মাহে রমজানের ফাযায়েল ও মাসায়েল
২৫ মার্চ ২০২৩ ১৫:০৩
বছর পেরিয়ে আবারো চলে আসল পবিত্র রমজান মাস। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাসের বার্তা নিয়ে উপস্হিত মাহে রমজানুল মোবারক। যে মাসের সম্মান অনেক। যে মাসের সম্মানার্থে আল্লাহর বান্দাদের জন্য অনেক কিছু দিয়েছেন। আল্লাহ এ পবিত্র মাসে বেহেশতের দরজা খুলে দেন এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেন। রমজানুল মোবারক মাস আসার পূর্বেই রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রস্তুতি শুরু করে দিতেন। রমজান মাসের ২ মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নিতেন। রজব মাসের শুরু থেকে একটি দোয়া পাঠ করতেন এবং পাশাপাশি সাহাবায়ে কেরামদের ও এই দোয়াটি পাঠ করার জন্য বলতেন। সেই দোয়াটি হলো- “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবিও ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিকনা রামাদ্বান।” অর্থাৎ হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য জন্য বরকতময় কর এবং আমাদের জন্য পুণ্যময় মাস রমজান মাস অর্জনের সৌভাগ্য দান কর। [ত্ববরানী: ৩৯৩৯]
রমজান মাস এমন একটি বরকতময় মাস যা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও সাহাবাদের রমজান নিয়ে বলতেন। সাইয়্যেদুনা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- রোযা ও কোরআন কিয়ামত দিবসে দিবসে রোজাদারদের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে সুপারিশ করবে। রোজা আরয করবে- হে রাব্বুল আলামিন! আমি আপনার এ বান্দাকে দিনের বেলায় পানাহার ও মনের কামনা বাসনার বস্তু গ্রহণ করা থেকে বিরত রেখেছি। অতএব, আজ আমার সুপারিশ তার পক্ষে কবুল করুন। আর কোরআন বলবে- আমি তাকে রাতের বেলায় নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। অতএব, আমার সুপারিশ তার পক্ষে কবুল করুন। অতঃপর রোজা ও কোরআন উভয়ের সুপারিশ রোজাদারের পক্ষে কবুল করা হবে। [বায়হাকী, শুআবুল ঈমান] এ পবিত্র হাদিস দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় রোজা এমন একটি আমল যা কিয়ামত দিবসের কঠিন মুহূর্তে আল্লাহর দরবারে সুপারিশের জন্য আরজি করবে এবং গ্রহণযোগ্য হবে। আল্লাহ আমাদের রমজানুল মোবারকে ইবাদত বন্দেগি করে কাঠানোর তওফিক দান করুক। আমিন।
রোজার কিছু প্রয়োজনীয় মাসায়েল: ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে রোজা তৃতীয়। রোজা পালন করার জন্য কিছু মাসায়েল রয়েছে। যার মাধ্যমে রোজা রাখা রাখার বিধান বিদ্যমান।
রোজা কার উপর ফরজ: রোজা ইসলামের অন্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। রোজা ফরজ হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে।
১. মুসলিম হওয়া
২. আক্কেল বা বোধবুদ্ধি সম্পন্ন হওয়া
৩. বালেগ হওয়া বা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া
কার জন্য রোজা ভাঙ্গার অনুমতি রয়েছে: সাময়িকভাবে রমজান মাসে রোজা ভাঙ্গার অনুমতি রয়েছে। রমজান মাসে দুই অবস্থায় রোজা ভাঙ্গা যায়। কিন্তু তা পরিবর্তিতে কাযা আদায় করে দিতে হবে।
১. অসুস্হতা
২. মুসাফির
১. অসুস্থতা: যদি রোজা রাখলে অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বা অন্য কোন নতুন রোগ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অথবা রোগমুক্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে বিলম্ব হয় তাহলে রোজা ছেড়ে দেওয়ার অনুমতি রয়েছে। তবে ডাক্তারের পরামর্শ বা রোগীর পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
২. মুসাফির: মুসাফির বলা হয় যে ব্যক্তি নিজ এলাকা থেকে ৬১ মাইল বা ৯৮ কিলোমিটার দূরে যায় এবং সেখানে গিয়ে ১৫ দিনের চেয়ে কম থাকার জন্য সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে নিজ এলাকা থেকে বের হয়ে ফিরে আসা আসা পর্যন্ত সে ব্যক্তি মুসাফির। মুসাফির থাকা অবস্হায় রোজা ভঙ্গ করার অনুমতি রয়েছে। সে সময়ে যদি রোজা রাখা কষ্টসাধ্য হয় তাহলে তখন রোজা না রেখে পরবর্তীতে কাযা আদায় করে দিতে হবে।
এই দুই অবস্থা ছাড়াও কয়েকটি কারণে রোজা না রেখে পরবর্তীতে কাযা আদায় করা বৈধতা দেওয়া হয়েছে। গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মা যদি রোজা রাখলে দুগ্ধ শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বা সন্তানের জীবনের ঝুঁকি থাকে তাহলে রোজা না রাখার বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
মহিলাদের মাসিক পিরিয়ডের সময়ে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। মহিলাদের সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় যার সময়সীমা ৪০ দিন তখনও রোজা না রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তা পরবর্তীতে কাযা আদায় করে দিতে হবে।
যে সব কারণে রোজা ভঙ্গ হয় এবং কাজা কাফফারা উভয়টা ওয়াজিব হয়:
১. রমজান মাসে রোজা রাখার পর ইচ্ছাকৃত ভাবে পানাহার বা স্ত্রী সহবাস করলে।
২. রমজানের রোজা নিয়্ত করে রাখার পর রোজা অবস্হায় ইচ্ছা করে সামনে বা পিছনের রাস্তায় সঙ্গম করলে বা করালে।
৩. সিংঙ্গা দেওয়ার দরুণ কিংবা চতুষ্পদ জন্তুর সাথে যৌন সঙ্গম করার দরুণ বা কোন রমণীকে স্পর্শ দরুণ রোজা ভঙ্গ হয়েছে ধারণা করে ইচ্ছাকৃত পানাহার করা৷
উপরোক্ত কারণে রমজানের একটি রোজার বদলে অন্য সময়ে একটি রোজা ও কাফফারা ওয়াজিব হয়ে যায়। [জওহারাহ ও বাহারে শরীয়ত ৫ম খন্ড]
যে সব কারণে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায় এবং শুধু কাজা ওয়াজিব হয়: যেসব কারণে রোজা ভঙ্গ হলে শুধু কাজা করতে হয়।
১. নিদ্রা অবস্থায় সঙ্গম করলে
২. বমির বেশির ভাগ মুখে আসার পর তা গিলে ফেললে
৩. নাকে তরল ঔষুধ প্রবেশ করালে ও ইচ্ছা করে নশ টানলে
৪. রোযাদার অবস্হায় অখাদ্য ভক্ষণ করলে
৫. বাধ্য হয়ে স্ত্রী সহবাস যৌন সঙ্গম করলে
৬. কুলি করার সময় অনিচ্ছায় গলার ভেতর পানি প্রবেশ করলে
৭. প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে ওষুধ বা অন্য কিছু শরীরে প্রবেশ করালে
৮. রোজাদারকে জোর করে কেউ কিছু খাওয়ালে
৯. রাত অবশিষ্ট আছে মনে করে সুবেহ সাদিকের পর পানাহার করলে
১০. ইফতারের সময় হয়েছে ভেবে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে
১১. মুখ ভরে বমি করলে
১২. ভুলবশত কোনো কিছু খেয়ে, রোজা ভেঙ্গে গেছে ভেবে ইচ্ছা করে আরো কিছু খেলে
১৩. বৃষ্টির পানি মুখে পড়ার পর তা খেয়ে ফেললে
১৪. কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করালে
১৫. জিহ্বা দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছোলা পরিমাণ কোনো কিছু বের করে খেয়ে ফেললে
১৬. রোজা স্মরণ থাকা অবস্থায় অজুতে কুলি বা নাকে পানি দেওয়ার সময় ভেতরে পানি চলে গেলে [ফাতাওয়ায়ে শামি, ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি, বাহরে শরীয়ত ইত্যাদি]
রোজার কাজা ও কাফফারা: রোজার কাজা হলো একটি রোজার পরিবর্তে আরেকটি রোজা রাখা। রোজার কাফফারা ৩ টি।
১. দাস-দাসী মুক্ত করা
২. ধারাবাহিক ভাবে ৬০ টি রোজা রাখা
৩. ৩-৬০ জন মানুষকে ভালোভাবে দুই বেলা আহার করানো
যেসব কারণে রোজা মাকরুহ হয়:
১. গড়গড়াসহ কুলি করা
২. বিনা প্রয়োজনে খাবারের স্বাদ নেওয়া
৩. রোজা অবস্থায় মুখে থুথু জমিয়ে তা গিলে ফেলা মাকরুহ
৪. রোজা অবস্থায় পেস্ট বা এমন ঝাঁজযুক্ত মাজন দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা মাকরুহ। তবে মিসওয়াক করা জায়েজ
৫. থুথু মুখে জমিয়ে গিলে ফেলা
৬. কামাসক্ত হওয়ার ভয় থাকলে স্ত্রীকে স্পর্শ করা, চুম্বন করা
৭. সন্দেহযুক্ত সময় পর্যন্ত বিলম্ব করে সাহরি খাওয়া
৮. সাহরি ও ইফতার ছাড়া ধারাবাহিকভাবে একাধিক দিনের রোজা রাখা মাকরুহ ইত্যাদি
রোজার নিয়ত: রোজা সহিহ হওয়ার জন্য নিয়ত করা ফরজ। আরবি বা বাংলা যে কোন ভাবে করা যায়। আপনি আরবিতে এভাবে করতে পারবেন:
“নাওয়াইতু আন আছুম্মা গাদাম মিন শাহরি রমাজানাল মুবারাকি ফারদাল্লাকা, ইয়া আল্লাহু ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নিকা আনতাস সামিউল আলিম।” অর্থাৎ হে আল্লাহ! আগামীকাল পবিত্র রমযান মাসে তোমার পক্ষ থেকে ফরয করা রোজা রাখার নিয়ত করলাম, অতএব তুমি আমার পক্ষ থেকে কবুল কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।
ইফতারের নিয়ত: আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া আলা রিযক্বিকা, ওয়া আফতারতু বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমিন। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি তোমারই সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমারই দেয়া রিযিক্বের মাধ্যমে ইফতার করছি।
লেখক: শিক্ষার্থী, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসা
সারাবাংলা/এজেডএস