পাকিস্তান কারাগার থেকে যেদিন মুক্তি পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু
৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১৩:৫৯
জানুয়ারির ১০ তারিখ বাংলাদেশ ও বাঙালির ইতিহাসে এক গুরুত্ববহ দিন। পাশাপাশি বাঙালির অনন্য একটি দিবস। জাতীয় জীবনে এমন দু-একটি দিন আসে যা আপন মহিমায় উজ্জ্বল। তেমনি একটি দিন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। আগামী পরশু ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুযন্ত্রণা শেষে ১৯৭২ সালের এ দিনে লন্ডন-দিলি্ল হয়ে মুক্ত স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসেন তিনি। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পান। একটি পাকিস্তান সামরিক বিমানে খুব গোপনে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ওই বিমানে আরও ছিলেন ড. কামাল হোসেন ও তার স্ত্রী হামিদা হোসেন।
লন্ডনে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি দুপুরে এক প্রেস কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সেই প্রেস কনফারেন্সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন। সেখানে প্রধানত চারটি বিষয়কে ঘিরে ভাষণ দেন। এ চারটি বিষয় ছিল (১) মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানানো; (২) যেসব দেশ মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা বা সমর্থন দিয়েছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং যেসব দেশ সমর্থন করেনি অথচ জনগণ সমর্থন দিয়েছে, তাদের প্রতি ধন্যবাদ জানানো; (৩) সব দেশের কাছে স্বাধীনতার স্বীকৃতি চাওয়া; (৪) পুনর্বাসন কিংবা পুনর্গঠনের জন্য সাহায্য চাওয়া। এ চারটি বিষয় ধরে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববাসীর কাছে তার ভাষণ তুলে ধরেছিলেন।
লন্ডনে সময় তখন ভোর ৬টা, ৯ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল। লন্ডন হিথ্রো বিমান বন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে পৌঁছান বঙ্গবন্ধু। তাকে স্বাগত জানায় ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কমনওয়েলথ বিভাগের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি পন্থ। যতদূর জানা গেছে যে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন ইয়ান সাদারল্যান্ড। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করে দেন আপা বি পন্থ। ৩০ মিনিট ধরে চলেছিল বঙ্গবন্ধু-ইন্দিরা টেলিফোন আলাপচারিতা।
স্বদেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবহরের কমেট জেটে। বাংলাদেশে ফেরার পথে বিমানটি ২ ঘণ্টার যাত্রাবিরতি করে দিল্লীতে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। দিল্লীতে বিশাল নাগরিক সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। দিল্লীতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। সে বৈঠকে ৩ মাসের মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সৈন্যদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি আলোচনা হয়।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির সকাল থেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরের রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সারিবদ্ধ মানুষ। বিশ্ববাসী ও বাঙালিরা প্রত্যক্ষ করেছিল। বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)- এক বিপুল জনসমুদ্র। বাংলাদেশ বেতার থেকে ধারাবিবরণী দেয়া হচ্ছিল। বিমানবন্দর ও রাস্তার দু’পাশে অপেক্ষমাণ জনতা। সবার চোখেমুখে অন্যরকম উত্তেজনা। বাঙালির মহান নেতা আসছেন। যিনি বাঙালি জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। লাখো লাখো মানুষের ভিড় রাজপথজুড়ে। কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন স্বদেশে। যে দেশ এবং যে স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সেই মাটিতে পা দিয়েই আবেগে কেঁদে ফেলেন তিনি। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাতে যারা গিয়েছিলেন, অস্থায়ী সরকারের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা তারাও অশ্রুসজল নয়নে বরণ করেন ইতিহাসের এই বরপুত্রকে। তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করার পর খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের ভেতর দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে এসে পৌঁছুতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। সেদিনকার রেসকোর্স ময়দান ছিল লোকে লোকারণ্য। বাঙালি জাতি তেজোদীপ্ত ‘জয় বাংলা’ সেস্নাগানে তাদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানায়।
প্রাণপ্রিয় স্বদেশে ফিরে জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। যা ছিল জাতির জন্য দিক নির্দেশনা। বাংলাদেশের আদর্শগত ভিত্তি কী হবে, রাষ্ট্র কাঠামো কী ধরনের হবে, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যারা দালালি ও সহযোগিতা করেছে তাদের কী হবে, বাংলাদেশকে বহির্বিশ্ব স্বীকৃতি দেয়ার জন্য অনুরোধ, মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ, কৃষক, শ্রমিকদের কাজ কী হবে, এসব বিষয়সহ বিভিন্ন দিক নিয়ে যে নির্দেশনামূলক ভাষণ দিয়েছিলেন সেই ভাষণকে একজন প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কের নীতিনির্ধারণী ভাষণ বলে উল্লেখ করা যায়। তিনি ডাক দিলেন দেশ গড়ার সংগ্রামে। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতা দু’হাত তুলে সেই সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন।
যাদের প্রাণ ও ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধু ভাষণের শুরুতে বলেন, ‘স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সেপাই, পুলিশ, জনগণকে, হিন্দু, মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমি আপনাদের কাছে দু-একটা কথা বলতে চাই।’
স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে সেদিন বলেছিলেন, ‘এ বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা, এ বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র, এ বাংলাদেশ হবে ধর্ম নরপেক্ষ রাষ্ট্র।’
মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান যেমন সত্য তেমনি এ দেশের মাটিতে ভারতীয় সৈন্যের অনির্দিষ্টকালের অবস্থানের ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াও ছিল এক বাস্তব সত্য। সে ভেবে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, ‘যারা জানতে চান আমি বলে দিতে চাই, আসার সময় দিলি্লতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যে সময় আলোচনা হয়েছে। আমি আপনাদের বলতে পারি, আমি জানি তাকে। তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। তিনি পন্ডিত নেহেরুর কন্যা, তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। যেদিন আমি বলব সেই দিন ভারতের সৈন্য বাংলার মাটি ছেড়ে চলে যাবে। এবং তিনি আস্তে আস্তে কিছু সৈন্য সরিয়ে নিচ্ছেন।‘ তিনি জনগণকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমি দেখায়ে দেবার চাই দুনিয়ার কাছে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।’ মহান মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের সমর্থনকে অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেন এ ভাষণে। পাশাপাশি তিনি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানান ভারত সরকার, সে দেশের জনগণ ও তাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। কৃতজ্ঞতা জানান ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে। আবার বঙ্গবন্ধু মার্কিন জনগণকে ধন্যবাদ জানান, সরকারকে নয়। এখানে উল্লেখ করতে হয়, তৎকালীন মার্কিন সরকার আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেনি। কিন্তু সে দেশের জনগণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের গণবিরোধী ভূমিকা পালন করার ফলে মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রতিহিংসাপরায়ণবশে অনেক সহিংস ঘটনা ঘটে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু সতর্কবাণী উচ্চরণ করেন তার ভাষণে, ‘আজ আমার কারও বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা নেই, একজন মানুষকে তোমরা কিছু বলো না, অন্যায় যে করেছে তাকে সাজা দেব। আইনশৃঙ্খলা তোমাদের হাতে নিও না।’ পাকিস্তানের সঙ্গে নূ্যনতম বাঁধন রাখার প্রস্তাব নাকচ করে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, ‘আজ বলছি ভুট্টো সাহেব, সুখে থাক। বাঁধন ছুটে গেছে। আর না।’
সেদিনের ভাষণের এক পর্যায়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘সাত কোটি বাঙালি, হে বঙ্গ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি। _ এই পঙক্তি উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘… প্রমাণ হয়ে গেছে, আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি আজ দেখিয়ে দিয়েছে।’
আবার নতুন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি কূটনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সে বিবেচনায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে উদাত্ত আহ্বান জানান এভাবে, ‘দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। আমার বাংলাদেশকে তোমার রিকগনাইজ করো। জাতিসংঘে স্থান দেও, দিতে হবে। উপায় নাই। দিতে হবে, আমি, আমরা হার মানব না। আমরা হার মানতে জানি না।‘ তথ্য মোতাবেক আমরা জানি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির ভাষণটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার একটি নীল নকশা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সেদিন সবাইকে দেশ গড়ার ডাক দেন। পাশাপাশি ভবিষ্যত বাংলাদেশের রূপরেখা ও নতুন দেশ হিসেবে দেশ পুনর্গঠনের জন্য আহ্বান। পূর্বপ্রস্ততিহীন এ সংক্ষিপ্ত ভাষণে অনেকগুলো বিষয়ের প্রতি বঙ্গবন্ধু দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যা রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে তাৎপর্য বহন করে। পাশাপাশি বহন করে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদৃষ্টি। ভাষণটি ছিল সংক্ষিপ্ত। এ সংক্ষিপ্ত ভাষণেই তিনি বাঙালি জাতি ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা দিতে সক্ষম হন। এ ভাষণটি অন্যান্য ভাষণের ন্যায় আমাদের জাতীয় জীবনের অমূল্য সম্পদ ও অন্তহীন প্রেরণা। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোকিত সোনার বাংলা বির্নিমাণে অবিনাশী অনুপ্রেরণা, পাথেয় ও দিক নিদের্শনা।
১০ জানুয়ারি ক্যালেন্ডারের পাতায় যেমন ফিরে আসে ঠিক তেমনি সবার চৈতন্যে ফিরে আসেন বাঙালির সিংহপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের সংকট দূরীকরণে বঙ্গবন্ধুর আদর্শই আমাদের শক্তির প্রেরণা। এই দেশের সবকিছুতেই বঙ্গবন্ধু মিশে রয়েছেন উন্নত শির ও মহিমা নিয়ে। জাতির অনৈক্য, বিভেদ, বিসংবাদে ঐক্যের দৃঢ়মূল বন্ধন হিসেবে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া আদর্শকে স্থান দিতে হবে। তা না হলে জাতি বারংবার হোঁচট খাবে। পথ হারাবে। জানতে পারবে না বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস। অনেক বিবেচনায় বলা যায় যে, এই ১০ জানুয়ারির তারিখটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের অংশ। প্রতি বছর ১০ জানুয়ারি বাঙালি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
কবিতা রাণী মৃধা পাকিস্তান কারাগার থেকে যেদিন মুক্তি পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ফিচার মুক্তিযুদ্ধ