স্বাধীনতার পর যে মাইন শত মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু ঘটিয়েছিল
৬ জানুয়ারি ২০২৩ ২১:৩১
একাত্তরে দিনাজপুর পাকিস্তানি সেনাদের দখল থেকে মুক্ত হয়েছিল ১৪ই ডিসেম্বরে। মুক্তিযোদ্ধাদের অভূতপূর্ব বীরত্বে আত্মসমর্পণ করেছিল হানাদার পাকিস্তানি সেনারা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্ব শেষ হয়নি তখনও। দেশকে শত্রুমুক্ত করার পর জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং পূর্ণগঠনের কাজ শুরু করতে ২০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানিদের পুঁতে রাখা মাইন, লুকিয়ে রাখা ও ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ, বোমা উদ্ধারের কাজ। শত শত মুক্তিযোদ্ধা প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ বোমা ও অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে এনে দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজানাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপনকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রানজিট ক্যাম্পে জড়ো করতেন। তারপর সেগুলো পাশেই বাঙ্কারে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হতো। এই দায়িত্ব পালনকালেই ১৯৭২ সালের ৬ই জানুয়ারি ঘটে যায় এক বেদনাদায়ক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। হাত ফসকে পড়ে যাওয়া একটি মাইন ঘটায় শত শত মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু।
দিনাজপুরের উত্তর বালুবাড়ির মহারাজা গিরিজানাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে অবস্থিত ট্রানজিট ক্যাম্পে ভারতের পতিরাম, বাঙ্গালবাড়ি, হামজাপুর, তরঙ্গপুর, বাংলাদেশের নবাবগঞ্জ, ঘোড়াঘাট, ফুলবাড়ি, হাকিমপুর, দিনাজপুর সদর, ঠাকুরগাঁও, পীরগঞ্জ, রাণীশংকৈল ও হরিপুর এলাকাসহ ৬ ও ৭ নম্বর সেক্টরের প্রায় হাজার খানেকেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধা এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানে প্রতিদিনই অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা এসে সমবেত হতে থাকেন। সেখানেই চারদিক থেকে উদ্ধার করে আনা অস্ত্র-গোলাবারুদ ও মাইনগুলো জড়ো করে রাখা হচ্ছিল। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ৬ তারিখ বিকেল বেলা—নবাবগঞ্জ ও ঘোড়াঘাট থেকে উদ্ধার করে আনা দুই ট্রাক মাইন মুক্তিযোদ্ধারা স্কুলের মাঠে রাখেন। সেখান থেকে মাইনগুলো খালাস করা হচ্ছিল পাশের বাঙ্কারে। প্রায় ১০০ গজ দূরত্বে থাকা বাঙ্কারে হাতে হাতে মাইনগুলো পৌঁছে দিচ্ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। বিকেল আনুমানিক সোয়া ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার দিকে হাত বদলের সময় একজন মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে অসাবধানতাবশত একটি অ্যান্টি-পার্সোনাল মাইন বাঙ্কারের কাছাকাছি মাটিতে পড়ে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। ফলে বাঙ্কারে স্তুপকৃত প্রায় হাজারেরও বেশি মাইন ও বোমা একের পর এক বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হতে থাকে। বিদ্যালয়ের কক্ষে অবস্থানরত এবং পার্শ্ববর্তী মসজিদে নামাজ আদায়কারী পাঁচশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলেই নিহত হন। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড ধাক্কায় ঘটনাস্থলে ২০ থেকে ২৫ ফুট গভীর পুকুরে পরিণত হয়। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতোটাই ছিল যে, আশেপাশের এলাকা কেঁপে উঠেছিল এবং অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ আর কখনই চিহ্নিত করা যায়নি।
সেদিন ঠিক কতজন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছিলেন তার সঠিক হিসেব আজও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়—কমপক্ষে ৫০০ জনের বেশি মুক্তিযোদ্ধা সেদিন শহিদ হয়েছিলেন। আহত ও পঙ্গু হন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা। পরদিন দিনাজপুরের ঐতিহাসিক গোর-এ শহিদ বড় ময়দানে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে ৯৬ জন মুক্তিযোদ্ধার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ দিনাজপুরের চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়। পরে একই স্থানে আরও ৩৯ জনসহ মোট ১৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ সমাহিত করা হয়। এছাড়া অনেক মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ তাদের আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান।
কিন্তু বীভৎসতার তখনও বাকি ছিল। জানাজার পরেও ওই এলাকা এবং এর আশেপাশের নানা জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাত-পা ও শরীরের খণ্ড-বিখণ্ড এবং ছিন্নভিন্ন অংশ পাওয়া যেতে থাকে। বেশ কয়েকদিন ধরে তল্লাশি চালিয়ে অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের দেহাবশেষের উদ্ধারকৃত নানা অংশের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ মণেরও বেশি। দেশটা শত্রুমুক্ত করে বিজয়ীর বেশে ফিরে তাদের প্রাণ দিতে হলো জনগণকে নিরাপদ রাখতে গিয়ে।
দুঃস্বপ্নের মতো এই ভয়াবহ ট্র্যাজেডির শোক আজও কাটিয়ে উঠতে পারেননি ওই এলাকার সাধারণ মানুষেরা। দিনাজপুর শহরের দক্ষিণ বালুবাড়ির বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রফিকুল ইসলামের স্মৃতিচারণে উঠে আসে সেদিনের বীভৎস ভয়াবহতার কথা। তিনি জানান, “স্বাধীন দেশে তখন শত্রুমুক্ত হওয়ার আনন্দে আত্মহারা সবাই। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে দ্রুত পূনর্গঠনের লক্ষ্যেই কাজ করছিল সবাই। তারই ভেতর ঘটে যাওয়া এই নির্মমতা দুর্ঘটনা সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ছিল মহারাজা স্কুলে বিস্ফোরণের ঘটনায় সেখানকার ক্যাম্পে অবস্থানরত বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্ভাগ্যজনকভাবে শহিদ হওয়ার ঘটনা। ৯ মাস জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ শত্রুমুক্ত করে মুক্তি এনে দেওয়া এই বীরেরা সামান্য অসতর্কতায় ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনায় স্বাধীন জমিনে প্রাণ হারান। তাদের দেহগুলো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঘটনার পরদিন আমরা নিহতদের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন শরীরের অংশ সংগ্রহ করতে শুরু করি। এ সময় কারও হাত পাওয়া গেছে বাড়ির ছাদে, কারো পা পাওয়া গেছে এক কিলোমিটার দূরের খোলা মাঠে। নিহতদের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অবশিষ্ট অংশ প্রায় ৫০ মণ ওজন হয়। যা পরে একত্রিত করে মাটিচাঁপা দেওয়া হয়। এ ঘটনার কথা মনে পড়লে আজও শরীর কেঁপে ওঠে”।
প্রতিবছরই শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে মহারাজা স্কুল ট্র্যাজেডি দিবসটি পালন করা হয়। দিনাজপুরে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণসমাধি ও মহারাজা স্কুলের শহিদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষেরা। কিন্তু জাতীয়ভাবে কখনও এই দিনটি পালিত হয়নি। নেই সরকারি কোনো কর্মসূচিও। নয় মাস জীবন বাজি রেখে ভীষণ লড়াইয়ে যে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জয়ী হয়ে সার্বভৌমত্ব উপহার দিয়েছিলেন,পাকিস্তানি হানাদার শত্রুরাও যাদের মারতে পারেনি, স্বাধীন জমিনে মুক্ত বাতাসে জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব পালনে এক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন তারা। এরচেয়ে ভয়াবহ ট্র্যাজেডি আর হতে পারে না।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই তাদের ঋণ এই জাতি কখনও শোধ করতে পারবে না, কিন্তু তারপরেও যে বীরেরা জাতিকে বিজয় এনে দেওয়ার পরেও তাদের দায়িত্বে একবিন্দু অবহেলা করেননি, দায়িত্ব পালনকালেই অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন, তাদের প্রয়াণদিবসে জাতীয়ভাবে বড় আয়োজনে, সরকারি কর্মসূচিতে স্মরণ করা উচিত। চাইলে এখনও করা যায়। সরকারি উদ্যোগে ৬ জানুয়ারিকে জাতীয়ভাবে পালন ও তাদের অম্লান স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করা হোক। তারা জাতির প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করতে করতেই শহিদ হয়েছেন। তাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটা আমরা আর কবে পালন করব?
সারাবাংলা/এজেডএস