Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ফুল-ফাগুনের প্রথম দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝরেছিল শত প্রাণ

রা'আদ রহমান
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৬:১১

‘আমি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্য ও করুণায় এবং আমাদের মহান দেশপ্রেমিক জনগণের দোয়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বুধবার থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সকল ও পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণ করছি এবং ঘোষণা করছি যে গোটা বাংলাদেশ অবিলম্বে সামরিক আইনের আওতায় আসবে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আমি বাংলাদেশের সকল সশস্ত্র বাহিনীর পূর্ণ ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করছি’।

বিজ্ঞাপন

ঠিক এই ঘোষণাটা দিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানের পথ ধরে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জোর করে ক্ষমতা হরণ করেছিল জেনারেল এরশাদ। আরও সহজ করে বলতে গেলে, দখল করে নিয়েছিল বাংলাদেশকে। শুরু হয়েছিল সেনাবাহিনীর স্বৈরশাসনের অন্ধকার অধ্যায়ের দীর্ঘতম পর্বের। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, এটা আমরা সবাই জানি, কিন্তু ক্ষমতা দখলের পর এরশাদের স্বৈরাচারী সরকার বুঝতে পেরেছিল তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠবে শুধু মেরুদণ্ড হিসেবেই নয়, জাতির প্রতিটি ক্রান্তিকালে দুর্দমনীয় শৌর্যে রুখে দাঁড়ানো, স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে সবচেয়ে কঠিনতম প্রতিরোধ গড়ে তোলা এই দেশের ছাত্রসমাজ। তাই দেশ দখলের পর সবার প্রথমে এরশাদ সরকার সেই মেরুদণ্ড চূর্ণ করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোল। ১৯৮২ সালের ১৬ জুলাই বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সদস্যের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার সময় এরশাদ জানালেন, তার সরকার শিক্ষার উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের চরিত্র উন্নয়নের লক্ষ্যে একটা শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এই শিক্ষার মানোন্নয়নের পুরো কার্যাবলী পরিচালনার জন্য তিনি নিজেই শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিজেকে প্রস্তাব করেন এবং কিছুদিন পর তিনি চেয়ারম্যান হয়ে যান! শিক্ষক না হয়ে শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে দূরতম কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও একজন জেনারেল দেশের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দখল করেছেন, এমন নজির পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কিনা সন্দেহ!

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এরশাদের সেই চেয়ারম্যান হওয়া ছিল দুঃস্বপ্নের কেবল শুরু। কদিন পর এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান একটা নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাব পেশ করলেন। প্রথম শ্রেণী থেকেই আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়। আরেকটি বিতর্কিত বিষয় ছিল উচ্চশিক্ষা। উচ্চশিক্ষা অর্জনের মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয় মেধা অথবা পঞ্চাশ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা! অর্থাৎ পাকিস্তানি জেনারেল আইয়ুব খানের আমলে শরীফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টই একটু এদিক-ওদিক করে সেটা স্বাধীন বাংলাদেশে প্রস্তাব করা হয়। ছাত্রসমাজের দাবি ছিল তখনকার পৃথিবীর বাস্তবতায় জনগণের মৌলিক অধিকারের একটি শিক্ষাকে অবৈতনিক বৈষম্যহীন ও আরও সহজলভ্য করার, মাতৃভাষায় শক্ত বুনিয়াদ গড়ে তুলার ব্যবস্থা করার। উল্টো এই শিক্ষানীতির মাধ্যমে শিক্ষাকে ব্যয়বহুল, চরম বৈষম্যমূলক এবং সাধারণের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, একইসাথে মাতৃভাষায় প্রথমে বুনিয়াদ গড়ার বদলে আরবি ও ইংরেজি জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা প্রস্তাব করা হয়। সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল একদিকে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ও অস্ত্রের ঝনঝনানি বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে বহুদূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছিল সরকারি মদদে, অন্যদিকে যে কোনো অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সবার আগে প্রতিবাদী ছাত্রসমাজকে সরকারি প্রভাব ও নির্দেশনায় পেটোয়া ও সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে স্তব্ধ করা হচ্ছিল যেন স্বৈরাচারী সরকার নির্বিঘ্নে শাসন শোষণ চালিয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ সুকৌশলে দেশের মেরুদণ্ড শিক্ষাকে পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছিল এরশাদ সরকার।

কিন্তু বরাবরের মতোই ছাত্র-শিক্ষক সমাজ এই চাপিয়ে দেওয়া অনাচার মানল না। মজিদ শিক্ষানীতির প্রতিবাদে ১৯৮২ সালের ৮ নভেম্বর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-শিক্ষক সমাজের প্রতিবাদী মিছিলে পুলিশের লাঠিচার্জে গুরুতর আহত হলেন ঢাবি’র রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নুরুল আমিন বেপারীসহ অনেক ছাত্র-শিক্ষক-সাংবাদিক। গ্রেফতার হলেন ৩০ জন। প্রতিবাদে পরদিন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও মিছিল হলো, পরিস্থিতি সামাল দিতে ঢাবি বন্ধ ঘোষণা করল কর্তৃপক্ষ। এরপর ১৪ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় খুললে ১৪টা ছাত্র সংগঠন একযোগে আন্দোলন শুরু করে, একদিকে আন্দোলন অন্যদিকে সরকার নিয়ন্ত্রিত পুলিশি দমন-পীড়ন চলতেই থাকে।

কিন্তু এরশাদ সরকার ১৯৮৩ সালের জানুয়ারি মাসের ১ম সপ্তাহ থেকে সারাদেশের ১৪২টা থানার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে আরবি শিক্ষা শুরুর আদেশ দেয়। মাতৃভাষা বাংলায় বুৎপত্তি অর্জনের আগে শিক্ষার্থীদের উপর আরবি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার এই হীন চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে ছাত্র-শিক্ষকসমাজ। সম্মিলিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঘোষণায় বলা হয়: ‘শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষায় অতিরিক্ত দুইটি বিদেশি ভাষা বাধ্যতামূলক করিয়া মূলত বাংলা ভাষাকেই আঘাত করা হইয়াছে। শিক্ষা সংস্কারের নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাজীবনে এক অরাজক ও নৈরাজ্যজনক অবস্থার সৃষ্টি করা হইতেছে এবং শিক্ষাকে উচ্চশ্রেণীর ব্যয়বহুল বিনিয়োগ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলিতেছে। ছাত্রসমাজের উপর চলিতেছে চাপ ও নিপীড়ন। এই পরিস্থিতিতে সংগ্রাম পরিষদ শিক্ষা, গণতন্ত্র ও মৌল অধিকারসহ শোষণমুক্তির দাবি লইয়া একুশ পালনের আহ্বান জানায়’। বিপরীতে সরকারি প্রেসনোটে রীতিমতো প্রবল হুমকি দিয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হয় দমন-পীড়ন আরও বাড়বে। কদিন পর ১১ জানুয়ারি হাজার হাজার শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হলে অস্ত্রসজ্জিত বিপুল সংখ্যক দাঙ্গা পুলিশ নিয়োজিত করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ও সচিবালয়ের চারপাশে, সরাসরি সংঘর্ষ এড়াতে শহিদ মিনারে সমবেত হয় শিক্ষার্থীরা, আসন্ন একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে আরও তীব্র আন্দোলনের শপথ নেওয়া হয়। মাতৃভাষার উপর নিপীড়ন নেমে আসায় ৩০ বছর আগের সেই বায়ান্নর একুশে ফিরে আসতে শুরু করে সময়ের প্রয়োজনে।

কিছুদিন পরেই বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদাররেসিনের আয়োজিত ইসলামী মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে এরশাদ পরিষ্কার করে দেন অনেক কিছুই। স্পষ্ট হয়ে ওঠে শিক্ষা ও মাতৃভাষার উপর এরশাদ সরকারের চরম স্টিমরোলারের ব্লু-প্রিন্ট। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ মুসলমানদের দেশ, বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র করার জন্যই আমাদের সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল শহিদ মিনার। কিন্তু আমরা দেখি সেখানে আলপনা আঁকা হয়। এ কাজ ইসলাম বিরোধী। শহিদ আবুল বরকত আল্লাহর বান্দা, তার জন্য আলপনা কেন, কোরানখানি হবে। গত ২৪ মার্চ আমি দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। কিন্তু সেদিন আমি আল্লাহর কাছে হাত তুলে কেঁদেছি, আমার জীবনে একটা অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে। ২৬ বছরের বিবাহিত জীবনের পরও আমার কোনো সন্তান নেই। গাউসুল আজমের সেই চাদর হাতে নিয়ে আল্লাহর কাছে আমি কেঁদেছি, একটি সন্তান চেয়েছি, আল্লাহ আমার কান্না শুনেছেন। আমাদের সন্তান হবে ইনশাল্লাহ’।

অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালে, সেই বাংলাদেশের মূল ভিত্তিতে কুঠারাঘাত করে তাকে নিশ্চিহ্ন করে পাকিস্তানি ভাবধারায় সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ এক রাষ্ট্র গড়ে তোলাই ছিল এরশাদ সরকারের মূলনীতি। সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই ভাষণের পর। শিক্ষানীতিও সাজানো হয়েছিল সেভাবেই। তার কিছুদিনের মধ্যে এরশাদ চার জেনারেলকে নিয়ে হেলিকপ্টারে চড়ে ফরিদপুরের আটরশির পীর হজরত মাওলানা শাহ সুফি হাশমতউল্লাহর মুরিদ হয়ে এসে ঘোষণা দেয়, পীর সাহেব বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন।

এরশাদের এহেন ঘোষণায় আস্কারা পেয়ে গলার স্বর উঁচু করে একাত্তরের জেনোসাইডার যুদ্ধাপরাধী নরপিশাচের দল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ওরফে ছাত্র শিবির। তারা চলমান শিক্ষানীতিকে আদর্শহীন ঘোষণা করে দেশকে ইসলামী রাষ্ট্র বানানোর এবং সে অনুযায়ী ইসলামী শিক্ষানীতি প্রণয়নের দাবী জানায়। ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার চেতনা-মূল্যবোধ নিয়ে চরম নোংরা বিষোদাগার ও কটূক্তি করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিবাদ করলে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়, আহত হয় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে থাকে।

ওদিকে ছাত্রনেতাদের উপর দমনপীড়ন ও গ্রেফতার চলতেই থাকে। ছাত্রলীগ সাহিত্য সম্পাদক মোহন রায়হান, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও ইকসুর সহ-সভাপতি খন্দকার মোহাম্মদ ফারুক এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা আতাউল করিম ফারুক ও খোন্দকার আবদূর রহীমকে গ্রেফতার করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা তবুও শান্তিপূর্ণ উপায়ে দাবী আদায়ের পথে অবিচল থাকেন, ১৪ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ কর্মসূচীর ঘোষণা দেওয়া হয়।

পূর্বঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী মিছিলসহ স্মারকলিপি জমা দিতে আন্দোলন নিয়ে সচিবালয় অভিমুখে যাত্রা করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও একাত্মতা ঘোষণা করে অংশ নেয় মিছিলে। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন নারী শিক্ষার্থীরা। শান্তিপূর্ণ মিছিলটি হাইকোর্ট এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ ও তৎকালীন বিডিআরের ব্যারিকেডের মুখোমুখি হয়। বাধ্য হয়ে তোপখানা রোডে সেনাসদস্যের সামনে বসেই শিক্ষার্থীরা স্লোগান ও বক্তৃতা দিতে শুরু করে। ঠিক তখনই ঘটে এক নারকীয় ঘটনা।

বিন্দুমাত্র উস্কানি ছাড়াই পুলিশ-বিডিআর শিক্ষার্থীদের উপর ভয়াবহ হামলা করে। প্রথমে টিয়ারগ্যাস আর জলকামানে গরম পানি ছুঁড়লেও কিছুক্ষণ পর শিক্ষার্থীদের যৎসামান্য ইট-পাথরেই প্রবল প্রতিরোধের মুখে এবং ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টার সময় পুলিশ-বিডিআর নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর সরাসরি গুলিবর্ষণ শুরু করে। গুলির মুখে বেশিক্ষণ টিকতে না পেরে শিক্ষার্থীরা আশ্রয় নেয় পাশের শিশু একাডেমিতে। কিন্তু পুলিশের উপর সেদিন নির্দেশ ছিল কাউকে ছাড়া যাবে না। শিশু একাডেমিতে তখন একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল, তার বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে অস্ত্রধারীরা শিশু একাডেমিতে ঢুকে শিক্ষার্থী-শিশু নির্বিশেষে সকলের উপর গুলি চালাতে থাকে এবং বেয়নেট চার্জ করতে থাকে। এই ভয়াবহ বর্বরতা থেকে এমনকি শিশুরাও সেদিন কেউই রেহাই পায়নি।

ধারণা করা হয় সারাদিনের প্রচণ্ড এবং অসম এই সংঘর্ষে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত হয়েছিলেন সেদিন। কমপক্ষে দশজনের মৃত্যুর চাক্ষুষ প্রমাণ থাকলেও সরকারি প্রেসনোটে দাবি করা হয়, মাত্র একজন নিহত হয়েছে। কিন্তু এত মৃতদেহের সবই গুম করে ফেলে এরশাদের বাহিনী। জাফর, কাঞ্চন, দীপালী সাহা এক ছোট্ট বাচ্চা, মোজাম্মেল, জয়নাল, আইয়ুব, ফারুকসহ এত শহিদের মধ্যে কেবল জয়নাল এবং পরদিন নিহত মোজাম্মেলের লাশটাই পাওয়া গিয়েছিল। বাকিরা হারিয়ে যান চিরতরে, তাদের আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল আহত ও নিহতদের অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসতে, কিন্তু এরশাদের পেটোয়া খুনি বাহিনী অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতেই দেয়নি। বরং সরকারি গণমাধ্যম এবং নানাভাবে এরশাদের সামরিক সরকার সাধারণ শিক্ষার্থীরা নাকি বিনা উস্কানিতে পুলিশ সদস্যের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের হত্যা করেছে এই নোংরা মিথ্যাচার চালিয়ে পুলিশকে উস্কে দেওয়ার কাজ অব্যাহত রাখে। ফলে আহত-নিহতের পাশাপাশি সেদিন প্রায় দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী-জনতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সরকারি প্রেসনোটেই যার সংখ্যা ছিল ১৩৩১ জন।

এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ছাত্রজনতা রাস্তায় নেমে আসে পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার মিরপুর, আমতলী, তেজগাঁও, বাহাদুরশাহ পার্ক, ইংলিশ রোড, মতিঝিল ছাড়িয়ে সারাদেশে। সেদিনও সরাসরি গুলি চালায় এরশাদের পেটোয়া বাহিনী, নিহত হন মোজাম্মেলসহ আরও অসংখ্য। সেদিনও সরকারি প্রেসনোটে নিহত সংখ্যা একজন দাবি করা হয়। ছাত্র-জনতার গণবিস্ফোরণে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে এরশাদ সরকার। এসব খবর ছড়ানো ঠেকাতে সংবাদপত্রের উপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়, আন্দোলন ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে গ্রেফতার করা হয় শেখ হাসিনা, মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন, মেনন, জলিল, অলি, তোফায়েল, মান্নান, সামাদ আজাদ থেকে শুরু করে শীর্ষস্থানীয় প্রচুর ছাত্রনেতাকে।

কিন্তু এরশাদ সরকার আন্দোলন ঠেকাতে পারেনি। উপায়ন্তর না দেখে ১৭ ফেব্রুয়ারি এক সরকারি প্রেসনোটে এরশাদ সরকার জানাতে বাধ্য হয় যে, ‘জনগণের রায় ছাড়া শিক্ষা সম্পর্কে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হইবে না’। একইসাথে গ্রেফতারকৃত ১২২১ জনকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তারা।

অজস্র ছাত্র-জনতার লাশ সামনে ১৯৮৩ সালে সত্যিই বেদনাবিধুর একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। ৩০ বছর আগে বাঙালি জাতি, তার অসমসাহসী শিক্ষার্থীরা বুকের তাজা রক্ত দিয়েছিল মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায়, ৩০ বছর পর তারা রক্ত দিল মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার এবং অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ অক্ষুণ্ণ রেখে শিক্ষার মৌলিক অধিকার সর্বস্তরের জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া নিশ্চিত করতে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ভাষা ও শিক্ষার অধিকারের জন্য আন্দোলন করে জীবন উৎসর্গ উদাহরণ আর আছে বলে মনে হয় না। সত্যি বলতে স্বাধীনতার অনন্য সংগ্রামে পাওয়া মৌলিক অধিকারগুলো অক্ষুণ্ণ রাখতে ৮৩’র এই গণআন্দোলনই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম রক্তাক্ত গণআন্দোলন যা বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত থামেনি।

জাতিকে সত্যিকারের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে এবং শিক্ষার মৌলিক অধিকার এবং মূল সুফল সমগ্র জাতির প্রত্যেকটা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সামরিক নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে দিয়ে, নির্যাতন-অত্যাচার, টিয়ারশেল-লাঠিচার্জ আর সরাসরি গুলি-বেয়নেট চার্জকে বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে আমাদের পূর্বসূরিরা আজকের এই দিনে অকাতরে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। যেন আমরা তাদের উত্তরসূরিরা একটা সুশিক্ষিত স্বনির্ভর দেশ গড়ে তুলতে পারি। কিন্তু রক্তে আর অশ্রুতে লেখা এই অবিস্মরণীয় বিপ্লব আর বিজয় বহুবছর পর খুব সুকৌশলে অগুরুত্বপূর্ণ করে তোলার ব্যবস্থা করা হয় লাল গোলাপ দিয়ে। সাংবাদিক শফিক রেহমানের উদ্যোগে বাংলাদেশে বেশ গুরুত্বসহকারে ১৪ ফেব্রুয়ারি শুধুমাত্র ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়। ধীরে ধীরে বিস্মৃত হতে থাকেন শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতে জীবন দেওয়া জয়নাল, কাঞ্চন, শেফালীরা।

বছরে একদিন ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করা যেতেই পারে। কিন্তু এই উপলক্ষ্যটা যখন এত বড় এক গণআন্দোলনকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহার হয়, তখন তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। আজ আমরা যখন প্রিয় মানুষটার হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে বেড়াবো, ভালোবাসবো, তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও স্মরণ করি এই ঢাবি ক্যাম্পাসের পথে ৪০ বছর আগের এক উত্তাল লাল কৃষ্ণচূড়ার দিনে অসামান্য আত্মত্যাগ করেছিল কিছু মানুষ, শুধু আমাদের জন্য। এই ভালোবাসার দিনটিতে একটি মুহূর্তের জন্য হলেও প্রগাঢ় ভালোবাসায় শ্রদ্ধা জানাই তাদের। এটুকু তো করাই যায়, তাই না?

লেখক: একটিভিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইতিহাস ফিচার ফুল-ফাগুনের প্রথম দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝরেছিল শত প্রাণ রা'আদ রহমান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর