বিশ্বকে বদলে দেওয়া সাত ভাষণ
৭ মার্চ ২০২৩ ১১:৩৮
সভ্যতার ইতিহাসে অনেক কালজয়ী নেতাদের যুগান্তকারী ভাষণ আছে যা বদলে দিয়েছিল পৃথিবীকে। ইতিহাসে সেসব ভাষণ বর্তমান সময়ের যে কোনো শক্তিশালী অস্ত্রের চেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। আপামর জনসাধারণের মনে দোলা দিয়েছে, দিয়েছে অনুপ্রেরণা। এতে ইতিহাসের বাঁক বদলে গেছে, সৃষ্টি হয়েছে নতুন ইতিহাস। যেমন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর বুকে জন্ম দিয়েছিল স্বাধীন, সার্বভৌম একটি দেশের।
কালজয়ী এমন বক্তব্য যারা রেখেছেন তাদের মধ্যে যেমন বড় বড় নেতা ছিলেন, ছিলেন তুখোড় বক্তা এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি। যাদের কিছু শক্তিশালী শব্দ ও পরিকল্পনা পাল্টে দিয়েছে বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস। এমন কিছু বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ
১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চ মাসেই মূলত বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো জনতার জনসমাবেশে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু ৭ কোটি বাঙালিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন। দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট বাঙালিদের আন্দোলন সংগ্রামের এক চূড়ান্ত বিন্দু ৭ মার্চ। সেদিন দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের নেতা বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটাই মূলত মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশনা। স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত সংগ্রামের নির্দেশ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণের প্রেরণা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে দেওয়া নির্দেশ ও প্রেরণায় লড়াই করেছেন দেশমাতৃকার জন্য। এই ভাষণ যেভাবে একটি দেশকে স্বাধীন করতে ভূমিকা রেখেছে তা ইতিহাসে বিরল। তাই ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ‘মেমোরি অব দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয় ভাষণটি।
সেনাদের উদ্দেশ্যে প্রথম রানী এলিজাবেথের বক্তব্য
পনের শতাব্দীতে স্পেনকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। একসময় ইংরেজরা নতুন বিশ্বের বাণিজ্য পথে স্পেনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল। তখন স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ব্রিটেনে আক্রমণ করার জন্য ১২২টি জাহাজের বহর নিয়ে স্প্যানিশ আর্মাদ প্রস্তুত করেছিলেন।
তখন স্প্যানিশ আর্মাদের তুলনায় ইংরেজদের সেনা ও জাহাজ দু’টোই কম ছিল। কিন্তু ইংরেজদের রানী প্রথম এলিজাবেথ ছিলেন নেতৃত্বগুণে অগ্রসর।
১৫৮৮ সালে আক্রমণের উদ্দেশ্যে স্প্যানিশ আর্মাদ যখন ইংলিশ চ্যানেলে, তখন এসেক্সের টিলবারিতে জড়ো হয়েছিল ইংলিশ সেনাবাহিনী। জনগণের মনোবল বাড়াতে তখন রাণী সেখানে উপস্থিত হন এবং এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। সেদিন সেখানে রাণী হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেননি এলিজাবেথ। সাদা ভেলভেটের পোশাক আর বর্ম পরে তিনি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া সাহসী নারীর ভূমিকায় সেদিন বক্তব্য রেখেছিলেন।
যে উদ্দেশ্যে বক্তব্য রেখেছিলেন রানী, তা সেদিন পুরোপুরি সফল হয়েছিল। নয় দিনের যুদ্ধশেষে স্প্যানিশরা পরাজিত হয় এবং ব্রিটেন বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেদেরকে এককভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, ওই যুদ্ধ জয়ে ইংরেজদের রণকৌশল বা শক্তিমত্তার চেয়ে বেশি কাজে এসেছিল রাণীর ওই ভাষণ।
দ্বিতীয় ভার্জিনিয়া কনভেনশনে প্যাট্রিক হেনরির ভাষণ
প্যাট্রিক হ্যানরি ছিলেন উপনিবেশিক আমেরিকার মহান বক্তা ও ভার্জিনিয়ার রাষ্ট্রনায়ক। ঔপনিবেশিকদের ওপর অযৌক্তিক কর আরোপ করে যখন তৃতীয় জর্জ স্ট্যাম্প আইন ও টাউনস্যান্ট আইন পাস করেন, তখন হেনরি প্রথম এর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। সে সময় আমেরিকার জনগণের স্বাধীনতার দাবিতে প্রথম আওয়াজ তুলেছিলেন তিনি।
যুদ্ধ বেশ জমে উঠেছিল, কিন্তু বেশিরভাগ ঔপনিবেশিকরা দ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছিলেন। বুঝে ওঠতে পারছিলেন না এ যুদ্ধে জড়ানো তাদের উচিত হবে কি না। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যাওয়া ঠিক হবে কি না। ভার্জিনিয়ার দেশপ্রেমিকদের একটি প্রতিনিধি দল দ্বিতীয় ভার্জিনিয়া কনভেনশনে একত্রিত হন। সেখানে আসন্ন সংঘাতের প্রক্রিয়া নিয়ে ভোট দেন তারা। সেই কনভেনশনই জন্ম হয়েছিল প্যাট্রিক হেনরির বিখ্যাত সেই উক্তির- ‘স্বাধীনতা দাও নয়তো মৃত্যু দাও’ (গিভ মি লিবার্টি অর গিভ মি ডেথ)। সেখানে তিনি মূলত একটি মিলিশিয়া গঠন করার এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
সেই বক্তব্যের কারণেই ভার্জিনিয়ার বিপ্লবীরা সেই যুদ্ধে যোগ দেয়। আমেরিকার স্বাধীনতায় এটি অনেক বড় একটি পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
মহাত্মা গান্ধীর ভারত ছাড় বক্তব্য
সত্যের সন্ধান ও অহিংস বিপ্লবের জন্য বিশ্বের ইতিহাসে স্বীকৃত মহাত্মা গান্ধী। ১৯৪২ সালে যখন পুরো বিশ্ব সংঘাত দানা বাধে, তখন ভারতেও এর আঁচ লাগে। প্রায় দুইশ বছর ধরে ভারতবর্ষে তখন ব্রিটিশরা শাসন করছিল। অর্থনৈতিক অসুবিধা এবং বেশি খাজনা দিতে দিতে ক্লান্ত ভারতের জনগণ। গ্রেট ব্রিটেন যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয় এবং ভারতকে সেখানে টানতে শুরু করে। এতে অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। আগস্টে গান্ধী তার সেই বিখ্যাত ‘ভারত ছাড়’ ভাষণ দেন। সেখানে তিনি ব্রিটিশদের কাছে ভারতীয় জনগণকে তাত্ক্ষণিকভাবে স্বাধীনতা দেওয়ার হুঁশিয়ারি জানান।
গান্ধীর বক্তব্যের দিনই, সর্বভারত কংগ্রেস কমিটি (এআইসিসি) ভারত ছাড়ো রেজোলিউশন পাস করে। তারই পথ ধরে ১৯৪৭ সালে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয় ভারতকে।
মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার বিষয়ে জাতিসংঘকে আহ্বান জানিয়ে এলিয়ানর রুজভেল্ট ভাষণ
প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের স্ত্রী এলিয়ানর রুজভেল্ট আমেরিকার ফার্স্ট লেডি ছিলেন প্রায় বারো বছর। অনেক ইতিহাসবিদ তাকে লাজুক ও শান্ত স্বভাবের হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি ছিলেন নিবেদিত রাজনীতিবিদ ও মানবতাবাদী।
প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান মিসেস রুজভেল্টকে জাতিসংঘের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। এই পদে তিনি তার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজগুলো করতে পেরেছিলেন। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র খসড়া ও উপস্থাপন করেছিলেন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতা যেন এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার না হয় তা নিশ্চিত করাই ছিল এই ঘোষণার উদ্দেশ্য। এলিয়ানর রুজভেল্ট এ খসড়া ও তা সহকর্মীদের বোঝাতে দুই বছর ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করেন। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর প্যারিসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় অংশ নেন রুজভেল্ট। সেখানে তিনি তার বক্তব্যে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার জন্য বক্তব্য উত্থাপন করেন। পরদিন ভোর তিনটায় জাতিসংঘ সর্বসম্মতিক্রমে এটি গ্রহণ করে।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র’র ‘আই হ্যাব এ ড্রিম’
বর্তমান পৃথিবীতে অনেক বেশি পরিচিত মার্টিন লুথার কিং জুনিয়নের এই বক্তব্যটি। ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে’ (‘আই হ্যাব এ ড্রিম’) আমেরিকার ইতিহাসে বিশাল পরিবর্তন এনেছিল। এই ভাষণটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অবিস্মরণীয় একটি ভাষণ হিসেবে বিবেচিত। ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে আমেরিকান নাগরিক অধিকার আন্দোলনের পরিচিত মুখ ছিলেন বাপটিস্ট মন্ত্রী ও কট্টর এই সমাজকর্মী। সেই সময়ে আমেরিকার প্রত্যেকটি জায়গায় গায়ের রঙ নিয়ে বৈষম্যের শিকার হতো মানুষ।
মার্টিন লুথার কিং তার জোরালো বক্তব্যে যাজক প্রতিভাকে ব্যবহার করে জাতিকে সাম্যের গুরুত্ব বোঝাতে চেয়েছেন। ওয়াশিংটনে ১৯৬৩ সালের মার্চের আন্দোলনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিক্ষোভে তিনি জড়িত ছিলেন। সেই মার্চে লিঙ্কন মেমোরিয়ালে কিং তার ঐতিহাসিক বক্তব্যটি রেখেছিলেন। প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার মানুষের সামনে তিনি ‘আই হ্যাব এ ড্রিম’ বক্তব্যটি রাখেন।
বক্তব্যটিকে আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনেরে ঘোষণাপত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাম্যের সমর্থকদের মধ্যে অনেক বেশি সাড়া ফেলেছিল এ ভাষণ।
রিভোনিয়া ট্রায়ালে নেলসন ম্যান্ডেলার ভাষণ
১৯৬৪ সাল। দক্ষিণ আফ্রিকায় তখন বর্ণবাদী সরকার ক্ষমতাসীন। নেলসন ম্যান্ডেলাসহ আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীর অপরাধে বিচার চলছে। ম্যান্ডেলা তখন আরেকটি মামলায় কারাবন্দী। ‘রিভোনিয়া ট্রায়াল’ নামে সেই কুখ্যাত প্রহসনের বিচারে যখন ম্যান্ডেলার পালা এলো, তখন কোনো আইনজীবীর দ্বারস্থ হননি তিনি।
আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি দিয়েছিলেন ১৭৬ মিনিটের ভাষণ। যা স্তম্ভিত করে দিয়েছিল আদালতের উপস্থিত সবাইকে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তার সেই সাহসী উচ্চারণ ‘আমি মরতে প্রস্তুত’ ইতিহাস হয়ে যায়। তার বক্তব্যের শেষ অংশটুকুর ভাবানুবাদ ছিল এরকম, ‘পুরো জীবনটা আমি উৎসর্গ করেছি আফ্রিকার মানুষের মুক্তি সংগ্রামে। আমি শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়েছি এবং লড়েছি কৃষ্ণাঙ্গ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধেও। আমি লালন করি সেই গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের স্বপ্ন, যেখানে সবাই শান্তি ও সৌহার্দে থাকবে এবং কোনো বৈষম্য থাকবে না। এই আদর্শকে আমি অর্জনে রূপ দেওয়ার ইচ্ছা রাখি। কিন্তু যদি প্রয়োজন হয়, তবে এই আদর্শের জন্য আমি মরতেও প্রস্তুত। মৃত্যু এসে ফিরে গিয়েছিল সেবার। তবে এই আগুনকে মুক্ত রাখার সাহস হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের।’
যে বক্তব্য নেলসন ম্যান্ডেলাকে পৃথিবীতে অনেক বড় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সেই বক্তব্যও তাকে কারাবাস থেকে বাঁচাতে পারেনি। ২৭ বছর ৮ মাস কারাবাসের পর ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান।
সারাবাংলা/এসবিডিই