দর্শনার্থীর পদচারনায় মুখর ময়মনসিংহের ‘জয়নুল সংগ্রহশালা’
১২ ডিসেম্বর ২০২২ ১৬:৫৫
সংস্কৃতি, প্রকৃতি, জীবন-জীবিকা, মানুষ, বিক্ষোভ-স্বাধীনতা, দুর্ভিক্ষসহ নানা বিষয় রঙ তুলির আঁচড়ে তুলে ধরে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। তার চিত্রকর্ম-কর্মগুণে গোটা বিশ্বে নিজেকে ও দেশকে করেছেন সমাদৃত। তার তুলির আঁচড়ে প্রতিটি চিত্রকর্মই যেন এক জীবন্ত ইতিহাস, নিয়ে যায় সে সময়ের পটভুমিকায়, শিহরিত করিয়ে দেয় সময়ের বাস্তবতাকে।
শিল্পচর্চা-শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ এ মহীরুহের চিত্রকর্ম ও ব্যবহার্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। ময়মনসিংহ নগরীর ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে সাহেব কোয়ার্টার পার্কের পশ্চিমে সবুজ গাছপালা ঘেরা দো’তলা ভবনেই এই সংগ্রহশালা।
প্রায় সোয়া তিন একর জায়গা জুড়ে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশে এই সংগ্রহশালাটির অবস্থান। তালি পাম, পিটালি, লাতিম, কড়ই, আম, জাম, কামরাঙ্গা, বকুল, সেগুন, বট গাছসহ বহু গাছ থাকায় সংগ্রহশালার পরিবেশ আরো সুশোভিত করেছে এবং পাখিদের কলকাকলিতে সবসময় মুখরিত থাকে। দ্বিতীয় তলায় দুটি গ্যালারিতে শিল্পাচার্যের নিজ হাতে আঁকা চিত্রকর্ম, ব্যবহৃত জিনিসপত্র, আলোকচিত্র ও তার সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। নীচতলায় দাপ্তরিক কার্যক্রম, বিক্রয় কেন্দ্র, সেমিনার কক্ষ ও একটি আর্ট গ্যালারি রয়েছে। পাশাপাশি নতুন আঁকিয়ে তৈরিতে রয়েছে শ্রেণিকক্ষ। জয়নুল শিশু চারুপীঠে ক্ষুদে চিত্র শিল্পীদের জন্য সপ্তাহে দু’দিন প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচটি পর্বে শিক্ষার্থীদের পাঠ কার্যক্রম চলে। দ্বিতল ভবনের পাশেই রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হামিদুজ্জামান খানের নির্মিত শিল্পাচার্যের পিতলের ভাষ্কর্য।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের স্মৃতিকে ধরে রাখতে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশেনের উদ্যোগে সংগ্রহশালার পাশে সাহেব কোয়াটার পার্কটির নামকরন করা হয় ‘জয়নুল উদ্যান’। সেই সাথে সংগ্রহশালার সামনে সড়কে একটি প্রতিকৃতিও নির্মান করা হয়।
সংগ্রহশালার দায়িত্বরতদের সঙ্গে কথা হলে জানা যায়, সংগ্রহশালায় সারা বছরই দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে। সপ্তাহের শনি থেকে বুধ প্রতিদিন সকাল সাড়ে দশটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা এবং শুক্রবার তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে সংগ্রহশালাটি। দর্শনীর মাধ্যমে প্রবেশে শিশুদের ১০, বড়দের ২০, সার্কভুক্ত দেশের ৩০০ ও অন্যন্য দেশের দর্শনার্থীদের জন্য ৫০০ টাকা দিয়ে টিকিট নিতে হয়। এছাড়া শিক্ষা কার্যক্রমের স্বার্থে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রশাসনিক অনুমোদনে বিনা টিকিটে প্রবেশাধিকার দিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
জয়নুল আবেদিনের আঁকা বিখ্যাত শিল্পকর্ম দেখতে নিয়মিত দূর-দূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসে অনেক মানুষ। দর্শনার্থীর পদচারনায় সবসময় মুখর-সরব-জমজমাট থাকে প্রতিষ্ঠানটি। ময়মনসিংহের গর্বের জায়গা এই জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। ছুটির দিনগুলোতে দর্শনার্থীদের ভিড় বেশি থাকে।
সংগ্রহশালাটিতে জয়নুল আবেদিনের নিদর্শনের মধ্যে ৬২টি শিল্পকর্ম রয়েছে, শিল্পাচার্যের ৮৮টি ব্যবহার্য নিদর্শন, ৩৫টি আলোকচিত্র, ১০টি দুর্ভিক্ষ সিরিজের মুদ্রিত কপি, চারটি জীবনবৃত্তান্ত বোর্ড ও শিল্পাচার্যের প্রতিকৃতি। ১৯৮২ সালে ১৭টি চিত্রকর্ম চুরি হলে ১৯৯৪ সালে ১০টি উদ্ধার হয়। এসবের পাশাপাশি চিত্রকর্ম আকাআকির কাজে ব্যবহৃত দোয়াত, মেটাল ক্লিপ, খাগের কলম, কাঠ কয়লা, মোম, ব্রাশ হোল্ডার, তারপিন তেলের বোতল, কালার পেলেট, রঙ এর টিউব এবং চিত্রকর্মগুলোকে ধরে রাখার কাজে ব্যবহৃত স্ক্রেইপার, স্প্যাচুলা ও ইজেল রয়েছে প্রদর্শনীতে। এই সকল জিনিষপত্রগুলো পাওয়া গেছে শিল্পাচার্যের সহধর্মীনি জাহানারা আবেদিনের কাছ থেকে। পরে শিল্পাচার্যের সংগৃহীত মাটির পুতুল গুলো সংগ্রহশালা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন তারই ছেলে ময়নুল আবেদিন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, জয়নুল সংগ্রহশালাটি ব্রিটিশ আমলে ছিল বার্ডেন সাহেব নামের এক ইংরেজের বাড়ি। পরে নলিনী রঞ্জন সরকার নামে নেত্রকোনার এক ব্যক্তি এটি কিনে নেন। নলিনী রঞ্জন ভারতে চলে গেলে এটির মালিক হয় বাংলাদেশ সরকার। পরে ১৯৭৫ সালে জয়নুল আবেদিনের শিল্পকর্ম নিয়ে এই সংগ্রহশালা গড়ে ওঠে। ওই বছরের ১৫ এপ্রিল এটি উদ্বোধন করেন উপ রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। জেলা প্রশাসনের তদারকিতে একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে দীর্ঘদিন এটি পরিচালিত হয়। ১৯৯৯ সালের ৩১ আগস্ট সংগ্রহশালাটি জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে সংগ্রহশালাটি নতুন রূপ লাভ করে।
ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শাহাদাত হোসেন খান হিলু বলেন, ‘সংগ্রহশালাটি ময়মনসিংহবাসীর গর্ব। এই প্রতিষ্ঠানটি ভ্রমণপিপাসু যে কারোর মন ভরিয়ে দিতে পারে এর প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রতিষ্ঠানটির আরো উন্নয়ন হোক, প্রচার-প্রসার ঘটুক, যেন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এখানে এসে শিল্পাচার্যের কাজগুলো দেখতে পায়, তার সম্পর্কে জানতে পারে ও অনুভব করে।
সমাজকর্মী সাংবাদিক জগলুল পাশা রুশো জানায়, নগর জীবনের ব্যস্ততা কোলাহল থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতে প্রায়শই এই সংগ্রহশালায় আসি। একজন শিল্পীর সে সময়কার আধুনিক ভাবনার প্রতিফলন দেখে বিস্মিত হই। বন্ধু স্বজনদের নিয়ে আসি পুরনো স্মৃতি সংলাপে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা যেনো আসতে পারে সেদিকে সরকার ও কতৃপক্ষ নজর দেবে এমন আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
সংগ্রহশালার উপকিপার মুকুল দত্ত বলেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে ময়মনসিংহ শহরে। ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে তার সম্পর্ক অনেক গভীর। জয়নুলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ব্রহ্মপুত্রের কোল ঘেষে নির্মিত জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালাটি দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে এখনো অনেক আর্কষণের। সকলের চেষ্টাতে গড়া প্রতিষ্ঠানটি এখন স্বনামধন্য সংগ্রহশালা। প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দুই’শ দর্শণার্থী এখানে আসে। অনেক লেখক-গবেষক, সরকারি কর্মকর্তারা আসেন প্রানের তাগিদে। তিনি আরো জানান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথেও তার ছিল সখ্যতা। কর্মময় জীবনের বিভিন্ন সময়ের সাক্ষাতই তা বলে দেয়।
জয়নুল আবেদিন ও এ অঞ্চলের শিল্পবোদ্ধাদের সহযোগিতায় গড়া এ প্রতিষ্ঠানটি আজো দাড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে। জয়নুলের প্রতিটি চিত্রকর্মই অনুভব করার মতো। স্বকীয় গুনে তিনি এঁকে চলতেন, ঘটাতেন ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। প্রতিবছর তার স্মরণে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে প্রতিষ্ঠান কতৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসন। শিল্পার্চায জয়নুল আবেদিন শুধু ময়মনসিংহের নয়, গোটা দেশের গর্ব। আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলেও রয়েছে অনেক সুখ্যাতি।
সারাবাংলা/এএসজি
ইতিহাস-ঐতিহ্য কাজী মোহাম্মদ মোস্তফা জয়নুল সংগ্রহশালা ময়মনসিংহের গর্ব ফিচার