জাতীয় সংগীতের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে
২৭ নভেম্বর ২০২২ ১৬:০০
জাতীয়তাবাদ প্রকাশের অন্যতম ও সেরা মাধ্যম জাতীয় সংগীত। জাতীয় সঙ্গীত রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃত একটি গান মনে হলেও এটিকে শুধু গান বলে আখ্যায়িত করলে ভুল হবে।এটি একটি দেশকে গোটা বিশ্বের কাছে উপস্থাপনের অন্যতম মাধ্যম। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে এই সঙ্গীত বাজানো হয়। জাতীয় সঙ্গীতে একটি জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা ও গৌরবের প্রতিফলন ঘটায়।কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো জাতীয় সঙ্গীত বাজানো কিংবা গাওয়ার ক্ষেত্রে কতটা সচেতন আমরা! দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা অনেকেই জাতীয় সংগীত গাওয়ার শুদ্ধ ও সঠিক নিয়ম সম্পর্কে জানি না। কখন, কোথায়, কীভাবে এবং কতটুকু গাইতে বা বাজাতে হবে সে বিষয়ে অনেকেই জানেন না।
আসুন আজকে এই বিষয় নিয়ে সামান্য আলোকপাত করা যাক_
জাতীয় সংগীতের ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখি ১৫৬৮ সাল থেকে ১৫৭২ সালের মধ্যে রচিত নেদারল্যান্ডসের জাতীয় সঙ্গীত ভিলহেলমাসকে সবচেয়ে পুরাতন জাতীয় সঙ্গীত ধরা হয়ে থাকে। যদিও ১৯৩২ সালে সরকারী ভাবে স্বীকৃতি পায় এই জাতীয় সঙ্গীত। এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে পুরানো জাতীয় সঙ্গীত হল জাপানের জাতীয় সঙ্গীত কিমিগায়ো। এটি রচিত হয়েছিল ৭৯৪ সাল থেকে ১১৮৫ সালের মধ্যে। কবিতা ভিত্তিক এই রচনা ১৮৮০ সালের পরে জাপানের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয় সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রে দুর্লভ সম্মানের অধিকারী। তিনি একই সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ও ভারতের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা।
২৫ লাইন গানের দশ লাইনকে জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও সব অনুষ্ঠানে পুরো সংগীত বাজানোর নিয়ম নেই। জাতীয় সংগীত কখন, কোথায়, কীভাবে এবং কতটুকু গাইতে ও বাজাতে হবে সে বিষয়ে ১৯৭৮ সালে ‘জাতীয় সংগীত বিধিমালা-১৯৭৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই বিধিতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন জাতীয় দিবস, যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের শুরুতে ও শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ সংগীত বাজাতে হবে। তবে এসব দিবসের প্যারেড অনুষ্ঠানে দুই লাইন শুরুতে বাজানোর নিয়ম রয়েছে। রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে সংসদ ভবনে প্রবেশের শুরুতে এবং ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ জাতীয় সংগীত বাজাতে হবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের প্রথম দুই লাইন তাঁদের আগমন ও প্রস্থানের সময় বাজানোর কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি যখন কোনো প্যারেডে সালাম গ্রহণ করেন, তখনো দুই লাইন বাজাতে হয়। রাষ্ট্রপতি যদি কোনো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হন বা কোনো অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন অথবা প্রধানমন্ত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে স্বাধীনতা পদক প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন তাহলে এসব ক্ষেত্রে তাদের আগমন ও প্রস্থানের সময় দুই লাইন সংগীত বাজানোর নিয়ম রয়েছে। বিদেশীকোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধান তার রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সফরে বাংলাদেশে এলে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করার আগে জাতীয় সংগীতের প্রথম দুই লাইন বাজাতে হবে। কোনো বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধান, রাজপরিবারের সদস্য, রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার বা সমমর্যাদার কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতিনিধি যখন রাষ্ট্রপতির সালাম গ্রহণ করেন, তখনো দুই লাইন বাজবে।
বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী কোনো মিশন যদি কোনো অনুষ্ঠানে সে দেশের জাতীয় সংগীত বাজাতে চায় তবে তার জন্য পররাষ্ট্র দপ্তরের পূর্বানুমোদন লাগবে এবং যদি অনুমোদন দেয়া হয় তবে সেই দেশের জাতীয় সংগীতের আগে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজাবে। যখন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশী কোনো রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে তার পরিচয়পত্র হস্তান্তরের সময় গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন, তখনো দুই লাইন বাজাতে হয়। সিনেমা প্রদর্শনের আগে ও রেডিও-টেলিভিশনের দিনের অনুষ্ঠানের শেষেও দুই লাইন বাজানো হয়। রাষ্ট্রীয় কোনো অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে শবদাহ বা দাফন করার পরও দুই লাইন ড্রামের তালে বাজানো হয়। বিধিতে বলা হয়েছে, বিদ্যালয়ের দিনের কার্যক্রম জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হবে। অনেক অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের চার লাইন গাওয়া হয়, কিন্তু বিষয়টি ভুল।
এতো সব আইনকানুনের পরও দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় সঙ্গীতকে অবমাননা করা হয়েছে। আমরা প্রায় দেখি যত্রতত্র জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হচ্ছে।যেখানে কিনা মানুষ জাতীয় সঙ্গীতের জন্য অপ্রস্তুত। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় আমাদের দেশের খুবই কম সংখ্যক মানুষ জাতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে সচেতন এবং বেশীর ভাগ মানুষই জাতীয় সঙ্গীত শুদ্ধ ও সুন্দর করে গাইতে পারে না। আবার অনেক অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত পুরো গাওয়া হয় না সময় সল্পতার কারন দেখিয়ে। অথচ বিধিতে স্পষ্টভাবে বলা আছে, যদি কোনো অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় তবে তার সবটুকুই গাইতে হবে। জাতীয় সংগীত শুধু গাইলেই হবে না, তা শুদ্ধ করে গাইতে হবে এবং গাওয়ার সময় এর প্রতি যথাযথ সম্মানও দেখাতে হবে। যখন কোনো অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় জাতীয় সংগীত বাজানো হয়, তখন প্যারেড কমান্ডিং অফিসারের অর্ডারের অধীন ব্যতীত অন্যসব অফিসার ও নন-কমিশন্ড অফিসার ও ছাত্র জাতীয় সংগীতের প্রথম নোট থেকে শেষনোট বাজানো পর্যন্ত স্যালুট করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। জাতীয় পতাকার দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে। কারো মাথায় টুপি থাকলে খুলে ফেলতে হবে।যদি কেউ এসব নিয়ম ভঙ্গ করে তবে তিনি এক বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে জাতীয় সঙ্গীতের সকল নিয়ম জানা এবং সঠিকভাবে মানা নৈতিক দায়িত্ব। এই জন্য আমাদের সবাইকে জাতীয় সঙ্গীত শুদ্ধ ভাবে শেখা ও চর্চার মনযোগী হতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে যথাযথ আইন মেনে জাতীয় সঙ্গীত বাজাতে হবে। যত্রতত্র জাতীয় সঙ্গীত বাজানো এবং গাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সর্বোপরি সবাইকে জাতীয় সঙ্গীতের আইনকানুন ও সবকিছু সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পরবর্তী প্রজন্মকে জাতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে সঠিক ধারণা প্রদান করতে হবে। তাহলেই আগামী দিনের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
জাতীয় সংগীত জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে পাঁচমিশেল ফিচার মোহাম্মদ নাদের হোসেন ভূঁইয়া