়েই দেশের মাটিতে ঢলে পড়েন। বেঁচে যায় তার দল। কিন্তু ইতিহাস হন সামাদ। যত সহজে তিনি বলতেন ‘খরচা’ হয়ে যাবেন, ঠিক তত সহজেই দেশের জন্য খরচ হয়ে যান তিনি।
সেদিন ছিল ঈদের দিন। আগের রাতেই সকালের নাস্তা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মৃতদেহ উদ্ধারের সময় আশফির পকেটে পাওয়া যায় দুটো পুরি এবং একটুকরো হালুয়া। ঈদের দিনের সকালের নাস্তা ছিল সেগুলো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান খুব কাছাকাছি থাকায় ওইদিন তার মৃতদেহ উদ্ধার করা যায়নি। পরে ২০ নভেম্বর দিনের বেলায় তার মৃতদেহ উদ্ধার করে ভূরুঙ্গামারীর জয়মনিরহাট মসজিদের সামনে যথাযোগ্য মর্যাদায় একই যুদ্ধে শহীদ সহযোদ্ধা সহোদর আলী হোসেন, আবুল হোসেন এবং আব্দুল আজিজকে সমাহিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে জয়মনিরহাটের নাম রাখা হয় সামাদনগর।
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ আবু মঈন মো. আশফাকুস সামাদকে মরণোত্তর বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বসূচক নম্বর ২৮। গেজেটে তার নাম আবু মঈন মো. সামাদ। তার আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে তার স্মরণে রংপুর সেনানিবাসে ‘বীর উত্তম শহীদ সামাদ উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে। স্রেফ এটুকুই! এরপর গত ৪৮ বছরেও তার নামে হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। তাকে স্মরণ করবার ও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ।
যে দেশের স্বাধীনতা আনতে অতি সহজে ‘খরচা’ হয়ে গিয়েছিলেন আশফির মত অমিত সাহসী যোদ্ধা; মরার আগে এক চুমুক পানিও জোটেনি তার কপালে; তৃষ্ণায় ধুঁকে ধুঁকে এই মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন আশফি। সেই দেশে শহীদ লে. আশফির তাজা রক্তে সিক্ত এই জমিনে আজও পাকিস্তানপ্রেমী পাওয়া যায়; পাকিস্তানের পতাকা গালে এঁকে, বুকে জড়ায় কিছু মানুষ। ‘রাজাকার’ পরিচয়কে গ্লোরিফাই করা হয়, নিজামী-মুজাহিদ-সাইদী-গোলাম আজমের মত আলবদরদের বেঈমান নরপিশাচদের ইসলামী নেতা পরিচয় দিয়ে তাদের নিষ্পাপ দাবি করা হয়। তাদের পৈশাচিক নৃশংস মানবতাবিরোধী অপরাধকে ‘হিন্দুস্তানি প্রোপাগান্ডা’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। আর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকাশ্যে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অজুহাতে ট্রল করা হয়, তাদের নিয়ে হাসি-তামাশা করা সংখ্যাগরিষ্ঠদের ‘ক্যুলনেস’ হিসেবে বিবেচিত হয়। আবার কেউ এই ট্রলের প্রতিবাদ করলে তাকে ঝাঁঝরা করে ফেলা হয় নির্লজ্জ নোংরামিতে। ৪৮ বছর পরের এই বাংলাদেশ রাজাকার আল বদরদের দাপট দেখে, তাদের সম্মান পাওয়া দেখে, একাত্তরের আলবদর নরপিশাচের দল জামায়াতে ইসলামকে এখনও দেশের অসংখ্য ভদ্র, শিক্ষিত, সুশীল ও নিরপেক্ষ জনতা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের মর্যাদা দিতে দেখে। আর তখন বেঁচে যাওয়া এবং ধীরে ধীরে বিস্মৃত হতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের বুক চিরে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে!
তথ্যসূত্র: ফতেহ আলী চৌধুরীর সাক্ষাৎকার http://egiye-cholo.com/fateh-khaled-hayder
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ফিচার মুক্তিযুদ্ধ রহমান রা'আদ লে. আশফির লাশের পকেটে ছিল দুটো পুরি আর একটুকরো হালুয়া