বঙ্গবন্ধু জেলেই কাটিয়েছেন ৮ জন্মদিন
১৭ মার্চ ২০২৩ ২২:২৭
বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৫৫ বছরের আপাতক্ষুদ্র জীবনের ৮টি জন্মদিনই কাটিয়েছিলেন কারাগারে। ছাত্রজীবন থেকেই বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামে রত শেখ মুজিবের নিজের জন্মদিন উদযাপনের সুযোগ খুব একটা মেলেনি। ১৯৫০ সালে নিজের ৩১তম জন্মদিনে কারাবাসে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সবশেষ ১৯৬৮ সালে ৪৯তম জন্মদিনও জেলখানায় কাটে বঙ্গবন্ধুর।
শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আমি আমার জন্মদিন পালন করি না। যে জাতি অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটায়, যাদেরকে কথায় কথায় গুলি করে হত্যা করা হয়, সে জাতির নেতা হিসেবে আমি জন্মদিন পালন করতে পারি না।’
তবুও দিনটিতে পরিবারের সঙ্গেই সময় কাটাতে পছন্দ করতেন বঙ্গবন্ধু। কারাগারের রোজনামচা বইটিতে মহানায়ক লিখেছেন, ‘আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই-বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটা উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস! দেখে হাসলাম।’
কিন্তু পরিবারের সঙ্গে বিশেষ দিনটি পালনের সুযোগও তিনি পেয়েছিলেন খুব অল্প। তার রাজনৈতিক জীবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিনই তিনি কারাগারে ছিলেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন তিনি কারাভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাগারে ছিলেন পাকিস্তান সরকারের আমলে।
১৯৫০ সালে ৩১তম জন্মদিনের পর বায়ান্নর ৩২তম জন্মদিনও কাটে জেলে। সেবার ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরপর ১৯৫৯ সালে বঙ্গবন্ধুর ৪০তম জন্মদিন, ১৯৬০ সালের ৪১তম ও ১৯৬১ সালের ৪২তম জন্মদিন কাটে পাকিস্তান সরকারের হাতে বন্দিদশায়। সেবার টানা এক হাজার ১৫৩ দিন কারাগারে রাখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। দীর্ঘ কারাবাস শেষে মাঝে কিছু সময়ের জন্য মুক্তি পেলেও পরের বছরের শুরুতে আবারও গ্রেফতার করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। ১৯৬২ সালে নিজের ৪৩ তম জন্মদিনও জেলখানায় কাটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরপর ১৯৬৭ সালে ৪৮তম এবং ১৯৬৮ সালে ৪৯তম জন্মদিনও জেলখানায় কাটাতে হয়েছে তাকে।
কারাবন্দি থেকে জন্মদিনে বঙ্গবন্ধু পরিবারের কথাই ভেবেছিলেন। তাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা ছিল মনে। ডায়রিতে বঙ্গবন্ধু সেদিন লিখেছিলেন, ‘মাত্র ১৪ তারিখে রেণু ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেখতে এসেছিল। আবার এত তাড়াতাড়ি দেখা করতে অনুমতি কি দিবে? মন বলছিল, যদি আমার ছেলেমেয়েরা ও রেণু আসত ভালই হত। ১৫ তারিখেও রেণু এসেছিল জেলগেটে মণির সঙ্গে দেখা করতে।’
তবে শেষপর্যন্ত প্রিয়জনদের দেখা পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ডায়রিতে লিখেছেন, “তখন সাড়ে চারটা বেজে গিয়েছে, বুঝলাম আজ বোধ হয় রেণু ও ছেলেমেয়েরা দেখা করার অনুমতি পায় নাই। পাঁচটাও বেজে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন, চলুন আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলেমেয়েরা এসেছে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওয়ানা করলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা নিয়া রাসেলকে পরাইয়া দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিল। ওকে নিয়ে আমি ঢুকলাম রুমে। ছেলেমেয়েদের চুমা দিলাম। দেখি সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়াছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেলগেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো। কিছুটা আমার ভাগ্নে মণিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেট থেকে। ওর সঙ্গে তো আমার দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও। আর একটা কেক পাঠাইয়াছে বদরুন, কেকটার ওপর লিখেছে ‘মুজিব ভাইয়ের জন্মদিনে’। বদরুন আমার স্ত্রীর মারফতে পাঠাইয়াছে এই কেকটা। নিজে তো দেখা করতে পারল না, আর অনুমতিও পাবে না। শুধু মনে মনে বললাম, ‘তোমার স্নেহের দান আমি ধন্যবাদের সঙ্গে গ্রহণ করলাম। জীবনে তোমাকে ভুলতে পারব না।’ আমার ছেলেমেয়েরা বদরুনকে ফুফু বলে ডাকে। তাই বাচ্চাদের বললাম, ‘তোমাদের ফুফুকে আমার আদর ও ধন্যবাদ জানাইও’।”
কারাগারে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে ফুল দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন সহবন্দি ও দলের নেতারা।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন “ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নূরে আলম—আমার কাছে ২০ সেলে থাকে, কয়েকটা ফুল নিয়ে আমার ঘরে এসে উপস্থিত। আমাকে বলল, এই আমার উপহার, আপনার জন্মদিনে। আমি ধন্যবাদের সঙ্গে গ্রহণ করলাম। তারপর বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার একটা রক্তগোলাপ এবং বাবু সুধাংশু বিমল দত্ত একটি সাদা গোলাপ এবং ডিপিআর বন্দি এমদাদুল্লা সাহেব একটা লাল ডালিয়া আমাকে উপহার দিলেন।”
লেখাসূত্র: কারাগারের রোজনামচা- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
সারাবাংলা/এজেডএস