ভাষার মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২১:৪৫
রক্তঝরা অমর একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়ার দিন। সালাম, রফিক, বরকত আর শফিউরের মতো বিষণ্ণ থোকা থোকা নামগুলো স্মরণ করে গর্বে বুক ভরে ওঠার দিন। কালের পরিক্রমায় এই দিনটি আজ গোটা বিশ্ববাসীর জন্যই মাতৃভাষাকে সম্মান জানানোর উপলক্ষ। ব্রিটিশ ভারত ভেঙে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরপরই পূর্ব-বাংলাবাসীর প্রথম স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল মায়ের ভাষা বাংলাকে কেন্দ্র করেই। ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও অধিকার আদায়ের প্রশ্নে বাঙালি তার আত্মপরিচয় আর স্বাতন্ত্র্য নিয়ে প্রথমবারের মতো সচকিত হয়ে উঠেছিল, উনিশশো বায়ন্ন’র একুশে ফেব্রুয়ারি তার সবচেয়ে উজ্জ্বল ক্ষণ।
পূর্ব-পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মুখের ভাষাকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার অজুহাতে উর্দুকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের আভাস পেতেই প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিল বাঙালি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্ত ধরা পড়ে যায় নতুন রাষ্ট্রের পোস্টকার্ড, মানি অর্ডার ফর্ম, এনভেলপ প্রভৃতিতে ইংরেজির সঙ্গে শুধু উর্দুর ব্যবহার দেখে। বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন দ্রুত দানা বেধে উঠতে থাকে। আন্দোলন দমন করতে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ-মিছিল বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। সকাল থেকে তারা দশ জন দশজন করে ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে মিছিল নিয়ে বের হয়। দুপুরের দিকে একটি মিছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত-সহ আরও অনেকে। শহিদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। একুশের আত্মত্যাগের পর আর বাংলা ভাষার দাবিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি পাকিস্তানি শাসকেরা। ক্রমবর্ধমান গণ-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। বাঙালির এর পরের ইতিহাস ধারাবাহিক সংগ্রাম আর বিজয়ের, যার চূড়ান্ত অর্জন স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি বিশাল ও বিস্তৃত। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত এর কাল পরিসর। এই দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে যিনি এর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম ও পদক্ষেপের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক, রয়েছে নাড়ির টান। এই সব আন্দোলনেরই নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। জাতিকে জাগিয়ে তুলেছেন।
বাঙালির অধিকার আদায়ের সকল সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষাবীর সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবিসংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেছিলেন। ওই ইশতেহারে ২১ দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ঐতিহাসিক এই ইশতেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল যার নাম ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল।’ ওই পুস্তিকাটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এই ইশতেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম ভূমিকা ছিল এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে তমুদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। এই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মুহাম্মদ তোয়াহা, আবুল কাসেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখ।
সভায় গণপরিষদের সিদ্ধান্ত ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। এতে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমুদ্দুন মজলিস, ছাত্রাবাসগুলোর সংসদ প্রভৃতি ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠানের দুজন করে প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। এই পরিষদ গঠনে শেখ মুজিব বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে প্রথম সফল হরতাল। এই হরতালে তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব দেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেফতার হন।
ভাষাসৈনিক অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার নিমিত্তে শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ হতে ১০ মার্চ ঢাকায় আসেন। পরের দিন হরতাল কর্মসূচিতে যুবক শেখ মুজিব এতটাই উৎসাহিত হয়েছিলেন যে, এ হরতাল তার জীবনের গতিধারা নতুনভাবে প্রবাহিত করে।’
১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তদানীন্তন পূর্ব-বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে আট দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের আগে জেলখানায় আটক ভাষা আন্দোলনের কর্মী রাজবন্দিদের চুক্তিপত্রটি দেখানো হয় এবং অনুমোদন নেওয়া হয়। কারাবন্দি অন্যান্যের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান চুক্তির শর্ত দেখেন এবং অনুমোদন প্রদান করেন। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির শর্ত মোতাবেক শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য ভাষাসংগ্রামীরা কারামুক্ত হন। ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় শেখ মুজিবুর রহমান অংশগ্রহণ করেন। ওইদিন দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আবদুল মতিন, শামসুল হক প্রমুখ যুবনেতার কঠোর সাধনার ফলে বাংলা ভাষার আন্দোলন সমগ্র পূর্ব-বাংলায় একটি গণ-আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। জনসভা, মিছিল আর স্লোগানে সমগ্র বাংলাদেশ যেন কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে। রাস্তায়, দেয়ালে-দেয়ালে পোস্টার ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ ১৯৪৯ সালে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েও বঙ্গবন্ধু দু’বার গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণ পর্বে শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন।
ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অনুপস্থিত থাকলেও জেলে বসে নিয়মিত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনকারী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।’
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্বে ছিলেন যেমন, আবদুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, কামারুজ্জামান, আবদুল মমিন—তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এবং পরে হাসপাতালে থাকাকালীন আন্দোলন সম্পর্কে চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতেন। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন, ‘অনেকে ভুল করে থাকেন। ১৯৫২ সালের আন্দোলনে তথা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস আপনাদের জানা দরকার। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্দী অবস্থায় চিকিৎসাধীন। সেখানেই আমরা স্থির করি যে, রাষ্ট্রভাষার ওপর ও আমার দেশের ওপর যে আঘাত হয়েছে ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে তার মোকাবিলা করতে হবে। সেখানেই গোপন বৈঠকে সব স্থির হয়। কথা হয়, ১৬ই ফেব্রুয়ারি আমি জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘট করব, আর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন শুরু হবে। জেলে দেখা হয় বরিশালের মহিউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে। তাঁকে বললাম, আমরা এই প্রোগ্রাম নিয়েছি। তিনি বললেন, আমিও অনশন ধর্মঘট করব। ১৬ই ফেব্রুয়ারি আমরা অনশন ধর্মঘট করলাম। এর দরুন আমাদের ট্রান্সফার করা হলো ফরিদপুর জেলে। সূচনা হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন।’
পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনসমূহে দেখা যায়, নিরাপত্তাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৫১ সালের ৩০ আগস্ট থেকে ১৯৫২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেশ কয়েকবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনা হয় এবং ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে প্রতিদিনই কেউ না কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। ওই সময় আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতা, চিকিৎসক, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন, আত্মীয়স্বজন অনেকেই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৫১ সালের ১৩ নভেম্বরের গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওইদিন সকাল ৯টায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে তার কয়েকজন পুরনো বন্ধু, আনোয়ারা বেগম এম. এন. এ, খয়রাত হোসেন এম. এন. এ, মানিক মিয়া, আহমদ হোসাইন এবং প্রায় ৩০ জন মেডিকেল ছাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ৩০ নভেম্বর ১৯৫১ তারিখ সকাল ৯. ১৫টায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান ও ছাত্রনেতা নূরুল ইসলাম। তাঁরা ৯. ১৫টা থেকে ৯. ৪৫টা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় আব্দুস সালাম খান নামক এক গোয়েন্দা সদস্য একটু দূরে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও তাঁরা কী বিষয়ে আলাপ করেন তা শুনতে পাননি বলে ৩০ নভেম্বর, ১৯৫১ তারিখের রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে।
পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উক্তি পুনর্ব্যক্ত করে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ববঙ্গের ছাত্র-জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছাত্রনেতারা বারবার সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে তারা আন্দোলনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন এবং সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং একুশে ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের বিষয়ে কথা বলেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক যাতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকেই করা হয়, সে বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশনা দেন।
এ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং বিভিন্ন ভাষণে তিনি বিস্তারিত বলেছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরও বললাম, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছনের বারান্দায় ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে।…বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে।.. সেখানেই ঠিক হল, আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত গঠন করতে হবে।’
একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাস্তায় নামেন বাংলার দামাল ছেলেরা। বাঙালি তরুণদের আত্মদান শুধু বাংলাদেশ বা বাঙালির নয়, তা এক বিশ্বজনীন ঘটনা। এরপর ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয় পাকিস্তান সরকার। এক্ষেত্রে বলা যায়, ১৯৪৮ সালের মার্চে সীমিত পর্যায়ে যে আন্দোলন শুরু হয় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তার চরম প্রকাশ ঘটে। ভাষা আন্দোলনের পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলী বাংলায় চালু প্রসঙ্গে আইন সভায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধুসহ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ওইদিনও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জানান তিনি। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। এর পেছনেও বিশেষ অবদান রয়েছে বঙ্গবন্ধুর।
ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যেই সীমিত ছিল না। একুশের উৎস থেকে জেগেছিল গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন; সে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে দানা বেঁধেছিল সংগ্রাম। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমাদের পথ দেখিয়েছে একুশের চেতনা। তেমনি একুশ আজও পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ভাষার অধিকার অর্জনেরও পথিকৃৎ হয়ে আছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলা ভাষায় সংবিধান প্রণীত করেন বঙ্গবন্ধু। এটিই একমাত্র দলিল যা বাংলা ভাষায় প্রণীত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রথম বাংলায় বক্তব্য প্রদান করে বিশ্বসভায় বাংলাকে তুলে ধরেন। একুশের চেতনা আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো প্রতিবছর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করছে অন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
লেখক: নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি
সারাবাংলা/এজেডএস/এসবিডিই
ডা. আওরঙ্গজেব আরু ভাষার মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু