এক শহীদ জায়া ও তার সন্তানদের অনন্য জীবনসংগ্রাম ও সাফল্য
৮ ডিসেম্বর ২০২২ ১৮:৫৯
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন বাঙালির জীবনে এক শ্রেষ্ঠতম দিন। কিন্তু হাজার হাজার পরিবারে বিজয় আনন্দ নয় বরং প্রিয়জনকে হারানোর বিষাদের বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছিল। শহীদের তালিকায় ছিল অনেকের বাবা, ভাই, মা, বোনের মত পরিবারের সদস্য। এমন নিকটজনদের হারিয়ে তাদের পক্ষে বিজয়ের আনন্দ উদযাপন করা সম্ভব হয়নি। কোন কোন পরিবার উপার্জনক্ষম প্রধান কর্তা ব্যক্তিটিকেই হারিয়ে এক নতুন জীবনযুদ্ধে সামিল হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। তাদের জীবনযুদ্ধ এতটাই ট্রাজিক যা মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। মুক্তিযুদ্ধে যেমন আমরা বিজয় অর্জন করেছি তেমনি এমন কিছু জীবন আছে যা জীবনযুদ্ধেও জয়ী হয়েছে। আবার একথাও সত্য বহু সম্ভাবনাময় জীবন কালের গর্ভে হারিয়েও গেছে। মুক্তিযুদ্ধ যে কতটা ত্যাগের তা কিছু কিছু জীবনের গল্প শুনলে চোখের জ্বলে ভাসতে হয়। এমন এক পরিবারের গল্প শুনে আমি নিজে চোখের জ্বলে ভেসেছি। আজকে তেমনই এক শহীদ জায়া এবং তার সন্তানদের অনন্য জীবনসংগ্রাম ও সাফল্যের কথা আপনাদের শোনাতে চাই।
শহীদ জায়া ও রত্নগরভা মা অধ্যাপিকা রহিমা খাতুন দীর্ঘদিন লালমাটিয়া মহিলা কলেজে অধ্যাপনা করে অবসর জীবনযাপন করছেন। ১৯৪৩ সালের ১২ এপ্রিল উত্তরের জেলা পাবনার ইশ্বরদীর পাকশীতে পিতা মো. মোজাহার আলী মিঞা ও মাতা রোমেছা খাতুনের ঘর আলো করে জন্ম নেন রহিমা। আর দশটি পরিবারের কন্যা সন্তানের মতই এসএসসি পাশের সাথে সাথেই বাবা-মা রহিমা খাতুনের বিয়ে দেন সরকারী চাকুরিজীবী পাত্র পাকশী ইক্ষু গবেষণা ইস্টিটিটিউটের আরনোমিস্ট ও মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মো. আমিনুল ইসলামের সাথে। মো.আমিনুল ইসলাম ছিলেন তারুণ্যদীপ্ত, উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। অত্যন্ত মিশুক স্বভাবের কারণে পাড়া প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন সবার সাথে সুসম্পর্ক ছিল। তাদের সংসার জীবনও ছিল সীমাহীন আনন্দে ভরপুর। বিয়ের মাত্র নয় বছরের মধ্যে চার পুত্র সন্তানের পিতা-মাতা হন এই দম্পতি।
সময়টা ১৯৭১ সাল। রহিমা খাতুন তখন সদ্যজাত সন্তানসহ ৪ সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। আর দশজন মুক্তিকামী মানুষের মত আমিনুল ইসলামও দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষহীন ছিলেন এবং সেই লক্ষে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার জন্য কাজ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত পর্বের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ পরিকল্পনা করার জন্য তার বাসায় রাত্রিকালীন সময়ে বৈঠকে মিলিত হতেন। স্থানীয় বিহারি ও রাজাকারেরা বিষয়টি জানতে পারে। এর ফলে একরাতে বিহারি ও রাজাকারেরা এসে আমিনুল ইসলামকে একা পেয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এমন রোমহর্ষক ঘটনায় যেন রহিমা খাতুনের পায়ের তলার মাটি সরে যায়। সাজানো সুখের সংসার ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায়।
তার ভাষায়, ‘যখন আমি স্বামী হারা হই তখন সবেমাত্র এসএসসি পাস ছিলাম। যে বাড়ী এত আপন ছিল সেই বাড়ী থেকে ৪টি সন্তানের হাত ধরে খালি হাতে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হই। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোটটির বয়স ছিল মাত্র কয়েক দিন। নিরুপায় হয়ে আমার স্বামীর অফিসে গিয়ে জানতে পারি ১০ বছর চাকুরির মেয়াদ পূর্ণ না হওয়ায় কোন পেনশন বা ভাতা পাওয়া যাবে না। আরও জানতে পারি এসএসসি পাস হওয়ায় ক্লারিক্যাল জব ছাড়া আর কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়। তখন আমি পৃথিবীটাকে ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনি। তখনই আমি শপথ নেই একজন শহীদের স্ত্রী হয়ে তার মান সম্মানকে কখনওই ধুলিস্যাৎ হতে দিব না এবং যেহেতু শুধু সন্তানের মা হয়েই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হবে তখন আদর্শ মা হয়েই পৃথিবীতে বেঁচে থাকব।’
সেই থেকে তার জীবনে শুরু হয় এক নতুন সংগ্রাম। যে সংগ্রামের নাম জীবন যুদ্ধ। নিজে আবারও পড়াশোনা শুরু করেন এবং চার সন্তানকে লালন পালন করতে থাকেন। এই দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে আত্মীয়-স্বজন, সমাজ থেকে তাকে হাজারও কটু কথা শুনতে হয়েছে এবং সীমাহীন অসহযোগিতারও স্বীকার হতে হয়েছে। কোন উপার্জনক্ষম মানুষ না থাকায় চার সন্তান ও নিজের পড়াশোনা এবং ভরণপোষণ চালাতে গিয়ে একা একজন মানুষ রোদ, বৃষ্টি, ঝড়তুফান মাথায় করে বাড়ী বাড়ী গিয়ে টিউশনি শুরু করেন। শুধু তাই নয়, এমনও হয়েছে অর্থাভাবে বাচ্চাদের ক্ষুধা নিবারণ করতে গিয়ে নিজের শরীরের রক্ত পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে তাকে। এভাবে দিনাতিপাত করে সেই তিনিই ১৯৭২ সালে এইচএসসি, ১৯৭৪ সালে গ্রাজুয়েশন ও ১৯৭৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগ থেকে প্রথম স্থান অধিকার করে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭৯ সালে ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজে সমাজকল্যাণ বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করে দীর্ঘ কর্মজীবন শেষে ২০০৩ সালে অধ্যাপক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সন্তানদের সুশিক্ষা দিতে গিয়ে এবং কোন রকম কষ্ট যাতে বুঝতে না পারেন তারা এজন্য শিক্ষকতার পাশাপাশি ঢাকাতেও তাকে দিনরাত টিউশনি করতে হয়েছে। রহিমা খাতুনের চার সন্তানের মধ্যে সবার বড়টি ছোট থেকেই মানসিক প্রতিবন্ধি হওয়ায় মেজ ছেলে কামরুলকে নিয়ে স্বামী আমিনুল ইসলামের অনেক বড় স্বপ্ন ছিল। রহিমা খাতুনের ভাষায়, ‘প্রায়ই হাসতে হাসতে বলতেন- তোমার ছেলে একদিন বিলাত ফেরত ডাক্তার হবে।’ শহীদ আমিনুল ইসলামের স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। তাদের মেজ ছেলে অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম শুধু বিলাত ফেরত ডাক্তারই হননি। শহীদ আমিনুল ইসলামের বুকের রক্ত দিয়ে গড়া বাংলাদেশ। আর সেই বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত চিকিৎসকের খাতায় নাম লিখিয়েছেন তাদের ছেলে। আমিনুল-রহিমা দম্পতির সন্তান অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১৯৮০ সালে এসএসসিতে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৫তম স্থান এবং ১৯৮২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে দশম স্থান অর্জন করেন। ওই বছরই তৎকালীন আটটি মেডিকেল কলেজের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ৪০তম ব্যাচে এমবিবিএস ভর্তি হন। এমবিবিএস পরীক্ষাতেও প্রথম স্থান অর্জন করে তাক লাগানো ফলাফলের মাধ্যমে ১৯৮৯ সালে ডাক্তারি পাস করেন। আরও পরে ২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের এডিনবরা রয়েল কলেজ অব ফিজিসিয়ান থেকে এফআরসিএস পাস করেন। শত প্রতিকূলতার একটি উদহারণ দিলে বিষয়টি পরিস্কার হবে। বাবা শহীদ হবার পর ছাত্রজীবনে কামরুলদের ঘরে কোন ঘড়ি ছিল না। সময় জানতে ভরসা ছিল পাকশী পেপার মিলের হুইসেল আর ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথিক।
অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল ইসলাম এখন দেশের একজন প্রখ্যাত কিডনী বিশেষজ্ঞ। ঢাকার শ্যামলীতে স্বল্পমূল্যে কিডনী রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য নিজস্ব কিডনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন, যার নাম ‘সেন্টার ফর কিডনী ডিজিজেজ অ্যান্ড ইউরোলজি’ বা সংক্ষেপে সিকেডি। যেটি ইতোমধ্যেই মানবতার সেবায় এক অনন্য প্রতিষ্ঠানে রূপ লাভ করেছে। ডা. কামরুল শহীদ বাবার সম্মানে কিডনী প্রতিস্থাপন করার জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেননা। দেশের কিডনী প্রতিস্থাপন ব্যবস্থায় তিনি এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন। ইতোমধ্যে ডা. মো. কামরুল ইসলাম তার একক তত্ত্বাবধানে ১২শর বেশি কিডনী প্রতিস্থাপন করেছেন। এককভাবে বাংলাদেশে এটিই সর্বোচ্চ। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায়ও খুব অল্প সংখ্যক ব্যক্তিই এমন কাজ করতে পেরেছেন। পাশের দেশেও যেখানে ১৫-২০ লাখ টাকা করচ হয়; সেখানে কামরুলের হাসপাতালে খরচ মাত্র দুই লাখ ১০ হাজার টাকা। শুধু তাই নয় অপারেশন পরবর্তী সব ধরনের ফলো-আপ ও টেস্ট বিনামূল্যে প্রদান করছেন ডা. কামরুল ইসলাম। দারিদ্র্য-নিপীড়িত মানুষের কাছে কিডনী নষ্ট হওয়ার অপর নাম যখন মৃত্যু বলে পরিচিতি পাচ্ছিল, তখন এই শল্যচিকিৎসকের সফল অস্ত্রোপচার ও সেবামূলক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সবার ধারণা পাল্টে দিয়েছে। বলা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের কিডনী রোগে আক্রান্ত মৃত্যু পথযাত্রী রোগীদের আস্থার নাম হয়ে উঠেছেন অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। অধ্যাপিকা রহিমা খাতুন-শহীদ আমনিুল ইসলামের এই রত্নকে, এই মহান কর্মবীরকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০২২ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভুষিত করেছে।
অধ্যাপিকা রহিমা খাতুনের তৃতীয় সন্তান মো. জাহিদুল ইসলামও ছিলেন অদম্য মেধাবী। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় তার এই সন্তান বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার (ইলেক্ট্রিক্যাল) কর্মজীবনে থাকা অবস্থায় ১৯৯৮ সালে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অধ্যাপিকা রহিমা খাতুনের স্বামী আমিনুল ইসলাম ১৯৭১ সালে যেদিন শহীদ হন সেদিন সবার ছোট ছেলেটির বয়স ছিল মাত্র ৩দিন। সেই ছোট্ট শিশু পুত্রকে এবং আর তিনটি শিশুকে নিয়ে পাক বাহিনীর ভয়ে এখানে সেখানে ছুটে বেড়াতে হয়েছে রহিমা খাতুনকে। না ছিল খাদ্য, না ছিল সেবাযত্ন। তখন কেউ ভাবতেও পারেনি ছোট্ট শিশুটি বেঁচে থাকবে। তার সেই শিশুটিও আজ লেদার টেকনোলজিতে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে থাইল্যান্ডে কর্মরত আছেন।
রহিমা খাতুনের শহীদ স্বামীর সম্মানে স্বাধীনতার পর ঈশ্বরদীতে তাদের এলাকাটির নামকরণ করা হয় আমিনপাড়া। আসলে সত্যিকার অর্থে একটি এলাকা নয়; সমগ্র বাংলাদেশই এমন এক একজন শহীদের রক্তে নামাঙ্কিত। মুক্তিযুদ্ধ যে কতটা ত্যাগের একজন অধ্যাপিকা রহিমা খাতুন এবং তার সন্তানদের কষ্ট করে বেড়ে ওঠা সফল জীবনের গল্প শুনলে তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যায়। মুক্তিযুদ্ধ তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু তিনি তার হার না মানা মনোবল নিয়ে নিজে উঠে দাঁড়িয়েছেন, সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন এবং এক একটি রত্ন বানিয়েছেন। দেশ সেরা প্রখ্যাত ব্যক্তিও হয়েছন তারই সন্তান অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। তাইত একজন শহীদ জায়া ও রত্নগর্ভা মা অধ্যাপিকা রহিমা খাতুন এবং তার সন্তানদের বেড়ে ওঠার গল্প যে কারো জন্যই এক বিরাট অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে।
লেখক: তথ্যচিত্র নির্মাতা ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
এক শহীদ জায়া ও তার সন্তানদের অনন্য জীবনসংগ্রাম ও সাফল্য ফিচার মুক্তিযুদ্ধ সাজ্জাদ কাদির